ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তিতাসের

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৭, ১৬ মে ২০২৩   আপডেট: ১২:৩১, ১৬ মে ২০২৩
আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তিতাসের

দেশে চলছে গ্যাস সংকট। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আবেদন করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এক চুলার  ১৩৭৯ টাকা  এবং দুই চুলার (ডাবল বার্নার) ১৫৯১  টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।

তিতাস সূত্রে জানা গেছে, গত ২ মে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে তিতাস। প্রস্তাবে আবাসিকে মিটারবিহীন এক এবং দুই চুলার গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ৩৯ থেকে ৪৭ শতাংশ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয় । গ্রাহকরা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেন এমন দাবি করে মূল্যবৃদ্ধির আবেদন করা হয়ছে।  এক  চুলার ক্ষেত্রে একজন গ্রাহক প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫৫ ঘনমিটার এবং দ্বিমুখী চুলার ক্ষেত্রে ৬০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন এমন বিবেচনায় কমিশন সর্বশেষ গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করেছে। প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৮ টাকা হিসাবে বর্তমানে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের মাসিক বিল যথাক্রমে ৯৯০ ও ১০৮০ টাকা দিতে হয়। বর্তমানে মিটারবিহীন গ্রাহকের সংখ্যা ২৫ লাখ ২৫ হাজার। তিতাসের নতুন দাম কার্যকর হলে প্রতি মাসে তাদের বাড়তি আয় হবে ১২৮ কোটি টাকা।

আবেদনে আরও বলা হয়, গ্রাহকরা রান্নার পাশাপাশি গ্যাস ব্যবহার করে পানি ফুটায়। অনেক বাসায় সাবলেট ভাড়াটিয়া থাকে। এতে কমিশন নির্ধারিত গ্যাসের চেয়ে বেশি পরিমাণে গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা এক যুগ আগের একটি সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়েছে। তাদের দাবি, ২০০০-২০০১ অর্থবছরে রাজধানীর গুলশান, বনানী এলাকায় প্রায় ১০০ আবাসিক গ্রাহকের বাসায় স্থাপিত মিটারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্যাসের মাসিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮৭ দশমিক শূন্য ৫ ঘনমিটার এবং ১১২ দশমিক ৪২ ঘনমিটার।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিতাসের এ দাবি একেবারেই  অযৌক্তিক। গ্রাহকরা প্রতি মাসে ৪৫ থেকে ৫০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন, যা কমিশন নির্ধারিত পরিমাণের চেয়েও কম। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সর্বশেষ গণশুনানিতে এটি প্রমাণিতও হয়েছে। তাছাড়া, বর্তমানে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী ৪ সদস্যের একটি পরিবারে দুই চুলা এক হাজার টাকার গ্যাস দিয়ে গড়ে প্রায় দুই মাস চলে। অন্যদিকে মিটারবিহীন গ্রাহক গ্যাস  ব্যবহার করুক  বা নাই করুক, এমনকি কোনো মাসে এক দিনও চুলা না জ্বালালেও তাকে দুই চুলার জন্য প্রতি মাসে ১০৮০ টাকা গুণতে হচ্ছে। অনেক গ্রাহকের বাসায় আবার বেশির ভাগ সময়ই গ্যাস থাকে না। থাকলেও চাপ থাকে কম। মাসিক বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্যাসের স্বল্পতার এ বিষয়গুলো কখনোই আমলে নেওয়া হয় না।

