ঢাকা     সোমবার   ১৭ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ৩ ১৪৩১

পর্ব-১

তৃণমূলের উন্নয়ন প্রকল্প ‘সাত ভূতে’ লুটপাট 

জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১২, ২৫ মে ২০২৪   আপডেট: ২৩:০৩, ২৫ মে ২০২৪
তৃণমূলের উন্নয়ন প্রকল্প ‘সাত ভূতে’ লুটপাট 

ছবি: গ্রাফিক্স

বাবা ও বড় ভাই দুজনেই দু’বারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য। পারিবারিক ঐতিহ্য, এলাকাবাসীর চাপ— সব মিলিয়ে ৫০ বছর বয়সে এসে মো. লুৎফর রহমানকে কাঁধে নিতে হয় জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব। মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার চকমিরপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে তিনি প্রথমবারের মতো ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন ২০২১ সালে। লুৎফর রহমানের অভিযোগ, জনকল্যাণের মনোভাব নিয়ে মাঠে নামলেও শুরুতেই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় থেকে হোঁচট খেয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, পিআইও কার্যালয় থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় গ্রামীণ জনপদের বেশিরভাগ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। লুৎফর রহমানের অভিযোগ, হাতেনাতে তিনি প্রমাণ পেয়ে যান, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করার পর বিল তুলতে গিয়ে বরাদ্দের একটা অংশ পিআইও-কে ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে।     

দৌলতপুর পিআইও কার্যালয় থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পের আওতায় প্রথম যে উন্নয়নকাজের সুযোগ পান লুৎফর রহমান তা হলো— ‘মূলকান্দি আফজালের বাড়ি থেকে নীল কমলের বাড়ির কাছে ইন্দরা পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’। এ জন্য বরাদ্দ পান ৭০ হাজার টাকা। প্রকল্প সভাপতিরও দায়িত্ব নেন তিনি। কাজ শুরুর জন্য প্রথম কিস্তিতে ৩৫ হাজার টাকাও বুঝে পান। কিন্তু কাজে নেমে দেখেন, ভালো করে কাজ করতে গেলে এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। পরে নিজের পকেট ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে আরও ৮০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে মোট দেড় লাখ টাকা দিয়ে রাস্তার কাজ শেষ করেন তিনি। কিন্তু এরপরেই বরাদ্দের দ্বিতীয় কিস্তির ৩৫ হাজার টাকা তুলতে গিয়ে পড়েন বিপাকে।

ইউনিয়ন পরিষদের এই মেম্বার জানান, দৌলতপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. মুমিনুর রহমান বিল দিতে টালবাহানা শুরু করেন। পরে ঘটনা বুঝতে পেরে তাকে ৭ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে বিল তোলেন তিনি। 

একই উপজেলার আরেক ইউপি সদস্য নজরুল ইসলামও একই অভিযোগ করলে অনুসন্ধানে নামে রাইজিংবিডি। গত চার মাস মানিকগঞ্জ জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে ৫টিতে অনুসন্ধান চালানো হয়। দৌলতপুর, ঘিওর, শিবালয়, সিংগাইর ও সদর উপজেলার মোট ৭৬টি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখার পর যে সত্য উঠে আসে, তা হলো— দেশের প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উপজেলা পিআইও কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর যে বরাদ্দ দেয়, তার বড় একটি অংশই লুট হয়ে যায়। লুটপাটের গোড়াতেই থাকেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। কার্যভেদে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ঘুষ ছাড়া তিনি কাজের বিল দিতে চান না। পিআইও কার্যালয়ের অন্য স্টাফরাও সুযোগ বুঝে আদায় করেন মাস্টাররোল তৈরির ‘হাদিয়া’।

