ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

ওটিটিতে যে ফর্ম শুরু হয়েছে আমরা ঘুরে দাঁড়াব: ডলি জহুর

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৮, ২৩ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৩:৫০, ২৩ এপ্রিল ২০২৩
ওটিটিতে যে ফর্ম শুরু হয়েছে আমরা ঘুরে দাঁড়াব: ডলি জহুর

বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ডলি জহুর। আশির দশকের মাঝামাঝি টেলিভিশন নাটকে পা রাখেন তিনি। এরই মধ্যে অভিনয় জীবনের সাড়ে চার দশক পার করেছেন। প্রাপ্তি হিসেবে পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। রাইজিংবিডির সিনিয়র সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম শান্তর সঙ্গে ডলি জহুরের কথোপকথন তুলে ধরা হলো। 

রাইজিংবিডি: আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে ৮০-৯০ দশকে ঈদের নাটকের প্রস্তুতি বিষয়ে জানতে চাই।

ডলি জহুর: ঈদের জন্য নাটক নির্মিত হতো- আলাদা কিছু ছিল না। ওই সময়ে বিটিভির জন্য নাটক নির্মাণ করা হতো। বেশ কজন নাট্যকার ঈদের নাটক লিখতেন। সেই নাটক জমা দেয়ার পর বাছাই করা হতো। বাছাইকৃত চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করতেন নির্মাতারা। এখনকার মতো এত টেলিভিশন না থাকার কারণে সবার নাটক ঈদে প্রচার হতো না। আসলে এখনো যা ওই সময়েও তাই ছিল। এখন কোয়ান্টিটি বেড়ে গেছে, তখন কোয়ান্টিটি কম ছিল, কোয়ালিটি বেশি দেখা হতো আরকি! এখন প্রচুর নাটক হচ্ছে, নানারকম চিন্তা-ভাবনা অনেক সুযোগ-সুবিধাও আছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব মেনেও নেয়া হচ্ছে। আর মেনে নেয়াটাই স্বাভাবিক। অন্যান্য অনুষ্ঠানের চেয়ে নাটকটাই বেশি চলে। এমনকী একজন গানের শিল্পীও গানের অনুষ্ঠানের চেয়ে নাটক বেশি দেখতে চান।   

রাইজিংবিডি: চরিত্রের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ এখন কতটা রয়েছে?

ডলি জহুর: কোয়ান্টিটি বেড়ে গেলে কোয়ালিটি থাকে না। যার জন্য প্রস্তুতি থাকে না। এখন অনেক নাটক হচ্ছে। আজকে একটি নাটকের শুটিং করতে যাচ্ছে, আগামীকাল অন্য নাটকের শুটিং। এমন শিডিউলের মধ্যে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ কোথায়? এ ক্ষেত্রে শিল্পীদেরও দোষ নেই।   

রাইজিংবিডি: ৮০-৯০ দশকে নাটকের গল্প বর্তমান সময়ে কতটা পরিবর্তিত হয়েছে? 

ডলি জহুর: গল্পের পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। একই গল্পে তো সব নাটক হবে না। ওই সময়ে ১০টি নাটক নির্মিত হতো। গল্পগুলোও একদম আলাদা ছিল। এখন ১০০ নাটক নির্মিত হচ্ছে, এত নাটক নির্মিত হলে গল্পগুলোর মাঝে একটা মিল থেকে যায়। নতুন আর কত করবে মানুষ! এটা মেনে নিতেই হবে। সময়ের সঙ্গে সব কিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে- নাটক, আমাদের চালচলন, সংস্কৃতি সব কিছুরই তো পরিবর্তন হচ্ছে। সুতরাং এই পরিবর্তন না মেনে নেয়ার কারণ নেই। 

রাইজিংবিডি: অসংখ্য নাটকের ভিড়ে মানসম্পন্ন কতটা নাটক নির্মিত হচ্ছে?

