ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

কিশোর গ্যাং: আলোর পথে ফেরাতে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা

তনুশ্রী রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৭, ২৯ মে ২০২৪  
কিশোর গ্যাং: আলোর পথে ফেরাতে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা

দেশজুড়ে বেড়ে চলেছে ‘কিশোর গ্যাং’ এর দৌরাত্ম্য। সমাজে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় গড়ে ওঠা এ কিশোর গ্যাং অপরাধ জগতের প্রত্যেকটি শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করছে। গণমাধ্যমগুলোতে চোখ রাখলেই দেখতে পাওয়া যায়, সমাজের তথাকথিত ত্রাসদের শিহরিত কর্মকাণ্ড। গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত কিশোরদের জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত তো হচ্ছেই, সে সঙ্গে এদের দ্বারা দেশ ও সমাজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

সাধারণত ১২-১৭ বছর বয়সী শিশু, কিশোররাই এ দলের সদস্য হয়ে থাকে। প্রতিটি দলে সাধারণত ৮-১০ জন সদস্য থাকে। অবশ্য এর বেশিও থাকতে পারে। প্রতিটা দলের থাকে সতন্ত্র নাম এবং অনেক ক্ষেত্রে ড্রেসকোড ও দলের প্রতীকী চিহ্ন থাকতে দেখা যায়। শুরুতে নিজেদের পাড়া বা মহল্লায় আধিপত্য বিস্তার বা তথাকথিত ‘হিরোইজম’ দেখাতে গিয়ে এ ধরনের গ্যাংয়ের উৎপত্তি হয়। ধীরে ধীরে খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধর, ইভটিজিং, মাদকদ্রব্য সেবন ও পাচার, সাইবার ক্রাইম ও দখলদারির মতো বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডই এদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, আত্মরক্ষার জন্য নিজেদের কাছে রাখে দেশি, বিদেশি বিভিন্ন অস্ত্র, হকি স্টিক, চাপাতি, পিস্তল, বোমা, ছুরি ইত্যাদি।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজে‌ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা কিশোরদের এ দলগুলো শুধু কি নিজেদের স্বার্থে এসব কাজে যুক্ত হচ্ছে? এর উত্তরটি সর্বজনবিদিত। মূলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠে এসব গ্যাং। সমাজে নিজেদের ক্ষমতা জাহির ও আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে কিশোরদের তারা কাজে লাগায়। রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও যে কোনো স্বেচ্ছাসেবক দল বা প্রভাবশালী ব্যক্তির অধীনে গড়ে ওঠে এসব দল। কিশোরদের এ দল পরিচালনাকারী বা দলের নেতা স্থানীয়ভাবে ‘বড় ভাই’ নামে পরিচিত। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মূলত এসব তথাকথিত ‘বড় ভাই’ এর মাধ্যমেই কিশোর গ্যাং পরিচালনা করেন।‌

দেশজুড়ে প্রায় ২৩৭টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যায়। তবে কিশোর গ্যাংয়ের তুলনায় আমাদের দেশে কিশোর সংশোধনাগারের সংখ্যা ও তৎপরতা কম হওয়ায় এদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। অনেক সময় দেখা যায়, কিশোর গ্যাংগুলো পারস্পরিক সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। ছোট-খাটো বিষয়ে ঝগড়া, মতের অমিল, মারধর, তর্ক-বিতর্ক, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বসহ নানা অর্ন্তদ্বন্দ্বের ফলে এরা একে অপরের হাতে খুন, জখম হয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এদের কারাগারে পাঠালেও কিছুদিন পর এরা জামিনে বেরিয়ে এসে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

জন্মের পর একটা শিশু বা কিশোরকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব থাকে তার পরিবারের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আগে ধর্মীয় অনুশাসন শাসন মেনে চলা ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার দায়িত্ব থাকে তার পরিবারের। আমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিবারই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল। যখন একটি শিশুর পরিবার বা তার মা-বাবা মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে অসমর্থ হয়, তখনই সে উপার্জনের যেকোনো সহজ পন্থা অবলম্বন করে নিজের চাহিদা পূরণের জন্য। ফলে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও অভাব, দারিদ্র্য, দুশ্চিন্তা, বাবা-মার বিচ্ছেদ, প্রেমে ব্যর্থতা, খারাপ সঙ্গ, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও হতাশা, লোভ, বেকারত্ব প্রভৃতি কারণে শিশু-কিশোররা এ খারাপ কাজে যোগ দেয়। 

অবশ্য এখন শুধু দরিদ্র শিশু-কিশোররাই নয়, বরং আর্থিকভাবে সচ্ছল কিশোররাও গ্যাংয়ের সদস্য হচ্ছে। উচ্চ পরিবারগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাবা-মা ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না, ঠিকভাবে দেখাশোনা‌ করতে পারছেন না। ফলে সেসব কিশোর স্বল্প বয়সেই অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যাচ্ছে। বখাটে বন্ধু-বান্ধব বা বড় ভাইদের সঙ্গে মিশে অসৎ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এ সংকট মোকাবেলায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। পরিবারের সদস্যদের উচিৎ, এক্ষেত্রে একটি শিশুকে যথাযথ সময় ও স্নেহ-ভালোবাসা দেওয়া। এতে একটি শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনে সাফল্য বয়ে আনতে পারে।

এদিকে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর উচিৎ, সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা, শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া, তাকে সময় দেওয়া, বিনোদন দেওয়া, শিশুদের অল্প বয়সে কাজ করতে না পাঠানো, তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা, কার সঙ্গে মিশছে তা নজর রাখা এবং শৈশব থেকেই সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।

এসব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পরিবারগুলো কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোকেও শিশু-কিশোরদের নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অনেকটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর বর্তায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যেই কিশোর গ্যাংগুলোর দৌরাত্ম্যে বন্ধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এছাড়া আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করছেন, যা বড় স্বস্তির বিষয়। কিন্তু এর পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, যাতে কোনো নিরপরাধ কিশোর-কিশোরী শাস্তি না পায়।

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত চেষ্টাই কিশোর অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি যত দ্রুত সম্ভব, এ ভয়াবহ কর্মকাণ্ডে লাগাম ধরতে পারলেই তা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়