উপরন্তু দিনের পর দিন বিলের পেছনে ঘুরতে গিয়ে ভুক্তভোগীকে আসা-যাওয়া, চা-নাস্তা, দুপুরে খাওয়ার খরচ— সব মিলিয়ে ব্যয় করতে হয় বাড়তি টাকা। আর এভাবেই কোনো এক সময় নিবেদিতপ্রাণ জনপ্রতিনিধিও বুঝতে পারেন বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক টাকাই খেয়ে ফেলছে ‘সাত ভূতে’। অনেকে আবার আগে থেকেই উন্নয়নপ্রকল্পের টাকা নয়ছয়-এ সিদ্ধহস্ত। এভাবে চেয়ারম্যান, মেম্বার, প্রকল্পসভাপতি, প্রকল্প কমিটির সদস্য— সবাই মিলে জড়িয়ে যান টাকা লুটপাটে। চেয়ারম্যানকেও দিতে হয় বরাদ্দের অন্তত ৫ শতাংশ। আর এসব লুটপাটের প্রভাব গিয়ে পড়ে উন্নয়নপ্রকল্পের কাজে। যেনতেনভাবে কাজ সেরেই বিলের পেছনে দৌড়ান মেম্বাররা। অনেক সময় কাজ না করেও বিল তুলে লুটেপুটে খান সবাই মিলে। মাঝখান থেকে সরকার-প্রশাসন চালানোর সমস্ত খরচ যুগিয়েও উন্নয়নবঞ্চিত থেকে জীবনভর দুর্ভোগ পোহান জনগণ।

এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে কথা বলা হয়েছে ১৪ জন প্রকল্পসভাপতির সঙ্গে। প্রকল্পের বিল আনতে গিয়ে পিআইও-কে ঘুষ দেওয়ার কথা রাইজিংবিডির কাছে অকপটে জানিয়েছেন তারা। আরও কথা বলা হয়েছে ৫ উপজেলার তিনজন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ তাদের কার্যালয়ের ৫ জন স্টাফের সঙ্গে। তারা বলেছেন, ‘পিআইও স্যারদের নির্দেশে সঠিকভাবে সব কাজ করা হয়।’ অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা ‘অনিয়মের সঙ্গে তারা জড়িত নন’ বলে জানিয়েছেন।   

উপজেলা পিআইও’র অফিসের নিয়ন্ত্রণ থাকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার হাতে। মানিকগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত সভায় মেম্বাররা চেয়ারম্যানের কাছে নিজ নিজ ওয়ার্ডের উন্নয়নকাজের চাহিদা জানান। ইউপি সচিব সেগুলো নোট নিয়ে রেজুলেশন করিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর পাঠিয়ে দেন। ইউএনও যাচাই-বাছাই করে পাঠিয়ে দেন পিআইও’র কাছে। পিআইও জেলা কর্ণধার কমিটির কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে বাজেট বুঝে প্রকল্প তৈরি করে চেয়ারম্যানদের কাছে দেন। চেয়ারম্যানরা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে সভাপতির নেতৃত্বে কাজ শুরু করেন। কাজ শুরুর আগে জনগণের টাকার সদ্ব্যবহার করে জনগণের কল্যাণে সঠিকভাবে উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করার বিষয়ে পিআইও এবং প্রকল্প সভাপতির মধ্যে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।  

পাঠক, চলুন দেখে আসি, এই ‘আপাত স্বচ্ছ’ প্রক্রিয়ার আড়ালে বাস্তবে কী ঘটছে?

মেম্বার লুৎফর রহমান এই রাস্তাটি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন

ঘুষ ছাড়া বিল নাই

লুৎফর রহমান এত দিন কৃষিকাজ ও গরুর খামার করে মোটামুটি সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছিলেন। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে রাইজিংবিডিকে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘ইউপি মেম্বার হিসেবে জীবনের প্রথম কাজটি সততার সাথে করার চেষ্টা করেছিলাম। নিজের পকেটের টাকা খরচ করেছি। এলাকাবাসীও সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু ধাক্কা খেয়েছি কাজের বিল তুলতে গিয়ে।’ 

তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে পিআইও মুমিনুর রহমানের কাছে যাই। তিনি বলেন, ‘অফিস স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে সবাই যেভাবে বিল নেয়, সেভাবে আসেন।’ তখন স্টাফদের কাছে গেলে তারা বলে দেন, ‘কাগজপত্র ঠিকঠাক করে আপনাকে জানানো হবে।’ কিন্তু তারা আর কিছুই জানায়নি। পরে আবার একদিন পিআইওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে স্টাফরা বাধা দিয়ে বলেন, ‘স্যার ব্যস্ত আছেন, আরেকদিন আসেন।’ পরে আবারও একদিন যাই এবং একই কথা শুনে ফিরে আসতে হয়। এভাবে কয়েক দফা চেষ্টা করেও পিআইওর সাথে আর দেখা করা সম্ভব হয় নাই, বিলও পাই নাই।’’ 