তারা আরও বলেন, তিতাস দীর্ঘদিন ধরেই গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে আসছিল। এর আগে ৭৩ দশমিক ৪১ ঘনমিটার থেকে ৭৭ দশমিক ৩৮ ঘনমিটার গ্যাস হিসাব করে বিল নিত গ্রাহকের কাছ থেকে। সর্বশেষ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির শুনানিতে নানা যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়ায় কমিশন মাসিক গ্যাসের ব্যবহারের পরিমাণ কম বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করেছিল।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো সমীক্ষা ছাড়া মিটারবিহীন গ্রাহকের ক্ষেত্রে কমিশন যে মাসিক বিল নির্ধারণ করেছে, তাতে প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেম লস বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এক ও দুই চুলার গ্রাহকের মাসিক গ্যাস ব্যবহার যথাক্রমে ৫৫ থেকে বাড়িয়ে ৭৬ দশমিক ৬৫ ঘনমিটার ও ৬০ থেকে বাড়িয়ে ৮৮ দশমিক ৪৪ ঘনমিটার পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) বিইআরসির সাবেক সদস্য (গ্যাস) মোহাম্মদ মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, তিতাস কেন মাত্র ১০০ গ্রাহকের ওপর জরিপ করে দাবি করছে গ্রাহকরা বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন। তাদের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মিটারযুক্ত যে গ্রাহক রয়েছেন, তারা প্রতি মাসে মোট কত গ্যাস ব্যবহার করেন, সেটা হিসাব করলেই তো প্রকৃত হিসাব বের হবে । গণশুনানিতে তিতাসের হিসাবেই প্রমাণ হয়েছিল এক মাসে সর্বোচ্চ গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ ৪৫ ঘনমিটার। ভোক্তারাও যুক্তি এবং তথ্যপ্রমাণ দিয়ে এটা দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরাও এটা বিশ্বাস করি। তারপরও আমরা ৬০ ঘনমিটার করেছিলাম। কারণ একবারে বেশি না কমিয়ে তাদের একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। ধাপে ধাপে গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা ছিল কমিশনের। বর্তমান কমিশনও আগের তথ্যপ্রমাণ আমলে নিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে । তিতাসের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) গণশুনানিতে সবার সামনে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রতি মাসে কী পরিমাণ গ্যাস চুরি হচ্ছে তা তিনি নিয়মিত জানাবেন। কিন্তু পরে তিনি তা করেননি। তিতাস তো এখন আর চুরি করছে না, বরং তারা ডাকাতির ওপর ডাকাতি করছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন,  তিতাস   গ্রাহককে ঠকিয়ে মুনাফা করছে। গ্রাহক ঠিকমতো গ্যাস পান না। এরপরও তাদের ১২ পয়সা হারে গ্যাসের দাম বেশি দেওয়া হয়েছে। তাদের বিশাল নেটওয়ার্কে হাজার হাজার জায়গায় পাইপলাইন ছিদ্র হয়ে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। প্রায় ২৮ লাখ মিটারবিহীন গ্রাহককে নামমাত্র গ্যাস দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুণ্ঠন করছে। পাশাপাশি অবৈধ সংযোগের মাধ্যমেও টাকা আদায় করছে তারা। এভাবে তারা যে ধরনের একটা প্রাতিষ্ঠানিক লুণ্ঠনের প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেছে, এর কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি তিতাস গ্যাসের কাজ নয়, আমরা শুধু গ্যাস বিতরণ করি আর ১৩ পয়সা হারে মার্জিন পাই। যারা প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করে না তারা আনলিমিটেড গ্যাস ব্যবহার করে, বেশি পরিমাণ গ্যাস ইউজ করে। বিইআরসি প্রি পেইড মিটারে গ্যাসের ব্যবহার বিবেচনায় নিয়ে সিঙ্গেল বার্নারের জন্য ৫৫ ঘনমিটার আর ডাবল বার্নারের জন্য ৬০ ঘনমিটার বরাদ্দ করেছে। মানুষের জন্য প্রি-পেইড মিটার থাকে তখন তারা কনসাসলি অনেক কম গ্যাস ব্যবহার করে। মিটার যখন থাকে না তখন আনলিমিটেড গ্যাস ব্যবহার করে। আমরা কমিশনকে এটা বলার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, তিতাসের একটি প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব পাওয়া যায়নি। তিতাসের প্রস্তাবটির যৌক্তিকতা বিবেচনা করতে কমিশন সভায় উত্থাপন করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টির সুরাহা করা হবে।

ঢাকা/ইভা 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়