ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

ধুনটের সেই শিক্ষকের সহযোগিতায় বিক্রি হওয়া সন্তান ফিরে পেলেন মা

বগুড়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৮:২৫, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ধুনটের সেই শিক্ষকের সহযোগিতায় বিক্রি হওয়া সন্তান ফিরে পেলেন মা

বগুড়ার ধুনটে প্রতারকদের কূটকৌশলের শিকার হয়ে নবজাতক সন্তানকে হারিয়েছিলেন আয়েশা আক্তার (১৫) নামের এক মা। সিজারের পর অচেতন অবস্থায় যখন তিনি ক্লিনিকের বেডে, সেই সময় নবজাতককে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ফলে জন্মের পর সন্তানের মুখটিও দেখতে পারেননি তিনি। পরে ধুনটের স্কুল শিক্ষক ফৌজিয়া বিথীর সহযোগিতায় বিক্রি হয়ে যাওয়া নবজাতক শিশুকে ফিরে পেয়েছেন। 

এদিকে, ওই ঘটনায় থানায় মামলা হলেও অভিযুক্তদের কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় সন্তানকে ফিরে পেয়ে খুশি হলেও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাটেনি ওই কিশোরী মাসহ তার পরিবারের। সহযোগিতার হাত বাড়ানোয় হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে স্কুল শিক্ষক ফৌজিয়া বিথিকেও।

আরও পড়ুন: একজন মানবিক মানুষ ফৌজিয়া বিথী

গত বছরের ২৮ নভেম্বর বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মাহবুব ক্লিনিকে সন্তান জন্মদেন আয়েশা আক্তার। পরে সেই ক্লিনিক থেকেই নবজাতককে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ধুনট থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী মা আয়েশা আক্তার। এরপর প্রায় আড়াই মাস পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে শিশুটিকে অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে মায়ের কোলে শিশুটিকে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। 

ধুনট থানায় করা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আয়েশা আক্তার তার নানী আছিয়া খাতুনের সঙ্গে ধুনটের বেলকুচী গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন। প্রায় এক বছর আগে সোহেল রানার সঙ্গে আয়েশা আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ের পর আয়েশা গর্ভবতী হলে তার স্বামী তাকে নানীর বাড়িতে রেখে ঢাকায় চলে যান। আয়েশার দরিদ্রতার সুযোগে একই গ্রামের মো. শাহিন (৫৮), আব্দুস সালাম তাকে শেরপুরের মাহবুব ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে সিজারের মাধ্যমে নবজাতক জন্ম দেন আয়েশা আক্তার। সেই নবজাতক ক্লিনিক থেকে বিক্রি করেন অভিযুক্তরা। এ কাজে আব্দুর রাজ্জাক, সম্রাট মণ্ডলসহ আরও কয়েকজন ছিল। মামলায় তাদেরকেও আসামি করা হয়। ওই সময় ক্লিনিকে থাকাবস্থায় আয়েশা ও তার নানী আছিয়ার কাছে কয়েকটি সাদা কাগজে সই নেন অভিযুক্তরা। পরবর্তীতে সন্তানকে দেখতে না পেয়ে জানতে চাইলে আয়েশাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন তারা।