ডলি জহুর: কোয়ালিটিফুল নাটক এখনও হচ্ছে। কিন্তু বেশি হলে একটুখানি সমস্যা তো হবেই। আগে ভালো নাটক হতো এখন হয় না- এটা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ এখনো অনেক ভালো নাটক হয়। অনেক আছে, যার একটি দৃশ্য দেখলে বসে যেতে ইচ্ছে করে। তার মানে ভালো মানের নাটক হচ্ছে। 

রাইজিংবিডি: সম্প্রতি ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছে। বর্তমান সময়ের নাটকে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

ডলি জহুর: এটা বিচার করা খুব কঠিন। এতগুলো টিভি চ্যানেল, এতগুলো কাজ হচ্ছে, কোনটা কখন প্রচার হচ্ছে তা খেয়াল রখা অনেক কঠিন ব্যাপার। একক নাটকের পাশাপাশি অনেক ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হচ্ছে। এসব নাটকে একটু দুষ্টামি ফাজলামি না রাখলে চলে না— এমন ধারণা হয়ে গেছে। আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে একটু আনন্দ দিতে চায়, তারা সে চেষ্টাও করছে। আবার অনেকে মনে করছেন সিরিয়াস নাটকও হওয়া উচিত। আবার কোনো টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বলে, এত সিরিয়াস-গম্ভীর নাটক মানুষ দেখে না। একটু হাসি-ঠাট্টা থাকা উচিত। হাসি-ঠাট্টা রাখতে গিয়ে অনেকে হয়তো একটু বেশি মজা করছে- ভারসাম্য রাখতে পারছে না। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অনেক সুন্দর সুন্দর নাটক রয়েছে। কিন্তু ওখানে কথা বলতে বলতে একটা গালি দিয়ে ফেলছে। এই একটি শব্দই হয়তো জায়গাটাকে নষ্ট করে ফেলছে। কিন্তু ওরা এত ক্যাজুয়ালি বলে যে বিষয়টি না ধরলে কিচ্ছু না, আবার ধরলে খারাপ।

রাইজিংবিডি: ক্যাজুয়ালি বললেও গালি ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে করে কি পরবর্তী প্রজন্ম বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ‍ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?

ডলি জহুর: এভাবে চলতে থাকলে এক সময় হয়তো এই জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি এর লাগাম ধরা হয় তবে সমস্যা হবে না। ওটিটিতে যে ফর্ম শুরু হয়েছে, সেটা যদি থাকে তবে আমরা ঘুরে দাঁড়াব- ভালো কিছু হবে। কিন্তু এক হাঁড়ি দুধে একটু ময়লা ফেললে নষ্ট হয়ে যায়! এই নষ্টটা যাতে না হয় সেদিকে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। শুটিংয়ে কিছু কিছু সংলাপ বলতে বলা হতো, বাধা দিতাম। বলতাম, এই সংলাপ না বললে অসুবিধা কোথায়? আমি যেটা বললাম সেটা কি খারাপ লাগছে? আসলে নাটক তো আমরা একলা দেখি না। পরিবারের অন্য সদস্যরাও দেখেন। সেখানে শিশু রয়েছে। এখন সবাই মিলে (পরিবার) যদি একটা নাটক বা সিনেমা না দেখা যায়, তবে এটি দেখার অযোগ্য। আমি আমার কাজে এভাবে প্রতিবাদ করেছি। অনেক সময় পরিচালক আমার কথা শুনেছেন, অনেক সময় দ্বিমত পোষণ করেছেন। 

রাইজিংবিডি: বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার মামুনুর রশীদের ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ মন্তব্য নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই।  

ডলি জহুর: মামুন ভাই সারা জীবন যে ধরনের নাটক করেছেন সেগুলো নিয়ে কি বলব! ওনার নাটক মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। ওনার নাটকে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মামুন ভাই একটা আফসোসের কথা বলে ফেলতেই পারেন। কিন্তু সেই কথা বলতে গিয়ে একটা নাম বেরিয়ে এসেছে- এ নাম না বললেও হতো! কথা বলার সময় যদি খুব সচেতনভাবে বলতেন তবে হয়তো নামটি বলতেন না। আসলে কথা প্রসঙ্গে নামটি চলে এসেছে। এখানে আমি দোষের কিছু দেখি না, এটাকে বিচারও করতে যাই না। আমি যদি সচেতনভাবে বলি, ডিপজল সিনেমাকে খারাপ করেছেন। আমাদের মাঝে এটা নিয়ে কথা হয়। কিন্তু এই কথাটা ওই অর্থে বলিনি। বরং ওই সময় সিনেমা এভাবেই চলেছে। পরিস্থিতির কারণে এদেরকে এভাবে সিনেমা করতে হয়েছে। বলা যায়— এগুলো সময়ের দাবি ছিল। 

রাইজিংবিডি: দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে দর্শকের অজস্র ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। জীবনের এ পর্যায়ে আপনার কোনো অপ্রাপ্তি আছে কিনা?

