ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

যার জন্য বাড়ি ছাড়েন, তারই পরিকল্পনায় খুন হন আজহারুল

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৯, ১৭ মার্চ ২০২৩  
যার জন্য বাড়ি ছাড়েন, তারই পরিকল্পনায় খুন হন আজহারুল

আজহারুল ইসলাম (সংগৃহীত ছবি)

আজহারুল ইসলাম ও আসমা আক্তারের সম্পর্ক ছিল দেবর-ভাবি। তাদের মধ্যে পরকিয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঢাকায় এসে ১০ লাখ টাকা দেনমোহরে আজহারুলকে বিয়ে করেন আসমা। ঢাকায় আজহারুলের সঙ্গে থাকার সময়েই ৬০ বছর বয়সী এক ইমামের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ৩০ ববছর বয়সী আসমার। এ সম্পর্ক চালিয়ে যেতে স্বামীকে খুনের পরিকল্পনা করেন আসমা। ইমামকে দিয়ে খুনও করান স্বামী আজহারুলকে।

রাজধানীর দক্ষিণখানে ২০২১ সালের ২০ মে রাত ৯টার দিকে আসমা আক্তারের পরিকল্পনায় পোশাককর্মী আজহারুল ইসলামকে খুন করেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. আব্দুর রহমান। এ ঘটনায় আজহারুলের ভাই হাসান ২৬ মে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি আসমা ও আব্দুর রহমানকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার উপ-পরিদর্শক ফারুক মিয়া। চার্জশিটে আসমার তিন বিয়ে, অনৈতিক সম্পর্ক, স্বামীকে খুনের পরিকল্পনার আদ্যপান্ত তুলে ধরেন তদন্ত কর্মকর্তা।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলাটির তারিখ ধার্য ছিল। ওই দিন মামলাটি বিচারের জন্য মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।

আসমা ও আব্দুর রহমানের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেছেন মামলার বাদী আজহারুলের ভাই হাসান। তিনি বলেছেন, আসামিদের ফাঁসি ছাড়া আমাদের আর কোনো চাওয়া নেই।

তিনি বলেন, আগে আসমার একটা বিয়ে হয়েছিল। পরে আমার ভাই শাহাবুদ্দিনকে বিয়ে করে সে। আমার আরেক ভাই আজহারুল তখন পড়াশোনা করত। তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে ঢাকায় আসে আসমা। লজ্জায় ভাই গ্রামের বাড়িতে যেত না। ঢাকায় এসে এই ইমামের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করে আসমা। তারা (আসমা ও আব্দুর রহমান) আগেও একবার আমার ভাই আজহারুলকে হত্যার চেষ্টা করে। ভাগ্যক্রমে আজহারুল বেঁচে যায়। ভাইকে আবার গ্রামের বাড়িতে নিয়েছিলাম। আজহারুল আমাদের বলত, ইমামের সাথে আসমার পরকিয়া সম্পর্ক আছে। আমরা বিশ্বাস করিনি। তখন বিশ্বাস করলে ভাইকে হারাতে হতো না। আমরা এ ঘটনার সঠিক বিচার চাই। বিচার হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে অন্যরাও ভয় পাবে।

