ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

‘আমার মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না’

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৩৭, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আমার মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না’

১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ধূমকেতুর মতো সালমান শাহ’র আবির্ভাব। মাত্র চার বছরে ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই সালমান শাহ ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। যে রহস্যের জট আজো খোলেনি। সালমান শাহ’র পরিবারের দাবি তাকে হত্যা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সন্দেহের আঙুল ওঠে স্ত্রী সামিরার দিকে। ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট সালমান শাহ’র সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন সামিরা। প্রেমের বিয়ে পায় সফল পরিণতি। কিন্তু খুব দ্রুতই পরিণয় রূপ নেয় গভীর শোকে। এতগুলো বছর পর এই প্রথম সামিরা বলেছেন সালমান শাহ’র সঙ্গে প্রেম, বিয়ে, দাম্পত্যজীবন এবং স্বামীর মৃত্যুপরবর্তী দুঃসহ সেই দিনগুলোর কথা। রাহাত সাইফুলের অনুলিখনে সামিরার বয়ানে পড়ুন এই ধারাবাহিকের চতুর্থ কিস্তি।

আমার কান্না ইমন (সালমান শাহ) সহ্য করতে পারত না। রুমে ফিরে আসার পর আমি কাঁদছিলাম। ইমনও কাঁদছিল। ইমন আমাকে বলল, তুমি কেন কাঁদছ? কাল সব ঠিক করে দেব। রাগ করো না। আমাকে মাফ করে দাও। আমি এত ভুল করেছি যে, তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারছি না।

আমার ভেতরে তখন অভিমানের পাহাড় জমেছে। ও বার বার আমার কাছে আসতে চাচ্ছিল। আমি এড়িয়ে গেছি। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। ইমন কিছুতেই আমার অভিমান ভাঙাতে না পেরে টেপ রেকর্ডারে আমার পছন্দের গান বাজাতে লাগল। এক সময় আমার চোখ লেগে যায়। আমি ঘুমিয়ে পরি।

সকাল বেলা কাজের মেয়ে ডলি এসে আমাকে জাগায়। সে বলল, ইমনের আব্বা এসেছে। আমি সেদিন স্কার্ট পরে ছিলাম। ওড়নাটা গায়ে চাপিয়ে দ্রুত আব্বার সঙ্গে দেখা করলাম। আব্বার সঙ্গে কথা বললাম। আব্বা বললেন, সামিরা, আজ আমরা সিলেট যাব। ৫০ হাজার টাকা দাও। নাস্তাটাও টেবিলে দিতে বললেন। আমি নাস্তা সাজিয়ে দিলাম। আব্বা নাস্তা করলেন। আমি জানতে চাইলাম ইমন ঘুমাচ্ছে, ওকে ডেকে দেব কিনা? আব্বা নিষেধ করলেন এবং চলে গেলেন।

আমি তখনও কল্পনা করিনি সেদিন কী ধরনের ঘটনা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টদায়ক সকাল ছিল সেদিন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যা ভোলা অসম্ভব। আব্বা চলে গেলে আমি রুমে এসে ইমনের পাশে শুয়ে পরি। এরপর ১১টার দিকে ইমন ঘুম থেকে ওঠে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম- ও বাথরুমে গেল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। এরপর আবার আমি ঘুমিয়ে পরি। এরপর কখন সে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। ওই যে ক্ষণিকের জন্য ওর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য, ওটাই ছিল ওকে আমার শেষ দেখা।

হঠাৎ ডলির ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। আসলে তখন তন্দ্রামতো এসেছিল। ডলি বলল, ভাইয়া তো অনেকক্ষণ হলো রুমে ঢুকেছে। বের হচ্ছে না। অনেক ডেকেছি কোনো সাড়া দিচ্ছে না। শুনেই আমি দ্রুত উঠে গিয়ে দরজায় নক করলাম, জোরে ধাক্কালাম। কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। পরে আবুলকে দিয়ে আরেকটা চাবি এনে দরজা খুললাম। দরজা খুলেই আমি যে দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি দৌড়ে গিয়ে ওর পা ধরে উপরে ঠেলে ওঠানোর চেষ্টা করলাম। তখন বাসায় আবুল, ডলি, মনোয়ারা ছিল। আমরা চারজনই চিৎকার করছিলাম।

চারজন মিলে ইমনকে নামালাম। আমি আমার পায়ের ওপর ইমনের মাথা রেখে তাকে শুইয়ে দিলাম। সবাই এসে এই দৃশ্যই দেখেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসা লোকজনে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তখন কারো কোনো কথাই আমার কানে ঢুকছিল না। ম্যানেজার সেলিম, পরিচালক মতিন রহমান, বাদল রহমান, রুবি আন্টি, ইয়াসমিন আন্টি, সুইটি ভাবি, সালমান ভাইসহ প্রতিবেশী অনেকেই ছিল। আমরা ইমনের মাথায় পানি ও তেল দিচ্ছিলাম। সবার সামনেই নীলা চৌধুরী সেদিন আমাকে মেরেছিল। আবুল প্যান্ট চেঞ্জ করতে গিয়ে ইমনের পকটে একটি চিঠি পায়। চিঠিতে লেখা ছিল: ‘আমি চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার, পিতা- কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ১৪৬/৫, গ্রীনরোড, ঢাকা-১২১৫ ওরফে সালমান শাহ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, আজ অথবা আজকের পরে যেকোনো দিন আমার মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি।’

মৃত্যুর পর অপমৃত্যুর সুরত হালে আমার শ্বশুর, দেবর, খালু শ্বশুর ও পরিচালক বাদল ভাই স্বাক্ষর করেছিল। এরপর কত ঘটনাই না ঘটল। ডিবি আমাদের ৪০ জন প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করেছে। সিআইডির কাছে ইমনের মোবাইলের কল লিস্ট আছে। ইমনের ফোনে লাস্ট কল কে করেছিল? কী কারণে সেদিন রাতে ইমন ফোন সেটটি ভেঙে ফেলল? এসব প্রশ্নের উত্তর জরুরি। সেদিনের সেই স্কার্ট আমি আজও ধুইনি। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইমনের স্মৃতি। ইমন আমাকে শেষবার দেখেছিল এই পোশাকে।   

 

পড়ুন :  ইমনের নাম ‘সালমান শাহ’ আমি রেখেছিলাম

          

সালমান শাহ’র প্রেম ও বিয়ে


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়