ডলি জহুর: আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। তবে এটা সত্যি একজন শিল্পীর কখনো অভিনয়ের তৃষ্ণা-ক্ষুধা মেটে না। আর এই ক্ষুধা আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকবেই। যত দিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন মনে হবে এই চরিত্র আমি করিনি! কিংবা এরকম করতে পারলে ভালো হতো। এই তৃষ্ণা-ক্ষুধা প্রত্যেক শিল্পীর মাঝে থাকে, আমারও আছে। আমি অভিনয়শিল্পী আমাকে সবাই চেনে, আমি যে দর্শকের মনের ভেতর ঢুকতে পেরেছি- এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

অস্ট্রেলিয়ায় ছেলে-বউমার কাছে গেলে আমি বলি, দেখ এখানে আমাকে কেউ চেনে না। এখানে আমি তোমাদের মা-শাশুড়ি। কিন্তু বাংলাদেশে আমি ডলি জহুর। এত বছর কাজ করে আমি যে ডলি জহুর হতে পেরেছে এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। এটাই আমি চাই। আমি ডলি জহুর হিসেবে মারা যেতে চাই। আমি যদি অস্ট্রেলিয়াতে মারা যাই কেউ আমার খবর নেবে না। তাহলে আমি কেন অস্ট্রেলিয়াতে শুধু শুধু বসে থাকব! বলতে পারো আমি স্বার্থপরের মতো কথাগুলো বলছি। কিন্তু তা না। কারণ প্রত্যেকটি মানুষ চায় তার কর্মক্ষেত্রে নামডাক হোক, ভালো একটি দিক প্রকাশ পাক। একজন মুসলমানের মৃত্যুর পর তার ভালো দিক নিয়ে মানুষ কথা বললে আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেন, দেখো, আমার বান্দাকে সবাই ভালো বলছে। তখন আল্লাহ তাকে নাম্বার দেন। আমি আমার ভালো দিকটা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। এটা সবারই করা উচিত।    

রাইজিংবিডি: এবার ঈদের নাটকে অভিনয় করেছেন?

ডলি জহুর: ঈদের যে ক’টি নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছি, সেসব নাটকের চরিত্রে আমার তেমন কিছু করার নেই। গল্পে মা থাকতে হবে তাই। ঈদের সময়ে মানুষ ভালো কিছু দেখতে চায়। মানুষ এ সময় মন দিয়ে টিভি দেখতে বসে। আর সেখানে শুধু থাকার জন্য থাকব তা হয় না। এজন্য এড়িয়ে গিয়েছি। এছাড়া আরো দুটো নাটকের শুটিং বিদেশে গিয়ে করতে বলেছিল।  কিন্তু আমি বিদেশে যেতে চাইনি। কারণ ওই সময়ে আমার প্রেসারটাও (উচ্চ রক্তচাপ) বেশি ছিল। একটু খাটাখাটনি করলে, ঘুম ঠিকমতো না হলেই প্রেসার সমস্যা করে। এছাড়া আমার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। আসলে বিশ্রামে থাকব বলে এ দুটো কাজ করতে চাইনি। 

রাইজিংবিডি: ঈদুল ফিতর কোথায় উদযাপন করছেন?

ডলি জহুর: আমি বাংলাদেশেই আছি। রোজার আগেই ছেলে অস্ট্রেলিয়া যেতে বলেছিল; ওদের সঙ্গে রোজা ও ঈদ পালন করতে বলেছিল- যাইনি। ছেলে বললো, আম্মা তোমার গরমে কষ্ট হবে না? আমি বললাম, কাজ তো করছি না, ঘরেই থাকব কষ্ট হবে না; চিন্তা করো না। তা ছাড়া প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে চার-পাঁচবার ভিডিও কলে কথা বলছি। অসুবিধা নেই। 

 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়