ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

অন্য ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলা আজ বিপন্ন

ইনামুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
অন্য ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলা আজ বিপন্ন

শিশু তার মায়ের মুখে যে ভাষা শিখে সেটাই তার মধুর ভাষা, মায়ের ভাষা। সে যত বড় হতে থাকে ততই মায়ের বুলিই তার মুখের বুলি হয়ে উঠতে থাকে। এই ভাষাই হয়ে ওঠে তার মনের ভাব জাগরণের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম। তাই তো  শামসুর রাহমান বলেন, ‘মাতৃভাষা হলো মনের সাক্ষাৎকার’। অর্থাৎ কোনো কথার ভাবার্থ তখনই উৎকৃষ্ট রূপে ধরা দেয়, যখন সেই কথাটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। আর হৃদয়ে অনুভূত হওয়ার ভাষাটাই হলো মায়ের ভাষা।

মানুষে মানুষে সংযোগের প্রধান মাধ্যম এই ভাষা। নিজেকে ব্যক্ত করার অপরিমেয় ক্ষমতার আধার ভাষা একান্তই একটি মানবিক প্রপঞ্চ। এ ভাষাই হয়ে ওঠে সেই গোষ্ঠী বা জাতিসত্তার পরিচয়। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় একটি জনগোষ্ঠী প্রাত্যহিক ভাষা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে। এভাবেই বেড়ে ওঠে ভাষা, তিলে তিলে সমৃদ্ধ হয়। সেই জাতির ভাবধারা কিংবা সংস্কৃতি ধারণ করে ভাষা। প্রতুল চন্দ্র গোস্বামী বলেন, ‘মাতৃভাষা জাতির প্রতীক, সংস্কৃতির আদর্শ’।

কোনো অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, উৎপাদন ব্যবস্থা, দেহের গড়ন, মানসিক জগৎ, জীবনচর্যা এমনকি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্পর্শ সমাজ মননের আদল গঠনে প্রবল ভূমিকা রেখে চলে ভাষা। সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ভাষাবোধ। ভাষার সৃষ্টি ভাব থেকে। আর ভাবপ্রকাশের বাহন ভাষাই। তাই ভাব ও ভাষার সম্পর্ক গভীর। বিবর্তনের চিহ্ন বহন করে ভাষা।

ভাষা কখনো এক রকম থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, পরিবর্ধিত হয়। ভাষাকে উৎকর্ষ করতে হয়। আর সাহিত্যই ভাষাকে সমৃদ্ধ করে, উৎকর্ষ সাধন করে। এই সাহিত্যের মাধ্যমে  সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাত উপস্থাপন করা হয়। সাহিত্য রচনার মাধ্যমে ভাষার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। ভাষা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই তো ভাষা দেশকাল ভুলে জাতিতে রূপান্তরিত হয়। একটি অঞ্চলে একাধিক ভাষার মানুষ বসবাস করে।

আর বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে চলেছে বাঙলা ভাষা। বাঙালি জাতি গঠনের আগে থেকেই এই ভাষার যাত্রা শুরু। যার পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া যায় ১৩০০ বছর আগে। ভাষাকে উৎকর্ষ সাধনের জন্য গাঠনিক মানে নিয়ে আসার চেষ্টা চলেছে উনবিংশ শতাব্দীতে। এ ভাষায় রচিত হয়েছে চর্যপদ। বৌদ্ধ সহজিয়ারা তাদের সাধন পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন সেখানে।

এ ভাষার উপর চোখ পড়ে শোষিত শ্রেনীর। কারণ তারা চেয়েছিলো এই জাতিকে ধ্বংস করতে, নিঃশেষ করতে। সেজন্য পাকিস্তান সরকার বাঙালির ভাষাকে বাজেয়াপ্ত করার প্রয়াস চালায়। বাঙালির লেখার বর্ণগুলোগুলো ছিনিয়ে নিয়ে উর্দু প্রবেশ করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। সমাজ সচেতন বাঙালি তাদের অধিকারে সোচ্চার হয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে অধিকার ছিনিয়ে আনে। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে ঘটনা শোষকগোষ্ঠী ঘটিয়েছে, তা এখন বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাই তো ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাঙালির না, বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। ২০০০ সাল থেকে মায়ের ভাষাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই দিসবটি পালিত হয়ে আসছে।

বাঙালিরা ভাষার জন্য শোষকের সঙ্গে লড়াই করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। সেই ভাষার ইতিহাস বর্তমান প্রজন্ম কতটুকু জানে? যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করে রবী ঠাকুর বিশ্বকবি হলেন, যে ভাষা নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বানিয়েছে, সে ভাষাকে ভালোবেসে অতুল প্রসাদ সেন বলেন, ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা!’

ঈশ্বরচন্দ্র, মাইকেল, জসীমউদ্দিন, জীবনানন্দ, বিহারীলাল, অমিয়, আল মাহমুদেরা যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করে সমৃদ্ধ করেছে, সেই ভাষা আজ কতটুকু চর্চিত হচ্ছে? জাতীর পরিচয় বহনকারী ভাষা আজ হুমকির সম্মুখীন। আমরা যে ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছি, সেই ভাষাকে চর্চার জায়গা সংকীর্ণ করছি। যত্রতত্র বাংলার সঙ্গে ইংরেজির মিশ্রণ, দাপ্তারিক কাজে ইংরেজির ব্যবহার, বাংলা বানানের ভুল হরহামেশাই ঘটছে সরকারি চিঠিপত্রেও। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ইংরেজির চর্চা করতে করতে শিক্ষার্থীরা এক রকম বাংলাই ভুলে যাচ্ছে।

ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা যে কেউ ব্যবহার বা চর্চা করতে পারে। কিন্তু আগে তো নিজের ভাষাটাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। অন্য ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা আজ নিজেদের ভাষাকেই বিপন্ন করে তুলছি। আর ভাষা বিপন্ন হওয়া মানে জাতিকে বিপন্ন করার পথে আগানো। ভাষার মাসে সব ভাষা শহিদদের স্মরণ করে বাংলা ভাষার বিকাশ হোক এবং যথাযথ চর্চা হোক।

(লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।)
 

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়