আয়েশা আক্তার বলেন, ‘সন্তান পেটে পাঁচ মাস থাকতেই শাহিন নানা প্রায় প্রতিদিন আমার জন্য ফল নিয়ে আসতেন। আমিও তাকে জিজ্ঞেস করছি, নানা তুমি প্রতিদিন এসব কেন নিয়ে আসো? সে সময় তিনি কিছু বলতেন না। আমার বাচ্চা যখন ৯ মাস গর্ভে, তখন শাহিন নানা একবার ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিল সিজার করার জন্য। কিন্তু ডাক্তার যখন বলছে, এখন সিজার করলে মা ও সন্তান দুই জনেরই ক্ষতি হবে, তখন আমাকে নিয়ে চলে আসে। এরপর নভেম্বরে আবার আমাকে নিয়ে যায় শাহিন নানা। আমি যাবো না, কিন্তু ওরা আমাকে জোর করে অটোতে করে নিয়ে যায়। সিজারের পর আমার বাচ্চাকেও দেখতে দেয়নি। আমি যখন বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করি, তখন ক্লিনিকের লোকজন বলে তোমার বাচ্চা শাহিন বিক্রি করে দিছে। পরে ক্লিনিক থেকে ফিরে এসে এলাকায় শাহিনের খোঁজ করি বাচ্চাকে ফিরে পাওয়ার জন্য। বেশ কয়েকদিন পর শাহীন নানার দেখা পাই স্কুলের মাঠে। তখন তাকে পেয়ে বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করলে, তিনি জানান, তুই বাচ্চা বিক্রি করে দিছিস, স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও করেছিস। এটা নিয়ে বেশি কথা বললে ছালায় (বস্তা) ভরে যমুনায় ভাসিয়ে দেবো। এ জন্য ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরকম সময় কিছুদিন আগে ফৌজিয়া নানীকে একদিন আমার এই ঘটনা খুলে বলি। তখন তিনি আমার কথা রেকর্ড করে বিভিন্ন জায়গায় দেন। এটা জানার পরপর শাহিন নানা ও তার ছেলে এসে আমাদের অনেক গালমন্দ করে। মেরে ফেলার হুমকিও দেয়।’

আয়েশার নানী আছিয়া খাতুন বলেন, ‘আয়েশার পেটে বাচ্চা থাকার সময় প্রতিদিন শাহিন বাড়িতে আসতো। এসে বলত, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। ওখানে গিয়ে সিজার করে নিয়ে আসবো। আমি শুনে বলতাম, ভাই তুমি কেন নিয়ে যাবা। তখন সে বলত, সমস্যা কি আমি ওর সিজার করাবো।’

বেলকুচি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফৌজিয়া বিথী বলেন, ‘আয়েশা গর্ভবতী ছিল এটা জানতাম। একদিন তার কোলে বড় একটা শিশু দেখে তার নিজের সন্তানের খবর জানতে চাই। তখন সে আমাকে ঘটনা খুলে বলে। আমি সেই কথা মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করি। এটা জানার পর শাহিন আমার স্বামীর বড় ভাই, আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেন। মেরে ফেলার হুমকি দেন। এখন আয়েশা তার সন্তানকে আপাতত ফিরে পেলেও শঙ্কা কাটেনি। কারণ অভিযুক্তদের কাউকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। এতে আয়েশা তার নানী যেমন হুমকিতে আছে, তেমনি আমিও আছি। কত টাকায় আয়েশার সন্তান বিক্রি হয়েছে সেটার সঠিক তথ্য তারা জানেন না।’ 

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পর, ওই শিশুর খোঁজ মেলে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ডায়রিয়া ও সর্দি-কাশিতে অসুস্থ দেখিয়ে ইয়াছিন নামে এক ব্যক্তি সেখানে ভর্তি করায় শিশুটিকে। ভর্তির সময় নবজাতক শিশুটির নাম উল্লেখ করা হয় ফারদিন। কিন্তু, ভর্তির পরপরই তিনি উধাও হয়ে যান। ওই সময় ইয়াছিন নামের ওই ব্যক্তির দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। নবজাতককে উদ্ধারের পর ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয় পুলিশ।’ 

মাহবুব ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক আয়নাল হক বলেন, শাহিন নামে এক ব্যক্তি ওই নারীকে ভর্তি করেছিলেন। সন্তান হওয়ার পর আরও কয়েকদিন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলেন আয়েশা। এখান থেকে কোনো বাচ্চা বিক্রি করা হয়নি। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ এর সঙ্গে জড়িত না।

ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সৈকত হাসান বলেন, জন্মের প্রায় দুই মাস পর ওই নবজাতককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে নবজাতককে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার নেই। মামলা তদন্তাধীন। তদন্তের পর বিস্তারিত সব জানানো হবে।

এনাম/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়