ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

টিপু সুলতান মসজিদে একদিন

সুমন্ত গুপ্ত  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ৫ ডিসেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১৬:০৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২৫
টিপু সুলতান মসজিদে একদিন

অসংখ্য প্রাসাদ, অট্টালিকা ও পুরোনো স্থাপনার শহর কলকাতা। ইংরেজ শাসনামলের চিহ্ন এশিয়ার যে কয়টি হাতেগোনা শহরে টিকে আছে, কলকাতা তার মধ্যে শীর্ষে। শহরের দক্ষিণের অংশে ব্রিটিশরা বাস করতো, যাকে বলা হতো ‘হোয়াইট টাউন’ এবং উত্তর অংশে ভারতীয়েরা বাস করতো, যাকে বলা হতো ‘ব্ল্যাক টাউন’। বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা কলকাতাকে ভারতের রাজধানী করে রেখেছিল। 

আমি আর মা এসেছি সেই শহরে ঘুরে বেড়ানোর নিমিত্তে। সূর্যদেব নয়ন মেলে তাকানোর পরপরই ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়ে নিলাম যাব নতুন গন্তব্য পথে। আজ আমাদের পথপ্রদর্শক বোন রোশনি। ওর জন্যই অপেক্ষার প্রহর গুনছি। রোশনি আসতেই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। 

ঘড়ির কাটায় তখন কলকাতা সময় সকাল নয়টা ত্রিশ। টুকাইদার গাড়িতে চেপে আমরা চলছি এগিয়ে। রোশনির কাছে জানতে চাইলাম, আমরা আজ যাচ্ছি কোথায়? রোশনি বললো, যে কোন দেশের পুরোনো স্থাপত্য তার অতীত ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠিক তেমনই কলকাতার ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলো ইতিহাসকে এখনও মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরে। চিৎপুর রোডের নাখোদা মসজিদ, টালিগঞ্জের গোলাম মহম্মদ শাহ মসজিদ, ধর্মতলা মোড়ের উত্তর ধার ঘেঁষে টিপু সুলতান মসজিদ, এ ছাড়া শহরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পীরের মাজার সবই কলকাতার সমৃদ্ধ কৃষ্টির অংশ। তবে এই শহরের সবথেকে জনপ্রিয় দুটি মসজিদ হলো নাখোদা আর টিপু সুলতান মসজিদ।

বেশির ভাগ মানুষ টিপু সুলতান মসজিদ বলতে এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের বিশাল ইসলামিক স্থাপত্যটিকেই বোঝেন। তবে টিপু সুলতানের নামেই আরেকটি মসজিদ কলকাতায় রয়েছে। টালিগঞ্জের সেই মসজিদ অবশ্য ‘গোলাম মহম্মদ শাহ মসজিদ’ নামেও পরিচিত। আমরা আজ যাচ্ছি ধর্মতলা মোড়ের টিপু সুলতান মসজিদ পানে। আসলে দুটি মসজিদই তৈরি করিয়েছিলেন শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতানের ছোটো ছেলে প্রিন্স গোলাম মহম্মদ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৭৯৯ সালে তিনি যুদ্ধেক্ষেত্রে বীরের মতো শহিদ হন। তাঁর ১২ জন ছেলেকে ব্রিটিশরা দক্ষিণ ভারতের ভেলোর শহরে বন্দি করে রেখেছিল। কয়েক বছর পর ১৮০৭ সালে তাঁদের নিয়ে আসা হল কলকাতায়। গোলাম মহম্মদ তখন শিশু। পরবর্তীকালে নানারকম সমাজসেবার কাজে নিজেকে তিনি যুক্ত করেছিলেন। বাবার স্মরণে মধ্য কলকাতার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে ১৮৩২ সালে জমি কিনে তিনি টিপু সুলতান শাহি মসজিদ বানানো শুরু করেন। ১৮৪২ সালে মসজিদ বানানোর কাজ শেষ হয়। পরে লোক মুখে এই মসজিদটির নাম হয়ে যায় ‘টিপু সুলতান মসজিদ’। ‘শাহি’ কথাটি হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। 

আমি গাড়ির জানলার বাইরে দিকে তাকিয়ে আছি। দেখছি কলকাতা শহরটাকে। এদিকে যাত্রা পথে আমাকে টিপু সুলতান মসজিদ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়ে দিচ্ছে রোশনি। ১৯৮০-র দশকে মাটির তলা দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের সময় টিপু সুলতান মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেরামত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে মসজিদ সুরক্ষা ও কল্যাণ কমিটি এবং মেট্রোরেলের যৌথ প্রচেষ্টায় মসজিদটি পুনরুদ্ধার হয়। ফের ২০০৪ সালে সুনামির কারণে মসজিদটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মসজিদ কমিটিকে ২১হাজার ৫শ ডলার দান করেন। ফলে আসল মসজিদটির স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক অবলুপ্তি ঘটে। 

