ঢাকা     মঙ্গলবার   ২১ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১

বাংলাদেশের কায়কোবাদ

ড: ফারজানা আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২০, ৩০ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১২:৪৪, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
বাংলাদেশের কায়কোবাদ

অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও শিক্ষক

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা অতি স্বল্প উৎসাহে অল্প বিনিয়োগে অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যে অবিশ্বাস্য রকম মেধাবী, এটা যে অল্প কয়েকজন শিক্ষক চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম কম্পিউটার বিজ্ঞানী অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। আমরা সাধারণত দেখি, সব ভালো ছাত্রদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আছেন। বিশ্বের যেখানে যেখানে অধ্যাপক কায়কোবাদের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিষ্ঠিত আছেন, লাল দাগ দেয়া হলে পুরো ভূগোলকই লালে লালে ভরে যাবে। তিনি পরম শ্রদ্ধেয়। কিন্তু সে জায়গায় থাকতে তিনি সম্ভবত অস্বস্থি বোধ করেন। তাঁর যত কথা যত লেখা-  সবখানেই তিনি অন্যের উপর আলো ফেলার সবরকম চেষ্টা করে গেছেন। প্রশংসা করতে কোন পয়সা খরচ হয় না তবু এই ব্যাপারে বিশেষ করে বাঙালির কার্পণ্যই বেশি দেখা যায়!

অধ্যাপক কায়কোবাদ অবিশ্বাস্য রকম ব্যতিক্রম! একটি গোটা জীবন তিনি মেধাবীদের গুনগান করে কাটিয়ে দিলেন। যেই সময়ে বিনয়কে দুর্বলতা হিসাবে ধরা হয়, সেই সময়ে তিনি যেকোন অবস্থানের মানুষের মধ্যে বিনয় দেখলে তার যথাযথ মূল্যায়ন করেন। বলা যায় অতি-মূল্যায়ন করেন কারন বিনয়ের বড় আকাল আজকাল। একজন বিজ্ঞানী হিসাবে বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ক অনেক বই লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ‘মেধাবী এবং বিনয়ী মানুষের গল্প’। বই পড়ে বোঝা যায়, মেধার সঙ্গে যখন বিনয়ের সংমিশ্রণ ঘটে, ব্যক্তিত্ব অন্য মাত্রায় চলে যায়, তখনই মানুষ হয়ে যান আদর্শ এবং অনুকরণীয়। 

পুরো জাতিকে এরকম আদর্শ এবং অনুকরণীয় করে তোলার জন্যই কোমল ছাত্রদের নিয়ে তাঁর এই প্রয়াস। অনুপ্রেরণা দেবার জন্য যেমন গল্প করেন কালজয়ী ইতিহাস থেকে নেয়া  বড় বড় পুরষ্কার বিজয়ী বিজ্ঞানীদের তেমনি আমাদের দেশের মাটির প্রদীপরাও মাথা উঁচু করে তাঁর লেখায় অবস্থান করছেন। তাঁর সাথে অল্প কিছুক্ষণ গল্প করার সুযোগ পেলে নিশ্চিতভাবেই অপরিণত অলস ক্ষীণদেহী বাচ্চার বাকজড়তা নিয়ে আইজ্যাক নিউটন হয়ে উঠার গল্প কিংবা আত্মভোলা, স্কুল থেকে বহিষ্কৃত দুর্বল মেধার বালকের মহামেধাবী আইনস্টাইন হয়ে উঠার গল্প এসে পড়বে। সেই গল্প শুনলে যেকোনো শিশু কিশোরের মনে হবে- যতই চড়াই উৎরাই থাকুক, বিশ্ববরেণ্য আবিষ্কার করা কোন ঘটনাই না। বাংলাদেশের অগণিত   নবীন এমনকি অনেক  প্রবীণদেরও ভরসার জায়গা অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, তাঁর জীবনদর্শন, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ এবং স্বপ্নকে আর কেউ এতো পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ আছে। 

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর ক্ষুরধার স্মৃতিশক্তির বিস্তারিত এবং নিখুঁত বর্ণনা এই প্রয়াত দেশবরেণ্যকে একটি আলাদা উচ্চতায় চিনতে শেখায়। বাংলাদেশ গনিত অলিম্পিয়াড, ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাগুলো নিয়ে দাবদাহ, শী্‌ত, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়ান, যতভাবে সম্ভব উৎসাহ দেন। উদ্দেশ্য- যদি একটি ছাত্রের জীবনও বদলায়, একজনও নতুন স্বপ্ন দেখে কিংবা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, মন্দ কি! একজন নয়, শতসহস্রও নয়, যুগে যুগে কতো অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবনে তিনি জাদুর কাঠি বুলিয়ে আমূল বদলে দিয়েছেন, তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা এখন আর সম্ভব নয়, নানান দেশে মিশে যাওয়া তাদের আর আলাদা করা যাবে না। শুধু বিশ্ববরেণ্যরাই নয়, নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়া রান্নার মেয়েটি যে মানুষ হিসাবে কতো গুণী এবং উন্নতমানের, তার বর্ণনা আমরা বহুবার শুনেছি।

রসায়ন কেবল ল্যাবেই থাকে না। মানুষের সাথে মানুষ, জীবনের সাথে জীবন যোগ হওয়ার মাধ্যমেও নতুন নতুন রসায়ন তৈরি হয়। বিশিষ্ট শিল্পপতি পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমানের সাথে তাঁর কর্মসূত্রেই পরিচয়। একজন বিজ্ঞানীর সাথে এখন সুফির সম্পর্কের ফলে একটি নতুন মাত্রার দর্শন তৈরি হয়েছে। 

আজকের বাংলাদেশে দুঃখজনক ভাবে অর্থ বিত্ত, ব্যাবসার সঙ্গে মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা এবং সমাজকল্যাণের একটি নেতিবাচক সম্পর্ক দেখা যায়। ব্যাবসা যেন শুধুই ব্যাক্তিগত মুনাফালোভের আরেক নাম। ব্যাবসা যে মানবকল্যানের একটি মাধ্যম হতে পারে, ধনী গরীবের মধ্যে ভেদাভেদ কমাতে পারে, সুবিধাবঞ্চিতদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে, পাশাপাশি মুনাফাও ঠিক রেখে সেবা এবং সুনাম অব্যাহত রাখতে পারে - তা মানুষ ভুলতে বসেছিল। কায়কোবাদ-সুফি মিজানুর রহমান রসায়ন লক্ষ লক্ষ ছাত্রকে শিখিয়েছে কি করে মাটির মতো বিনয়ী থেকেও আকাশের মতো অসীম এবং মহান হওয়া যায়, অনায়াসেই। 

মানবিক গুনাবলি বহির্ভূত মানুষ কিছুতেই পরিপূর্ণ মানুষই নন কিন্তু এর চর্চা দেশে নেই বললেই চলে। এই কঠিন সময়েও বিজ্ঞানের পাশাপাশি দেশপ্রেম, মানবিকতা, মূল্যবোধের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন সবার প্রিয় কায়কোবাদ স্যার। তিনি সবার গুণাবলীর কথা বলেন, লেখেন, প্রচার করেন। বলেন না কেবল নিজের কথা। পহেলা মে তাঁর জন্মদিন। সেই দিনটি সমাগত। আমি নিশ্চিত- তাঁর কাছে জন্মদিনটিও আরেকটি নতুন দিন মাত্র, তাঁর ব্যাক্তিগত পর্যায়ে কোন বিশেষ অর্থ থাকবে না। তাঁর মতো মানুষদের থাকে ও না। A Great man is always willing to be little ।

/লিপি

সর্বশেষ