বন বিভাগের প্রাণী সংরক্ষণের ক্ষমতা নেই- ড. রেজা খান
তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম
ড. রেজা খান
নিসর্গসেবী, পাখিপ্রেমী, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অনেক পরিচয়েই ড. রেজা খানকে বিশেষায়িত করা যায়। দীর্ঘদিন তিনি লুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করছেন। পরিবেশগত বিপর্যয়ের এই কঠিন সময়ে আমরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম এ থেকে উত্তরণের উপায়, লুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণে করণীয় এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ে। বর্তমানে তিনি দুবাই চিড়িয়াখানায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। সেখান থেকে তিনি রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন লুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এবং এ জন্য জনসচেতনতা গড়ে তুলতে সরকারের করণীয় বিষয়ে। ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো তার বক্তব্য রাইজিংবিডি’র পাঠকদের উদ্দেশে প্রকাশিত হলো।
তাপস রায় : অনেক পরিচয়েই আপনি পরিচিত। প্রকৃতির প্রতি এই যে ভালোবাসা এর শুরুটা কীভাবে হলো?
ড. রেজা খান : আমি সঠিকভাবে জানি না। বেশ ক’জন স্বনামধন্য শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি মনে করি তাদের মাধ্যমেই এর সূচনা। শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন সময় আমি তাদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম। যেমন এইচএসসি’র সময় শিক্ষাগুরু অধ্যাপক কালী নারায়ণ রায়, বিএসসি অধ্যয়নকালীণ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা এবং এমএসসি পড়ার সময় অধ্যাপক কাজী (মোহাম্মদ) জাকের হোসেন স্যারের অনুপ্রেরণা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণীয়। এরপর ডক্টরেট ডিগ্রীর সময় মহান ভারতীয় পাখিবিষারদ ড. সালীম আলীর সঙ্গে গবেষণা-কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ে কাজের প্রতি তার প্রাণভরা দরদ, উদ্দীপনা আমার জীবনে অনুঘটকের কাজ করেছে।
তাপস রায় : আপনার ছেলেবেলা কোথায় কেটেছে?
ড. রেজা খান : জন্মের পর থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ঢাকার ধামরাই থানার বালিয়ার বড় বাড়িতে কেটেছে আমার শৈশব। হাই স্কুল এবং এইচএসসি’র সময়টা কেটেছে মানিকগঞ্জ শহরে। এরপর ১৯৬৬ সাল থেকে ঢাকায়।
তাপস রায় : পাখির প্রতি আপনার আলাদা ভালোবাসা রয়েছে। এ দেশের পাখির বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো কী?
ড. রেজা খান : ১৯৭৭ সালের ঘটনা। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীণ ব্রিটিশ হাই কমিশনার ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন, কয়েক বছরের ঢাকা অবস্থানকালে তিনি তার গুলশানের বাসার উঠোনেই ৫০-৬০ প্রজাতির পাখি দেখেছেন। এ থেকেই বুঝা যায় বাংলাদেশ পাখির জন্য কতো বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি এলাকা। মোটে ১,৪৪,০০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখির বসবাস। এটি দারুণ খবর বৈকি! সমমানের ইউরোপীয় অনেক দেশেই এতো প্রজাতির পাখি নেই। তবে ১৯৬০ থেকে ৭০-এর দশকে দেশে পাখির যে ছড়াছড়ি ছিল তা আর এখন নেই। সংখ্যাটা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। এ দেশে এখন পতিত ভিটেবাড়ি, জমি, ঝোঁপঝাড় এবং দেশের সব প্রাকৃতিক বন কেটে সেখানে বনবিভাগ সৃষ্ট বন বাগান হচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে ফলের গাছের পরিবর্তে কাঠ ও জ্বালানীর জন্য গাছ রোপণ করা হচ্ছে। দেশে ব্যাপকহারে জনসংখ্যা ও তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেশির ভাগ জমি মানুষের ঘরবাড়ি, শহর-বন্দর এবং কৃষি জমিতে ভরে গেছে। এ কারণে পাখি ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে এবং কমছে। আগামী ২-৩ দশকে এদের হালহকিকত কী হবে কে বলবে! সম্ভবত মানুষের সহচার্যে বসবাস করতে পারে না এমন সব প্রাণী দেশ থেকে বিলীন হবে বা পাশের দেশে চলে যাবে কেবল সুন্দরবন বাদে বাকি সব এলাকা থেকে।
তাপস রায় : আমরা ‘অতিথি পাখি’ বলছি। এটা কতটা যুক্তিযুক্ত?
ড. রেজা খান : পৃথিবীতে কোথাও কোনো অতিথি পাখি নেই। অতিথি, স্বজন, আপন-পর, সুহৃদ, মেহমান, মেজবান, মানুষ সৃষ্ট মানুষের কাজে ব্যবহারের জন্য কিছু শব্দমালা। তবে প্রকৃতিতে পরিযায়ী বা মাইগ্রেটরি পাখি ও অন্য প্রাণী আছে।
দেশে যে ৭০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে এদের শতকরা ১০০ভাগ বাংলাদেশী পাখি। এর মধ্যে কেউ অতিথি নেই। সবাই মেজবান, কেউই মেহমান নয়। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে পাখিরা বছরের কিছু সময় আমাদের দেশে এবং বাকি সময় হিমালয় এবং তার আশপাশের এলাকা থেকে সুদূর সাইবেরিয়া পর্যন্ত যে কোনো এলাকায় কাটাতে পারে। এদের জন্য আমাদের দেশের পরিবেশ পাখি-বিমুখ না হলে এবং আমরা সহৃদয় হলে পাখিরা সাংবাৎসরিক আমাদের এলাকায় আসবে। তবে আমাদের এবং সাইবেরিয়ার মধ্যের দেশসমূহে যদি পরিবেশের গুণগত পরিবর্তন হয় তাহলে পাখির এই সাংবাৎসরিক আসা-যাওয়ায় বাঁধার সৃষ্টি করতে পারে।
আমাদের দেশের কোনো পাখি কী অন্য কোনো দেশে অতিথি হয়?