টিপু সুলতান মহীশূরের নবাব থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁর ছোট ছেলে মহীশূর থেকে দূরে তাঁর বাবার স্মরণে কলকাতায় এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন এর পিছনেও আছে একটি ইতিহাস। এই ইতিহাস জানার আগেই আমরা মসজিদের কাছে চলে এলাম। আমাদের চার চাকার গাড়ি এসে থামলো। দূর থেকে মসজিদ দেখতে পাচ্ছিলাম। নীল আকাশের মাঝে সবুজ রঙ্গের গুম্বজ যেন চিত্রপটে আঁকা কোন এক রঙ্গিন ছবি। তবে আশেপাশের দোকানগুলো মসজিদের রূপ কিছুটা ঢেকে দিয়েছে বৈকি। 

যাই হোক, গাড়ি থেকে নেমে আমরা পদব্রজে এগিয়ে যেতে লাগলাম। প্রবেশ করলাম টিপু সুলতান মসজিদে। প্রবেশ করতেই মন ভরে গেলো মসজিদের কারুকাজ দেখে। রোশনি বললো মসজিদটির গঠনশৈলী টালিগঞ্জের গোলাম মহম্মদ মসজিদের অনুরূপ। দেখতে পেলাম অনেকেই মসজিদে ভেতর প্রার্থনরত। মসজিদের গঠনশৈলী যে কারোর মন ভরিয়ে দিতে বাধ্য। মসজিদের মেঝেতে দেখতে পেলাম এনটিক টাইলস। সুউচ্চ মিনার ও গম্বুজগুলো কারুকার্য খচিত। 

রোশনিকে বললাম, তুমি বলেছিলে মসজিদটি নির্মাণের  পেছনেও আছে একটি ইতিহাস। রোশনি বললো, ওয়াদিয়ার রাজবংশের রাজত্বকালে ১৭৫০-এর দিকে সুলতান হায়দার আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র টিপু সুলতান মহীশূরের নবাব হন। পুরো নাম সৈয়দ ওয়াল শরীফ সুলতান ফতেহ আলী সাহাব টিপু।টিপু সুলতানের রাজত্বকাল ছিল ১০ নভেম্বর ১৭৫০ থেকে ৪ মে ১৭৯৯ পর্যন্ত। একদিকে তিনি যেমন সুলতান ছিলেন, অপরদিকে ছিলেন বড় মাপের পণ্ডিত ও কবি। মহীশূরের রাজধানী শ্রীরাঙ্গাপাতনম ব্রিটিশ বাহিনী দখল করে নেয়।  দখলের পর এবং টিপু সুলতানের মৃত্যুর ছয় বছর পর, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ১৮০৬ সালে টিপুর পরিবারকে কলকাতা পাঠিয়ে দেয়। তার কারণ গোটা পরিবারকে নজরদারিতে রাখা। ধীরে ধীরে তাঁরা হয়ে ওঠেন কলকাতাবাসী। 

টিপু সুলতানের পুত্র, গোলাম মোহাম্মদ যখন কলকাতায় আসেন তখন তিনি ছোট্ট শিশু। তিনিও ছিলেন পিতার মতো  বিভিন্ন গুণাবলীসম্পন্ন। জড়িত ছিলেন নানাবিধ সমাজকল্যাণমূলক কাজে। টালিগঞ্জে দ্বিতীয়টি মসজিদ নির্মাণের পাশাপাশি একটি মিউজিয়াম বানানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। একবিঘা তালাবসহ পাঁচ বিঘা জমির পশ্চিম পাশে মসজিদটি অবস্থিত। যেখানে ধর্মীয় কাজের সাথে সাথে, কলকাতার জনগণ জানতে পারবে পিতার ঐতিহ্য। 

মিউজিয়ামটির নাম দেন ‘মহীশূরের টাইগার’। কারণ টিপু সুলতান ‘টাইগার অফ মহীশূর’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তবে জাদুঘরটি টিপু সুলতান মসজিদের সামনে স্থাপন করা হবে না। এটা করা হবে কিছুটা দূরে। যেখানে থাকবে সুলতানের ব্যক্তিগত বস্তু এবং সামরিক অস্ত্র ও কামান। যে কামানে লোহার গোলা ব্যবহার করে শত্রুদের আঘাত হেনেছিলেন। 

রোশনির কথা চলছে একদিকে, অন্যদিকে আমরা মুগ্ধ নয়নে দেখছি টিপু সুলতান মসজিদের অপরূপ সৌন্দর্য। প্রায় ১০০০ মুসুল্লি এখানে নামাজ পড়তে পারে। মসজিদে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ ও ৪৮টি মিনার। রোশনি বললো, অনেক তো কথা হলো  চলো তোমাদের মিষ্টি মুখ করাই। রোশনি আমাদের মসজিদের ওপর পাশে ‘কে সি দাসের মিষ্টির দোকানে’ নিয়ে গেলো। 

কে সি দাসের দাদা নবীনচন্দ্র ছিলেন এই মিষ্টির কারিগর। তাকে ‘বউবাজারের কলম্বাস’ বলে ডাকা হতো এক সময়। দাদার ক্যারিশমাকে তিনি ব্র্যান্ড করেছিলেন। ছানার রসগোল্লাসহ দেখতে পেলাম হরেক রকমের মিষ্টি। আমরা বিখ্যাত ছানার পায়েস আর অমৃত কলস অর্ডার দিলাম। স্বাদে অসাধারণ কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো ছবি তুলতে পারলাম না। সেই দুঃখ ঘুচে গেল মিষ্টির স্বাদে।   

ঢাকা/তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়