‘‘পরে স্টাফদের কাছ থেকে জানতে পারি, ‘এভাবে বিল হয় না স্যারকে খুশি করতে হবে।’ পরে বাধ্য হয়ে রাজি হলে পিআইওর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ মেলে। প্রকল্পের কাজে নিজের ও গ্রামবাসীর ত্যাগের কথা জানিয়ে ঘুষ ছাড়া বিল প্রদানের অনুরোধ করলেও পিআইওর মন গলেনি। বরং তিনি বলেন, ‘কাজ ভালো হয়েছে বলেই অফিস খরচ কম ধরা হয়েছে’। ওই অফিস খরচটা স্টাফদের কাছে দিয়ে বিল নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পরে স্টাফরা বলেন, ‘পিআইও সাত হাজার টাকা অফিস খরচ দিতে বলেছেন’’ বলেন এই ইউপি সদস্য। ’ 

লুৎফর রহমান রাইজিংবিডিকে আরও বলেন, ‘তত দিনে আমি বুঝে গেছি, ঘুষ না দিলে পদে পদে হয়রানি হতে হবে। তাই সাত হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ৩৫ হাজার টাকার বিল তুলি।’

একই উপজেলার খলসী ইউনিয়নে ২০২২-২৩ অর্থবছরে টিআর ৩য় পর্যায়ে (সাধারণ) প্রকল্পে পারমাস্তুল আব্বাসের বাড়ি হতে খাজুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত প্রকল্পে ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের সভাপতি করা হয় ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত ইউপি সদস্য হাজেরা বেগমকে। এদিকে, আবার খাজুর বাড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে ‘পারমাস্তুল তারিকুলের বাড়ি হতে আওলাদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ প্রকল্পে ১ম পর্যায়ে ৮৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের সভাপতি ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম। হাজেরা বেগম যে প্রকল্পের সভাপতি ওই প্রকল্পেও নজরুল ইসলাম প্রকল্প কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথম প্রকল্পটিতে বেশিরভাগ মাটি রাস্তার দুই পাশের ডোবা থেকে কেটে রাস্তায় ফেলে সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এ ছাড়া, বেশ কিছু জায়গায় বালু দিয়ে কাজ করায় টেকসই হয়নি। দ্বিতীয় প্রকল্পে আশপাশের ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা থেকে মাটি নিয়ে কোনোমতে মেরামত কাজ করা হয়েছে।

দুটি প্রকল্প ঘুরে দেখার সময় কথা হয় নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দুটি রাস্তার সংস্কার কাজের বর্ণনা দেন। ঠিকমতো কাজ করেননি কেন? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কাগজে-কলমে যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা তো আর পাওয়া যায় না। প্রথম প্রকল্পে ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৭৩ টাকা বরাদ্দ হলেও প্রকল্পসভাপতি হাজেরা বেগম পুরো টাকার কাজ করতে পারেননি। পিআইও-কে ঘুষ ও অফিস স্টাফদের মাস্টার রোলের নামে হাদিয়া দেওয়ার পর যে টাকা ছিল, তার সঠিক ব্যয় করেছেন। দ্বিতীয় প্রকল্পের বেলায়ও তাই করেছি।’

এ দুটি প্রকল্পে পিআইও অফিসে কত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে জানতে চাইলে নজরুল বলেন, ‘পুরোপুরি মনে নাই, তবে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’

নজরুল মেম্বার আরও বলেন, ‘প্রকল্পের কাজগুলো নানা জটিলতায় শতভাগ সম্পন্ন করা যায় না। কারণ, একজন ইউপি সদস্যের বেতন সরকারি অংশ ৩৬০০ টাকা আর ইউনিয়ন পরিষদের অংশ ৪৪০০ টাকা— মোট ৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে আলাদা করে কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। ফলে প্রকল্পসভাপতিরা কিছু অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এ সুযোগটাও পিআইও নেন।’

