ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৩ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

৯০ মণ মুলার দাম ৯০০ টাকা

তানজিমুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৯০ মণ মুলার দাম ৯০০ টাকা

দাম কম হওয়ায় চাষিরা মুলা ফেলে দিচ্ছেন (ছবি : তানজিমুল হক)

তানজিমুল হক, রাজশাহী : রাজশাহীর দুর্গাপুরের মাড়িয়া গ্রামের কৃষক আনোয়ার আলী। রোববার তিনি তার জমি থেকে ৯০ মণ মুলা তোলেন। এরপর দুর্গাপুর হাটে বিক্রি করেন মাত্র ৯০০ টাকায়।

সেই হিসাবে প্রতি মণ মুলা তিনি বিক্রি করেন ১০ টাকায়। অথচ ওই মুলা জমি থেকে তোলার জন্য শ্রমিক খরচ ও পরিবহণসহ অন্যান্য ব্যয় বাবদ আনোয়ার আলীর খরচ হয় প্রায় আড়াই হাজার টাকা।

আবার একই দিনে তিনি বেগুন বিক্রি করেন প্রতি মণ ১২০ টাকা দরে। সেই হিসাবে পাঁচ মণ বেগুন বিক্রি করে তিনি দাম পেয়েছেন মাত্র ৬০০ টাকা। কিন্তু এই বেগুন জমি থেকে সংগ্রহ করা এবং পরিবহণ খরচ বাবদ তাকে গুনতে হয়েছে ১ হাজার ৫০ টাকা। 

হাটে মুলা ও বেগুন বিক্রি করে অল্প দাম পেয়ে আনোয়ার আলী বলেন, ‘এখন হাটে যেতেই মন কান্দি উঠতিছে। আর হাটে যাব না। জমির ফসল জমিতেই পচুক। তাও নুতন করে ক্ষতির শিকার হতে পারব না।’

আনোয়ার আলী জানান, মাড়িয়া গ্রামে সবজিচাষি হসেবে তার সুনাম রয়েছে। এ বছরও তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমিতে মুলা চাষ করেছেন। সেই সঙ্গে বিঘা খানেক জমিতে বেগুন এবং আরো এক বিঘা জমিতে করেছেন কপি চাষ। মাস খানেক আগে শীত শুরু হওয়ার সময় আগাম কিছু মুলা বিক্রি করে বেশকিছু টাকা ঘরে তুলেছেন তিনি। ওই সময় প্রতি কেজি মুলা তিনি পাইকারি বিক্রি করেছেন ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। লাভের ওই মুখ দেখে আরো বিঘা দুয়েক জমিতে মুলা চাষ করেন তিনি। এবার সেই মুলা নিয়েই বিপাকে পড়েছেন আনোয়ার আলী।

শুধু তিনিই নন, তার মতো রাজশাহীর গ্রামগঞ্জের বাজারগুলোতে প্রায় সব ধরনের সবজি বিক্রি করতে এসে এভাবেই লোকসানের মুখে পড়ছেন সাধারণ কৃষক। এর মধ্যে রয়েছে শিম, পটল, ফুলকপি ও বাঁধাকপি। অথচ মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই রাজশাহী মহানগরীতে এসব সবজির কোনোটিই ১০ টাকা কেজির নিচে বিক্রি হচ্ছে না। আবার ঢাকায় গিয়ে আরেক দফা বেড়ে হচ্ছে অন্তত ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি। মাঝখানে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়লেও বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে ঠিকই লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।  

সোমবার রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালী বাজারে প্রতি কেজি বেগুন পাঁচ টাকা, মুলা তিন টাকা, শিম আট টাকা, করলা ১০ টাকা, গাজর ২৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ২০ টাকা,  ফুলকপি চার টাকা, বাঁধাকপি পাঁচ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

রাজশাহী মহানগীর সন্নিকটে কাটাখালী বাজার হওয়ায় এখানে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে এসব সবজি। আবার কাটাখালী থেকে আরো নয় কিলোমিটার দূরে খোদ রাজশাহী মহানগরীতে একই সবজি সোমবার বিক্রি হয়েছে কেজিতে আরো পাঁচ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেশি দরে।