না, অন্য দেশে পরিযায়ন করে। যেমন অনেকেই অন্য দেশ থেকে আমাদের দেশে আসে। অতিথি শব্দটি মানুষের বেলায় সাজে, বন্য প্রাণীর বেলায় নয়। পাখির কিছু দল পরিযায়ী হয়।
তাপস রায় : পরিবেশ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। আমরা পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আমরা কাকে দায়ী করব?
ড. রেজা খান : অবশ্যই এ জন্য আমরা নিজেদের দায়ী করব। সেইসঙ্গে সরকারকে, বিশেষ করে বন বিভাগকে যারা জোর করে দেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছে। যদিও তাদের দেশের বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের কোনো ক্ষমতা বা পরিকল্পনা নেই। যা আছে তা কাগুজে, অপরিকল্পিত ও অবাস্তব।
তাপস রায় : দেশের বেশ কিছু বন্য প্রাণী প্রজাতি ও বুনো উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে। এগুলো সংরক্ষণের জন্য আমরা কী করতে পারি, সরকারের কাজটাই বা এখানে কী?
ড. রেজা খান : দেশে নতুন করে একটি আলাদা জীববৈচিত্র্য বা বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগ সৃষ্টি করতে হবে। বন বিভাগের কাজ বন কাটা ও বাণিজ্যিক গাছ লাগানো। বন্য প্রাণী বিভাগের কাজ হবে কোনো গাছ না কাটা এবং সব বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা। এ বিভাগ পরিচালিত হবে বন্য প্রাণী বিশারদ এবং এ বিষয়ে আগ্রহী অন্য গবেষকদের দিয়ে। দেশে বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক যত এলাকা আছে- সুন্দরবন, সব হাওর এলাকা, চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক, ইকো পার্কসহ কম করে হলেও ১০ থেকে ১২ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা কাগজে কলমে লিখে দিয়ে পুরো ব্যবস্থাপনা ন্যস্ত করতে হবে এ বিভাগের উপর। নতুন বিভাগটি দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চতর ডিগ্রী, মাদ্রাসা ও অপরাপর দেশীয় বাংলা, ইংরেজি, আদিবাসী এবং আরবি শিক্ষার সিলেবাসে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক কার্যক্রম রাখবে। এর বাইরেও তারা দেশব্যাপী প্রকৃতি ও পরিবেশ বা বন্য প্রাণীর বন্ধু নামে এনজিও ব্যবস্থা চালু করবে বা এসবের সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনগণকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করাও তাদের কাজের অংশ হবে।
তাপস রায় : বন্য প্রাণী সংরক্ষণে জনসচেতনতা বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন?
ড. রেজা খান : স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, আদিবাসীসহ সব বিদ্যাপীঠে এ বিষয়ে পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে। এর সঙ্গে বন্য প্রাণী বিষয়ক বন্ধু চক্র এবং গ্রামে গ্রামে, বনের পাশে, বনের ভিতরে সব জনগোষ্ঠীকে এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যসব উপাসনালয়ের অধিকারীদের এ কর্মসূচিতে যুক্ত করতে হবে। দেশের সব প্রফেশনাল সমিতি ও এনজিওদের এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন সঠিকভাবে রচনা করে তা দারুণভাবে বলবৎ করতে হবে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সুফল হিসেবে এর উপর সরাসরি নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বিশেষ ক্যাডার ও বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা সার্ভিস ছাড়া বাকি সব পদে বনের আদিবাসী এবং বনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর নিয়োগ আইন করে নিশ্চিত করতে হবে।
সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এলাকার আহরিত সম্পদ ও ইকোট্যুরিজম ব্যবস্থায় অর্জিত সম্পদ কেবল এর উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ভিতরে বিতরণ বা সহজ মূল্যে সরবরাহ করতে হবে। এ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে যাবে না।
তাপস রায় : রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কথা হচ্ছে। এ থেকে আমরা কতটা উপকৃত হবো? ক্ষতিই বা কতটুকু হবে?
ড. রেজা খান : ক্ষতির বিষয়টি সরকারি অনাগ্রহ বা অন্য কোনো মহলের চাপে না পড়ে ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সংস্থা বাদে অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে নির্ণয় করা দরকার ছিল বা এখনও আছে। এমন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে আশপাশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য কতটা ক্ষতির সম্মুখীন হবে বা নিকট ভবিষ্যতে হতে পারে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা প্রয়োজন। এর ফলে সুন্দরবনের যদি যৎকিঞ্চিৎ ক্ষতিও হয় তা পুষিয়ে নিতে শতাধিক বছর লেগে যেতে পারে। বা এমনও হতে পারে সে ক্ষতি একেবারেই অপূরণীয়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ অগাস্ট ২০১৪/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম