ঢাকা     শুক্রবার   ০৩ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২০ ১৪৩১

বাবার ছবি বুকে নিয়ে ঘুমাতে যায় সাফরান

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪১, ৯ নভেম্বর ২০২২  
বাবার ছবি বুকে নিয়ে ঘুমাতে যায় সাফরান

আনিসুল করিম শিপন। ছবি সংগৃহীত

বাবা আনিসুল করিমের মৃত্যুর সময় একমাত্র সন্তান মো. সাফরান করিমের বয়স ছিলো তিন বছর। এখন সে ৫ বছরের শিশু। বাবাকে কাছে পায় না। তাই সাফরান বাবার ছবি বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে যায়। অবুঝ শিশুর আবদার রাখতে গিয়ে প্রতি রাতেই স্বামীর জন্য চোখে পানি ঝরান শারমিন আক্তার। দিনের পর দিন এই অসহ্য যন্ত্রণা তার সঙ্গী।

এএসপি আনিসুল করিম ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর হত্যার শিকার হন। এরপর থেকে ছেলেকে নিয়ে অন্যরকম এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে শারমিন আক্তারের। শত ব্যস্ততার মাঝেও স্বামী হত্যার বিচার নিয়ে সোচ্ছার তিনি। আইনের লোক হয়েও আনিসুল করিমের বিচার বিলম্বিত হওয়ায় তিনি কিছুটা ক্ষোভও প্রকাশ করেন। 

এদিকে, ছেলে সাফরান সব সময় বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। সে এখন স্কুলে যায়। প্রায় সময়ই মাকে প্রশ্ন করে, সবার বাবা আসে, তার বাবা কেন আসে না। তখন শারমিন আক্তার আঁচলে মুখ ঢেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে সন্তানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তোমার বাবা আর আসবে না।’

উল্লেখ্য, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভর্তির কিছুক্ষণ পর ওই হাসপাতালের কর্মচারীদের ধস্তাধস্তি ও মারধরে আনিসুল করিমের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বাদী হয়ে আদাবর থানায় হত্যা মামলা করেন।

গত ৮ মার্চ এ মামলায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. ফারুক মোল্লা।

তবে এ মামলায় এজাহারে ডা. নুসরাত নামে একজনকে আসামি করা হয়নি। কিন্তু মামলার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন তিনি। তবে চার্জশিটে তার নাম আসেনি। এএসপি আনিসের পরিবারের ধারণা, নুসরাত ঘটনার সাথে জড়িত না হলে কেন তিনি আগেই জামিন নিবেন। এজন্য মামলাটি পুনরায় তদন্তের আবেদন করেন আনিসের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ। আদালত তা মঞ্জুর করেন। আদালত মামলাটি পিবিআইকে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে। 

সর্বশেষ গত ২ নভেম্বর মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন পিবিআই প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রশিদুল আলমের আদালত আগামী ৩০ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।

মামলা সম্পর্কে আনিসুল করিমের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘দুই বছর আগে আনিসুলকে হত্যা করা হয়। বিচার শেষ হয়নি। এখনো তদন্ত চলছে। পিবিআই তদন্ত করছে। এখনো কোনো রেজাল্ট হলো না। যদিও আমি এখন একজন সাধারণ মানুষ, তবে আমার স্বামী তো আইনের লোক ছিলেন। কিন্তু এখনো বিচার হলো না। অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচার হবে কি না সেটা নিয়ে সন্দিহান।’

তিনি বলেন, ‘সময়টা এখন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আনিস বেঁচে থাকা অবস্থায় চাকরি করতে হয়নি। এখনো চাকরি করতে হচ্ছে।  আনিস নভেম্বরে মারা যায়। আমি এপ্রিলে চাকরিতে জয়েন্ট করি। যদিও পুলিশের সহযোগিতায় পুলিশ কমিউনিটি ব্যাংকে চাকরিটা হয়েছে। বাচ্চাকে বাসায় রেখে অফিসে যাই। আমার বাবা-মায়ের কাছে সাফরান থাকে।’

মো. সাফরান করিম বাবাকে অনেক মিস করে উল্লেখ করে শারমিন আক্তার বলেন, ‘প্রতিদিন ঘুমানোর আগে বাবার ছবি দেখে সে। ছবি ছাড়া ঘুমায় না। বাবার ছবি বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে যায়। ও জানে ওর বাবা আর আসবে না। তারপরও বাবাকে নিয়ে নানা আবদার করে। আবার নিজেই বলে, বাবাকে তো আল্লাহ নিয়ে গেছে। সাফরান এখন স্কুলে যায়। স্কুলে যখন ওর বন্ধুরা বাবাকে নিয়ে কথা বলে তখন ওর খুব খারাপ লাগে। আমি তো চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকি সময় চলে যায়।  কিন্তু ও তো বাসায় সে সময় ফ্রি থাকে, সারাক্ষণ বাবাকে নিয়ে ভাবে। মাঝে মধ্যে ওকে শান্ত্বনা দিতে হিমশিম খেতে হয়।’

ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চান শারমিন আক্তার। আনিসুল হকের বাবা ফাইজুদ্দিন আহমেদ বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। দুই বছর ছেলেকে ছাড়া কেমন করে যে সময় যাচ্ছে বলা যাবে না। চার ভাই-বোনের মধ্যে ও ছিলো সবার ছোট। সবার আদরের। সেই ছেলেটাকে ওর খুন করলো। ছেলেটা মেধাবী ছিল। ওকে নিয়ে অনেক আশা ছিল। তা আর পূরণ হলো না। যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চান অবসরপ্রাপ্ত এ পুলিশ কর্মকর্তা।

আনিসুল করিমের বাবার মামলাটি তদন্ত করে আদাবর থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. ফারুক মোল্লা গত ৮ মার্চ চার্জশিট জমা দেন। 

অভিযুক্তরা হলেন-জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন, মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক আরিফ মাহামুদ, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন, হাসপাতালের সমন্বয়ক রেদোয়ান সাব্বির, হাসপাতালের কর্মচারী মাসুদ খান, জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম কুমার পাল, লিটন আহম্মেদ, সাইফুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ আল মামুন।

মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ মারা যাওয়ায় মামলা থেকে তাকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়।

এদিকে পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে বলা হয়েছে, মধ্যযুগীয় কায়দায় আনিসুলকে আঘাত করা হয়েছিল। মাইন্ড এইড হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় অপেশাদার লোকদের দিয়ে আনিসুলের দুই হাত পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর আসামিরা ঘাড়ে, বুকে, মাথায় আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

/মামুন/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়