ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন: পাঁচ বছরে কত বাড়বে দেশের তাপমাত্রা

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২০, ২০ মে ২০২৩   আপডেট: ২২:২৩, ২০ মে ২০২৩
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন: পাঁচ বছরে কত বাড়বে দেশের তাপমাত্রা

আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বে তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে এবং একসময়ে সেটি রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছাবে। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা তৈরি হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশে তাপমাত্রা কত বাড়বে, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ বছর প্রচণ্ড গরমে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে—আগামী পাঁচ বছরে দেশের তাপমাত্রা কী হারে বাড়বে এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আব্দুল মান্নান রাইজিংবিডিকে বলেছেন, যেহেতু এটা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া, সুতরাং বাংলাদেশও এর ভুক্তভোগী হবে। তাপমাত্রা এমন একটি বিষয়, এক জায়গায় বাড়লে সব জায়গায় বাড়বে। সে হিসেবে বাংলাদেশেও তাপমাত্রা বাড়ার আশঙ্কা আছে। সারা পৃথিবীতে যেভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে, সে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশেও বাড়ছে। ভবিষ্যতেও বাড়বে।

তিনি বলেন, ‘২০২১, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে তাপপ্রবাহ অব্যাহত আছে। ২০১৪ সালের পর থেকে বাড়ছেই। এভাবে বাড়তে থাকলে দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেবে।’

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা শহরে দিনের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। একই অবস্থা হয়েছে আরও চারটি শহরে—বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৯২ ডিগ্রি, খুলনায় ১ দশমিক ২৭, সিলেটে ১ দশমিক ১ এবং রাজশাহীতে তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে এর জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলাকেই দায়ী করা হয়েছে। পাহাড় কেটে ফেলাও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বড় কারণ বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বছর রেকর্ড তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। ঢাকায় গত ১৫ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৬৫ সালের পর এটিই ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ১৯৬৫ সালে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল।

পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আতিক রহমান রাইজিংবিডিকে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে উত্তর গোলার্ধ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এর প্রভাবে মেঘের পানি নিচে নামতে পারছে না। তা ওপরেই শুকিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে। মেঘ যে পানি বহন করছে, তা উড়ে যাচ্ছে। এজন্য শহরে গাড়ির কালো ধোয়া ও গাছপালা কম হয়ে যাওয়াই দায়ী।   

জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) সতর্ক করেছে, আগামী ৫ বছরে বিশ্বের উষ্ণতা সর্বোচ্চ হতে পারে। গত ১৭ মে এক বৈঠকের পর ডব্লিউএমও জানায়, আগামী পাঁচ বছর রেকর্ড তাপমাত্রা দেখতে চলেছে বিশ্ব। আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন এ সময়ে দেখা যাবে। এল নিনোর অবস্থান এবং গ্রিন গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ হিসাব করে এই উপসংহারে পৌঁছেছেন তারা।

সংস্থাটি জানায়, ৯৮ শতাংশ আশঙ্কা হলো—এই ৫ বছরের মধ্যে কোনো এক বছরে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাবে। আগামী ৫ বছরে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়বে। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা তৈরি হবে।

১৮৮০ সালে তাপমাত্রা সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে দেখা গেছে যে, প্রতি বছরই কিছু না কিছু মাত্রায় তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে, ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি ‘গভীর আশঙ্কাজনক’ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াতে বাংলাদেশের ভূমিকা না থাকলেও এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী এ দেশ।

সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক গবেষণা জানিয়েছিল, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর আগামী কয়েক বছরে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশেও একই কারণে সেটা বাড়ছে। কিন্তু, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কতগুলো বিষয়। জলবায়ুর পরিবর্তন যতটা দায়ী, তার চেয়েও বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, নগরের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দুর্বল পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে আগের তুলনায় প্রচুর সংখ্যক এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে, এখান থেকে যে তাপ তৈরি হচ্ছে, সেটা আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা, পরিবহন নেটওয়ার্ক ও সবুজের অভাব।

জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) বলছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী ৫ বছরে গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে যেতে পারে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এল নিনো তৈরির আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। এল নিনো আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক অবস্থান। এল নিনো আবহাওয়া গরম করে, লা নিনা আবহাওয়া ঠান্ডা করে। 

ডব্লিউএমওর বক্তব্য, এল নিনো তৈরি হলেও লা নিনা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই, তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। এর প্রভাব পড়বে স্বাস্থ্য, খাদ্যভাণ্ডার এবং সার্বিকভাবে পরিবেশের ওপর। খরা ও বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। শস্য উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে। নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। সবাই যাতে এর জন্য তৈরি থাকেন, সেই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী তাপপ্রবাহ কমাতে এখনই সচেতন হওয়া উচিত বলেন মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আব্দুল মান্নান। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘পুরো বিশ্বকেই এখন সচেতন হতে হবে যে, তাপমাত্রা কমাতে না পারলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। বিশ্বকে অবশ্যই গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে এবং বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে।’

বাংলাদেশে বনায়ন প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বনায়ন প্রক্রিয়া চলছে। এটি আরও এগিয়ে নিতে হবে। তা হলে বসতি এলাকায় তাপমাত্রা কিছুটা কম হতে পারে। ঢাকাসহ সারা দেশের শহরগুলোতে বনায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে। ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিজিজের কারণে বনায়ন কম হয় নগরে। এসব এলাকায় বনায়ন প্রক্রিয়া বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। গাছপালা নিধন কমাতে হবে। এটা করতে পারলে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

পারভেজ/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়