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা ফারুক মিয়া বলেন, আসমার প্রথম বিয়ে হয় জনৈক আবু তালেবের সাথে। এক দিন সংসার করার পর তাকে তালাক দেন আসমা। এরপর শাহাবুদ্দিনকে বিয়ে করেন। পরে শাহাবুদ্দিনের ভাই আজহারুলকে ঢাকা নিয়ে এসে বিয়ে করেন। ভিকটিম আজহারুল ইসলাম আসামি আসমা আক্তারের তৃতীয় স্বামী। তারা রাজধানীর দক্ষিণখানের সরদারবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। নামাজ আদায় করতে মসজিদে আসা-যাওয়ার কারণে আজহারুলের সঙ্গে মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমানের পরিচয় হয়। আজহারুলের ছেলে আরিয়ান খেলা করার জন্য মসজিদের সামনে আসলে আব্দুর রহমান তাকে বিভিন্ন সময়ে চকলেট কিনে দিতেন। ২০২০ সালের নভেম্বরে মসজিদের পাশে খেলার সময় পড়ে গিয়ে থুতনিতে আঘাত পায় আরিয়ান। আব্দুর রহমান সংবাদ পেয়ে তাকে দেখার জন্য কয়েকবার আজহারুলের বাসায় যান। এতে আব্দুর রহমানের সঙ্গে আসমার পরিচয় হয়। আজহারুল ও তার ছেলে আব্দুর রহমানের কাছে আররি পড়তে চান। আব্দুর রহমান জানুয়ারি থেকেই তাদের পড়ানো শুরু করেন।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আরবি পড়ানোর জন্য আব্দুর রহমান প্রায়ই আজহারুল ও আসমার বাসায় যাতায়াত করতে থাকেন। আজাহারুল বাসায় না থাকলেও আব্দুর রহমান ওই বাসায় যেতেন। আব্দুর রহমান ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত সরদারবাড়ি জামে মসজিদে ইমামতি করায় স্থানীয় লোকজন আব্দুর রহমানকে সম্মানের চোখে দেখতেন। বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করায় আসমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে আব্দুর রহমান বাসায় গিয়ে আসমাকে জড়িয়ে ধরেন। ওই সময় বাসায় ঢুকে আজাহারুল তা দেখে ফেলেন। আব্দুর রহমান বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর আজহারুল আসমাকে শাসন করেন। এর কয়েকদিন পর আব্দুর রহমান বাসায় গিয়ে আসমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে থাকেন। ওই সময় আজহারুল ঘরে ঢুকে তা দেখে ফেলেন। আব্দুর রহমান দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে যান। সেদিন আজহারুল আসমাকে বকাঝকা করেন এবং আসমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলেন। বিষয়টি আব্দুর রহমানকে জানান আসমা। আব্দুর রহমান গোপনে আসমাকে মোবাইল ফোন ও সিম কিনে দেন। ওই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গোপনে আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন আসমা।

আজহারুল বাসায় না থাকলে আব্দুর রহমান তার বাসায় গিয়ে আসমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে থাকেন। একপর্যায়ে আজহারুলের কারণে আসামিদের মধ্যে শারীরিক মেলামেশা বাধাগ্রস্ত হয়। আসমা তার স্বামীকে হত্যার বিষয়ে আব্দুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেন। আজহারুলকে হত্যা না করলে আব্দুর রহমানের মান-সম্মান নষ্ট করার হুমকি দেন আসমা। তারা আজহারুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, আজহারুলের খাবারের সঙ্গে টিকটিকি ও জামালগোটা ফল মিশিয়ে খাওয়ানো হবে, যেন পাতলা পায়খানা ও বমি হয়ে মারা যান আজহারুল। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ২০২১ সালে ১৩ রমজানে ইফতারির প্রায় দুই ঘণ্টা আগে আব্দুর রহমান চারটি টিকটিকি ও কিছু জামালগোটা ফল দিয়ে ভর্তার মত করে বাসায় নিয়ে আসেন এবং ওই ভর্তা আসমাকে দিয়ে বলেন, ভিকটিম খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে। ২০২১ সালের ১৩ রমজান রাতে ডাল ও অন্য তরকারির সঙ্গে তা ভিকটিমকে খাওয়ান আসমা। রাত সাড়ে ৯টার পর থেকে আজহারুলের পাতলা পায়খানা ও বমি শুরু হয়। রাত ১১টার সময় আজহারুলের অসুস্থতার কথা আব্দুর রহমানকে জানান আসমা। আব্দুর রহমান পরামর্শ দেন, আজহারুলকে যেন চিকিৎসকের কাছে না নেওয়া হয়।

