ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি
রণজিৎ সরকার || রাইজিংবিডি.কম
রণজিৎ সরকার : সবার আছে প্রিয়-অপ্রিয় শব্দ। আমারও আছে প্রিয়-অপ্রিয় শব্দ। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে অপ্রিয় ‘বিরক্ত’ শব্দটা শোনার পর থেকে মনটা খারাপ। ভীষণ মন খারাপ আমার।
কেউ বুঝতে পারে না যে আমার মন খারাপ। কারণ যাকে আপন ভেবে কথাগুলো বলব, সে-ই হয়তো সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। আমার ক্ষতি করবে। এই রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের চারপাশে। তাই কাউকে নিজের ব্যক্তিগত কথা বলি না। না বলে নিজের মনের সঙ্গে নিজে নিজেই কথাগুলো অনুভব করি। নিজের মনের ভেতর কবর দিয়ে রাখি দুঃখ-কষ্ট-বেদনার অনুভূতি।
প্রিয় মানুষটির সঙ্গে যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি দেখা হয়েছিল আমার, সে জায়গায় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি। তার কথা একটু বেশি মনে পড়েছে আমার। মনের ভেতর নাড়া দিচ্ছে সুখময় স্মৃতি।
ক্রিকেটের ভাষায় যাকে বলে অ্যাকশন রিপ্লে : ভারতের ব্যাটসম্যানরা যেমন মুস্তাফিজুর রহমানের বলে একে পর এক আউট হওয়ার পর ম্যাচ শেষে বারবার রিপ্লে দেখেছেন, এই বলটা এই রকম খেলা উচিত ছিল। এই বলটা খেলা উচিত ছিল না। আমিও তেমন করে ভাবলাম, প্রিয় মানুষের সঙ্গে এইভাবে মিশলে সে খুশি হতো। ওর মতো করে মিশলে হয়তো খুশি হতো। আমিও খুশি হতাম। সব হিসাব করছি। কেন সম্পর্ক নষ্ট হলো। নানা স্মৃতি তাড়া করছে আমাকে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকের মানুষ দেখছি।
উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে। তার হাতে ফুল। গোলাপ ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির হাতে গোলাপ দেখে আমার ভালো লাগল। কারণ ফুলের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা আমার। বিশেষ করে গোলাপ।
এগিয়ে যেতে লাগলাম। মেয়েটিও এগিয়ে আসতে লাগল। সে আবার দাঁড়াল। এদিক-ওদিক তাকাল। ভাবলাম, আর সামনের দিকে যাব না। মেয়েটি তো এই দিকে আসবে। আমি দাঁড়ালাম। মেয়েটি ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? কার জন্য। আমার জন্য তো নয়, এটা নিশ্চিত। কারণ মেয়েটি আমার পরিচিত নয়। তবু তার হাতে ফুল দেখে মনে হলো, আমার জন্য যদি কেউ ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
একটু পর। মেয়েটি ফুল নিয়ে আবার এগিয়ে আসতে লাগল। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটি আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি অবাক হলাম। মেয়েটির দিকে তাকালাম না। অন্যদিকে তাকিয়ে গাছে বসা দুটো জোড়া পাখি দেখছি। মেয়েটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোনো কথা বলছি না আমি। মেয়েটিও বলছে না কোনো কথা। ভাবলাম, তার কাছে যে আসার কথা ছিল, সে হয়তো এখনো আসেনি। আমার সঙ্গ চাচ্ছে। হয়তো বা কিছু জানতে চাচ্ছে আমার কাছ থেকে। আমি কিছুই বলছি না। মেয়েটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর চলে যেতে লাগল। তারপর তার দিকে তাকালাম। দেখতে পেলাম, মেয়েটির এক হাতে ফুলের মালা, অন্য হাতে কাগজ-কলম। কাগজ-কলম দেখে অবাক হলাম।
মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছে। আমিও তার পেছন পেছন হেঁটে যেতে লাগলাম। কাগজ-কলমের রহস্যটা জানতে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি পেছনের দিকে তাকাল। আমি দাঁড়াল। ভাবলাম, মেয়েটি বিরক্ত হয়ে আমাকে বকা দেবে। কিন্তু না, সে হেঁটে যেতে লাগল। আমিও হাঁটা শুরু করলাম।
মেয়েটি হঠাৎ দাঁড়াল একটা গাছের নিচে। আমিও দাঁড়ালাম। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি। হঠাৎ মেয়েটি আমার সামনে এল।
আমার দিকে তাকাল। আমিও তাকালাম। আমার তাকানো দেখে সে অনেক খুশি হয়েছে, বুঝতে পারলাম তার মুখ দেখে।
অবশেষে মেয়েটিকে বললাম, ‘ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কেউ আসবে?’
মেয়েটি কথা বলে না। আমি অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম, বেশি কিছু বলে ফেললাম না তো!
মেয়েটি ফুলগুলো ঘাসের ওপর রাখল। তারপর খাতা-কলম হাতে নিল। তারপর খাতায় লিখল, ‘আমি কথা বলতে পারি না। আপনার কথা বুঝতে পারছি। আমি ফুল বিক্রি করি।’
মেয়েটির লেখা পড়ে অবাক হলাম। আসলেই কি সত্যি! নাকি ফুল বিক্রি করার একটা অভিনব পদ্ধতি। আমি বেশি কিছু না বলে বললাম। বাকপ্রতিবন্ধীরা কানে কম শোনে বা শোনেই না। তাই জোরে জোরেই বললাম। একটা ফুলের দাম কত?
মেয়েটি খাতায় লিখল, ‘দশ টাকা।’
আমি একটা ফুল নিলাম।
মেয়েটি লিখল, ‘কাকে দেবেন ফুল?’
বললাম, একজন ছিল। তার সঙ্গে এখানে মাঝে মাঝে দেখা হতো। কিন্তু এখন সে আমার নেই। আমার সবকিছু তার বিরক্ত লাগে। কথা হয় না, যোগাযোগ নেই।
মেয়েটি লিখল, ‘কেন?’
বললাম, সে অনেক কথা। তবে একটু বলি, তার কথা ভাবতে ভাবতে দিন-রাত কেটে যায় আমার।
মেয়েটি লিখল, প্রকৃত ভালোবাসার এটাই নিয়ম।’
বললাম, তাই?
মেয়েটি খাতার অন্য পৃষ্ঠায় লিখল, ‘হ্যাঁ।’
মাটিতে রাখা ফুল হাতে নিয়ে বললাম, আপনার সবগুলো ফুল নিতে চাই।
মেয়েটি লিখল, ‘আপনার তো দেওয়ার মানুষ নেই, এই পার্কে। কাকে দেবেন?’
বললাম, আমার প্রিয় মানুষটির স্মৃতির উদ্দেশে রেখে দেব এখানে।
মেয়েটি লিখল, ‘সত্যি আপনি তাকে এত ভালোবাসেন?’
কিছু না বলে ফুলগুলো আমরা আগে সেখানে বসতাম, সে জায়গায় রাখলাম। হঠাৎ রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হলো। ফুলগুলোর ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। তাকিয়ে দেখছি। মোবাইল ফোনে বৃষ্টিভেজা ফুলের ছবি ওঠালাম। এবার শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৫/কমল কর্মকার
রাইজিংবিডি.কম