২০২২-২৩ অর্থবছরে কাবিখা প্রকল্পে নতুন ধামশ্বর আবুল হাসেমের বাড়ি হতে চান মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতে ৪ মেট্রিক টন গম, খলসী নারচী-শ্যামগঞ্জ পাকা রাস্তা খলসী ছায়েদের বাড়ি হতে নরুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে ৫ টন গম; কলিয়া তালুকনগর বিলপাড়া আরমেধেরে বাড়ি হতে ৩ নং প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে ৫ টন, বাঘুটিয়া বাশাইল জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে মাটি ভরাট ৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ হয়। তবে, প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব কাজের অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি।

জিয়নপুর ইউপির সদস্য সবুর উদ্দিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এসব প্রকল্পে সরকারি রেটে গম বা চালের রেটের অর্ধেক টাকা পাওয়া যায়। এ ছাড়া, অফিসিয়াল নানাবিধ কাজে টাকা ব্যয় হয়ে যায়।’

কলিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য গৌরাঙ্গ সাহা বলেন, ‘প্রকল্পের শুরুতে বরাদ্দের অর্ধেক টাকা দিয়ে কাজ শুরু করি। কাজ শেষ করে বাকি টাকা আনতে গেলে লাখে ১০ থেকে ১৫ হাজার ঘুষ না দিলে বিল পাওয়া যায় না। আমরাও বাধ্য হয়ে ঘুষ দিই। তখন পিআইও আর ঝামেলা করেন না। এটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এই ঘুষের কারণে পূর্ণাঙ্গ কাজ করা সম্ভব হয় না। এজন্য অনেক সময় এলাকার মানুষের কথা শুনতে হয়। ঘুষ না দিলে বিল পাই না। এদিকে, ঠিকমতো কাজ না করলে পাবলিকের কথা শুনতে হয়। আমরা আছি বিপদে।’

এভাবে প্রকল্পগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারি ইউপির সদস্য ফজলাল ফকির, বাচামারা ইউপির সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা সরদার, বাঘুটিয়া ইউপির সদস্য মো. আবু বক্কর সিদ্দিক, ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদের তিন বারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য মো. মুনসের বিশ্বাস, শিবালয় উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. মুন্নাফ মিয়া, সিংগাইর উপজেলার জামশা ইউনিয়ন সদস্য শহিদুল ইসলাম অকপটে জানান, পিআইও-কে ঘুষ আর তার অফিস স্টাফদের ‘হাদিয়া’ দেওয়ার কথা।

কলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সিদ্দিকুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভাতা একেবারেই কম। এ ছাড়া প্রকল্পসভাপতিদের আলাদা যাতায়াত ভাতা থাকে না। ফলে প্রকল্পের বরাদ্দ থেকেই অনেকে এসব খরচ মিটিয়ে থাকেন। পিআইওর খরচ তো আছেই। এ ছাড়া মাস্টাররোল পিআইও অফিসের কর্মচারীদের দিয়েই করানো হয় বলে তাদের প্রতি লাখে ১৫০০ টাকা দিতে হয়।’

নজরুল মেম্বার এ রাস্তা মেরামত কাজে পিআইওকে ঘুষ দিয়েছেন বলে জানান

রাস্তা এক, প্রকল্প দুই

২০২২-২৩ অর্থবছরে ‘দৌলতপুর উপজেলার কলিয়া ইউনিয়নের পাঁচথুরি পাকা রাস্তার হাশেম মেম্বারের বাড়ি থেকে অজের আলীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’ কাজে ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই অর্থ বছরেই নির্বাচনি এলাকাভিত্তিক টিআর প্রকল্পে ‘পাঁচথুবি হাশেম মিয়ার বাড়ি হতে উত্তর পাড়া মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ কাজে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তার নাম দুটি ভিন্ন হলেও মূলত একটাই রাস্তা। একই অর্থবছরে একই রাস্তায় দুটি প্রকল্প মিলিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তেমন কাজ হয়নি।

ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দুইপাশের জমি কেটে মাটি তুলে রাস্তাটি উঁচু করা হয়েছে। সৌরভ, আয়নাল, মজনুসহ একাধিক গ্রামবাসী জানান, রাস্তার পাশে ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা হওয়ার পরেও এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে সবাই মাটি দিয়েছে, সরকারকে মাটি কিনতে হয়নি। তারা আরও জানান, ভেকু দিয়ে মাটি কেটে রাস্তায় ফেলা হয়েছে।