আজহারুল ২-৩ দিন বাসায় থেকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বন্ধু ও প্রতিবেশীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ৩-৪ দিন তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। কিছুটা সুস্থ হলে বাসায় আসেন আজহারুল। ২৮ রমজান আজহারুলের ভাই হাসান এসে তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। আজহারুলের ছুটি শেষ হলে ২০২১ সালের ১৮ মে ঢাকায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নেন। আসমাও তার সঙ্গে ঢাকায় আসার বায়না করেন। তবে, তাকে বাড়িতে রেখে আজহারুল একাই ঢাকায় আসেন। আসমা বিষয়টি আব্দুর রহমানকে জানান। আজহারুলকে দ্রুত হত্যার ব্যবস্থা করতে বলেন আসমা।

পরিকল্পনা মোতাবেক ২০ মে আব্দুর রহমান একটি ডাব ও এক পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে আনেন এবং মসজিদে থাকা চাপাতি, ছোরা ও ছুরি ভালো করে ধার দিয়ে রাখেন। সন্ধ্যায় আজহারুলকে দাওয়াত দেন আব্দুর রহমান। আসমা আজহারুলকে ফোন করে দাওয়াতের বিষয়টি জানান। আজহারুল দাওয়াত পেয়ে রাত ৯টায় মসজিদে যান। সেখানে এশার নামাজ আদায় করেন তিনি। সাড়ে ৯টার দিকে আজহারুল আব্দুর রহমানের কক্ষে যান। সেখানে ঘুমের ওষুধ মেশানো ডাবের পানি আজহারুলকে খাওয়ান আব্দুর রহমান। ৮-১০ মিনিটের মধ্যে আজহারুল ঘুমিয়ে পড়েন। আব্দুর রহমান তাকে কক্ষে তালাবদ্ধ করে মসজিদের বাইরে যান। এক-দেড় ঘণ্টা ঘোরাফেরা করেন। আশপাশে লোকজনের চলাচল কমে এলে আবার নিজ কক্ষে যান আব্দুর রহমান। আজহারুলকে ডাক দিলে তিনি উঠে পড়েন এবং চলে যেতে চান। আব্দুর রহমান জোর করে তাকে আটাকাতে চান। আজহারুল বের হয়ে দরজার পাশে থাকা উঁচু স্থানে গেলে আব্দুর রহমান তাকে পেছন থেকে ধরে ফ্লোরে ফেলে দেন। হাতের কাছে থাকা চাপাতি দিয়ে আজহারুলের ঘাড়ে কয়েকটি কোপ মারেন। প্রচুর রক্তক্ষরণে মারা যান আজহারুল। লাশ পাশের কক্ষের বাথরুমে নিয়ে যান আব্দুর রহমান। লাশ সেখানে রেখে নিজ কক্ষের রক্তের দাগ মুছে ফেলেন আব্দুর রহমান। এ সময় আসমা ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আজহারুল মারা গেছেন কি না। আব্দুর রহমান পুরো বিষয়টি তাকে অবগত করেন। দুজন পরামর্শ করে রাত ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত চাপাতি, ছোরা ও ছুরি দিয়ে আজাহারুলের মাথা, দুই হাত, দুই পা আলাদা করেন আব্দুর রহমান। ভুড়ি আংশিক বের করে ফেলেন, যেন লাশ পানিতে ভেসে না ওঠে। আজহারুলের দেহের ৬ টুকরা তিনটি বস্তায় করে মসজিদের ওযুখানার মেইন গেটের সঙ্গে সেফটিক ট্যাংকের ওপর ঢালাই করা মুখ খুলে ভেতরে ফেলে দেন আব্দুর রহমান। ২২ মে সেফটিক ট্যাংকের ঢাকনার ওপরে সিমেন্ট দিয়ে নিজেই প্লাস্টার করে ঢেকে লাশ গুম করেন, যেন কেউ দুর্গন্ধ না পান। মসজিদের মোয়াজ্জিন মো. জোবায়ের হোসেনকে পরদিন সকাল ৯টায় বাসা থেকে ডেকে এনে প্লাস্টার করার বিষয়ে আব্দুর রহমান জানান, মুসল্লিরা দুর্গন্ধ পান। তাই, ট্যাংকের মুখ নিজে প্লাস্টার করেছেন।

মামুন/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়