দুর্গাপুর সদরের কৃষক শফিকুল ইসলাম জানান, গত ১৫ দিন থেকে ধরে সবজির বাজার নিম্নমুখী চলছে। এই অবস্থায় মাঝে কয়েক দিন তিনি জমি থেকে মুলা, বেগুন ও ফুলকপি সংগ্রহই করেননি, শেষ পর্যন্ত রোববার বাজারে নিয়ে এসে আবার লোকসানের মুখে পড়েন। তার মতো ওই উপজেলার শত শত কৃষক জমি থেকে মুলা, ফুলকপি ও বাঁধাকপি তুলছেন না বলেও দাবি করেন তিনি।

পুঠিয়ার নন্দনগাছী এলাকার সবজিচাষি ইনছার রহমান জানান, তিনি এ বছর চার বিঘা জমিতে মুলা চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে মুলা চাষ করতে তার খরচ হয়েছে অন্তত ১২ হাজার টাকা। সে হিসাবে তিন বিঘায় খরচ হয়েছে ৩৬ হাজার টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত  মাত্র ৮ হাজার টাকার মুলা বিক্রি করতে পেরেছেন তিনি। বর্তমানে বাজারে যে দাম, তাতে ভ্যান ভাড়াই উঠছে না বলে তিনিও জমি থেকে মুলা তোলা বন্ধ করে দিয়েছেন।

একইভাবে জেলার গোদাগাড়ী, মোহনপুর, পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘাসহ নয়টি উপজেলার লক্ষাধিক কৃষক জমিতেই মুলা, ফুলকপি ও বাঁধাকপি রেখে দিয়েছেন বলেও খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফলে জমিতেই পচছে রকমারি সবজি। খরচের তুলনায় সবজিতে লোকসান হচ্ছে। বিক্রি করতে না পারায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সবজিতে লোকসানের কারণে কৃষক-পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা কান্না।

রাজশাহী মহানগরীর তেরোখাদিয়া বাজারের সবজি বিক্রেতা মুনসুর আলী। তিনি গ্রাম থেকে সবজি কিনে ভ্যানে করে নিয়ে এসে বিক্রি করেন। তিনি জানান, ‘গ্রাম থেকে সবজি নিয়ে এসে এভাবে মহানগরীতে এসে বিক্রি করে কোনো কোনো দিন তার ১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। আবার কোনো কোনো দিন এক-দেড় শ টাকাও হয়। লাভ যা-ই হোক না কেন, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সবজি কিনে নিয়ে এসে মাঝখানে তিনি কিছু টাকা পকেটে ভরেন।

মহানগরীর সবজি ব্যবসায়ী শামসুদ্দিন বলেন, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে  সবজি আসছে। সরবরাহ বেশি থাকার কারণে দাম অনেকটা কম। অথচ মাস খানেক আগেই পাইকারি বাজারেই প্রতি কেজি শিম বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা, বরবটি ৩৫ টাকা, মুলা ১৫ টাকা, ফুলকপি ৩৫ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, গাজর ৫০ টাকা, ঢেড়স ৬০ টাকা, পাকা টমেটো ১১০ টাকা দরে। কিন্তু এখন একমাত্র টমেটো ছাড়া কোনো সবজিই ২০ টাকা কেজির ওপরে বিক্রি হচ্ছে না।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি কাজী গিয়াস বলেন, ‘বাজারে দাম মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকরা লোকসান গুনলেও ঠিকই মাঝখান থেকে লাভের মুখ দেখছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। আবার ভোক্তারাও দাম কমায় খুব একটা সুবিধা পাচ্ছেন না শুধু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই কৃষকরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি ভোক্তারাও সুবিধা পাবেন।’

 

 

রাইজিংবিডি/রাজশাহী/৯ ডিসেম্বর ২০১৪/রণজিৎ/কমল কর্মকার

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়