তাহলে কি শুধু ভেকুর খরচ ৯০ হাজার টাকা? এমন প্রশ্নে প্রকল্পসভাপতি মো. রিপন মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ভেকু দিয়ে পুরো কাজ করতে পারিনি। পরে শ্রমিকদের নিয়ে করেছি। নানা সংকটে পড়ে নিয়মমাফিক কাজ না হওয়ায় পিআইও ঘুষের জন্য বারবার চাপ দিয়েছেন। ঝামেলা এড়াতে দুটি প্রকল্প থেকে পিআইও-কে মোট ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছি।’

ভূতুড়ে প্রকল্প

২০২১-২২ অর্থবছরে টিআর কর্মসূচির আওতায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নে বরুরিয়া গ্রামে ‘বরুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’র মাঠ ভরাট করতে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক লাখ টাকা। কাগজপত্রে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে টাকাও তুলে নেওয়া হয়। অথচ, সরেজমিন অনুসন্ধানে বরুরিয়া গ্রামে ওই নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ঘিওর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হাসিনা আক্তার পারভীন বলেন, ‘উপজেলায় এ নামের কোনো স্কুল নেই’।

একই অর্থবছরে টিআর প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে ‘বরুরিয়া সর্বজনীন মহা-শ্মশানঘাট’ সংস্কারের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। একইভাবে অনুসন্ধানে ওই নামে কোনো শ্মশান ঘাটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

রাস্তাটিতে দুটি প্রকল্প নেওয়া হলেও রাস্তাটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি

ওই দুই অর্থবছরে দায়িত্ব পালনকারী প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) বর্তমানে কর্মরত আছেন কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে। মুঠোফোনে কথা হলে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বড়বিলা নামের জায়গায় বররিয়া হওয়ায় বিষয়টি প্রিন্টিং মিসটেক হয়েছে। পরে সংশোধন করে কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আর উৎকোচ নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। চেয়ারম্যান–মেম্বাররা বাড়তি সুবিধা না পেলেই অভিযোগ করেন। মাস্টার রোল যারা করে দেয়, তাদের পরিশ্রম হয়, তাই তারা পরিশ্রম বাবদ পারিশ্রমিক নিয়ে থাকতে পারেন।’

দৌলতপুর পিআইও কার্যালয়ের ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট মানিক চন্দ্র রায় রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রতিটি প্রকল্প স্টিমেট অনুযায়ী শেষ হলে সবগুলোই পরিদর্শন করা হয়। আমি ও পিআইও স্যার দুজন মিলে এসব প্রকল্প পরিদর্শন করি। ঠিকঠাক কাজ না হলে পিআইও স্যার বিল দেন না। আর আমি কোনো টাকা পয়সা নিই না।’

প্রকল্প থেকে ঘুষ নেওয়ার কথা সত্য নয় উল্লেখ করে দৌলতপুর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মুমিনুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রতিটি প্রকল্প শতভাগ শেষ হওয়ার পর বিল পরিশোধ করা হয়। যারা বলেছেন মিথ্যা বলেছেন।’

তবে এ বিষয়ে জানতে শিবালয় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুদেব কৃষ্ণকে ফোন করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ওই দুই অর্থবছরে সিংগাইর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার আবু নাছের বর্তমানে কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে। তবে তিনি হজ্ব পালন করতে দেশের বাইরে ছুটিতে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় থেকে হিসাব নিয়ে জানা যায়, দৌলতপুর, ঘিওর, শিবালয় ও সিংগাইর— এই ৪টি উপজেলার ৪ জন পিআইও’র কাছে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৭৯টি প্রকল্পে মোট ১১ কোটি ৭৬ লাখ ৪৬ হাজার ৩৪৬ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। রাইজিংবিডির অনুসন্ধানমতে, এর মধ্যে প্রায় দুই কোটি টাকাই ঢুকেছে ওই চার পিআইও’র পকেটে।

পিআইওদের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারান্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াটির সাথেই অফিসের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের যোগসাজশ থাকায় অনিয়ম সংগঠিত হয়। এসব অনিয়মের ফলে উন্নয়নবঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। যারা এমন অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। এ ছাড়া চুক্তিভিত্তিক এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো উচিত।’

এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. শামছুজ্জামান আসিফ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। এসব অভিযোগের বিষয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরকে জানাবো।’

/এনএইচ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়