ঢাকা     রোববার   ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২৮ ১৪৩১

বিরল ও স্নায়ুতন্ত্রের জন্মগত জটিল রোগ

এসএমএ: দুই প্রজন্মতেই কি থেমে যাবে আক্রান্ত পরিবারগুলো!

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৩, ২৭ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২২:৪৯, ২৮ নভেম্বর ২০২৩
এসএমএ: দুই প্রজন্মতেই কি থেমে যাবে আক্রান্ত পরিবারগুলো!

ছবিতে (বাঁ থেকে) আজমাঈন নাফী নূর স্বার্থক, শরীরের অভ্যন্তরের জিনের স্থিরচিত্র, আসফিয়া তাসনীম রুহী

আসফিয়া তাসনীম রুহী। রোববার প্রকাশিত হয় তার এইচএসসির ফল। এতে কৃতিত্বের সাথে সে পাস করেছে। চলতি বছর পাস করা ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন পরীক্ষার্থীর চেয়ে রুহীর পাসের খবরটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। রুহী বিরল একটি জেনেটিক রোগে আক্রান্ত। এ রোগের প্রভাবে শারীরিক জটিলতা, মানসিক চাপ এবং জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে। পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য অসংখ্য প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও।

রুহী দুরারোগ্য জেনেটিক রোগ এসএমএ-তে আক্রান্ত। আমাদের দেশে এ রোগের পরিণতি এতোটাই করুণ যে, ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার আওতায় আনা হলেও সঠিক নিয়মে পরিচর্যার অভাবে রোগী মারা যাচ্ছেন। আর ওষুধ পাওয়া না গেলে বাবা-মা জানতে পেরে যান যে, তাদের সন্তানটি নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে মারা যাবে। আদরের সন্তানটি মারা যাবে জেনেও তাকে লালন-পালন করার মতো কঠিন কাজটি করতে হয় তাদের।

সন্তান মারা যাবে— এমন আশঙ্কা নিয়েও সহায়-সম্বল বিক্রি করে অনেক বাবা-মা সন্তানের চিকিৎসা করাচ্ছেন আমাদের দেশে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরাও। কারণ, এই রোগের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা আমাদের দেশে নেই। এমনকি, এই রোগ নির্ণয়ের টেস্টও আমাদের দেশে হয় না। প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ করে পাশের দেশ ভারত থেকে টেস্ট করিয়ে আনতে হয়।

টেস্ট করে রোগ নির্ণয় করলেও দেশে এই রোগের চিকিৎসা সহজলভ্য নয়। এসএমএ মূলত মাংসপেশীর রোগ। মেডিক্যালের ভাষায় যাকে বলে, ‘স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রোপি’। এটি একটি প্রগ্রেসিভ নিউরো মাসকুলার ডিজঅর্ডার। এতে রোগীর নিউরন শুকিয়ে যায়। ফলে মাংসপেশী ও অস্থি দুর্বল হয়ে পড়ে বা কাজ করে না। এটি একটি বিরল ও স্নায়ুতন্ত্রের জটিল রোগ, যা জীনগত ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। এই রোগে শিশু ক্রমান্বয়ে বসতে, দাঁড়াতে এবং মাথা তুলতেও পারে না।

এসএমএ’র কারণে অনেকের শিরদাঁড়া বেঁকে যায়। হাত আর পায়ের পেশিতে জোর ক্রমশ কমতে থাকে। কারও কারও মাথা ঘাড়ের একদিকে কাত হয়ে যায়। মাথাটাকে সোজা রাখতেও পারে না তারা। আর বুকের পাঁজরে ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকায় শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়। জন্মের সময় এই রোগের লক্ষণগুলো যেহেতু বোঝা যায় না, তাই রোগ নির্ণয়ও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

রোগটি কেন উৎকণ্ঠার

এখন পর্যন্ত এসএমএ-এর চিকিৎসায় যত ওষুধ উৎপাদিত হয়েছে, তার কোনোটিই এই রোগ নিশ্চিন্ন করে না। ।চিকিৎসা রোগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল টিকা এই রোগের ওষুধ হিসেবে এফডিআই অনুমোদিত।  দাম প্রায় ২২ কোটি টাকা। এটি নোভার্টিসের জিনথেরাপি।  এটি রোগীর ওজন ২১ কেজি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রয়োগ করা যায়। তবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, তারা এ বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছে যাতে এ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা যায়। একবার প্রয়োগে দারুণ সাফল্য আসে এই ওষুধে। চ্যালেঞ্জ হলো, এই সময়ের মধ্যে রোগটি সনাক্ত করা না গেলে, টিকাটি আর প্রয়োগ করা যায় না।  এ ছাড়াও, রয়েছে নুসিনার্সিন গ্ৰুপের একটি ইনজেকশন, স্পিনরাজা।  এসব ওষুধ এফডিআই অনুমোদিত হলেও এখনও বাংলাদেশে অনুমোদন পায়নি।

বাংলাদেশে চলতি বছর অনুমোদন পেয়েছে রোশ ফার্মার ওরাল ড্রাগ নাম রিজডিপ্লাম। স্পিনরাজা এবং এই রিজডিপ্লাম চালাতে হয় আজীবন। একজন রোগী রিজডিপ্লাম নিলে তার বছরে ওষুধ বাবদ খরচ হয় ৫০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। এর ওপর আছে বাইপ্যাপ পরিষেবা, হাসপাতালের খরচ, ফিজিওথেরাপি, অর্থোটিস্ট ও প্রসথেটিস্টের খরচ।  এসব সেবার সবগুলো বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়।  ফলে খরচ আরও বেড়ে যায়। বর্তমানে ওষুধ ছাড়াই মাসে গড়ে একজন রোগীর জন্য খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকা।  এ পর্যন্ত আমাদের দেশে অন্য বিরল রোগের মতই এসএমএ রোগীরা স্বাস্থ্যবিমার অন্তর্ভুক্ত নন।  ফলে অভিভাবকদের পরিস্থিতি হয় দুর্বিষহ। এসএমএ’র পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য গাইডলাইনও নেই আমাদের দেশে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এতো এতো টাকা খরচ করে ওষুধ খেলেও রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় হচ্ছে না। ফলে ওষুধ পেয়েও অন্যান্য পরিষেবা নিশ্চিত করতে না পারায় আমাদের এখানে রোগী মারা যাচ্ছে। তেমনি একটি উদাহরণ কৌশানী।

‘রোশ বাংলাদেশ’র পক্ষ থেকে বিনামূল্যে পাওয়া মুখে খাওয়ার ওষুধ রিজডিপ্লাম পাচ্ছিল কৌশানী গত ৬ মাস ধরে। কদিন আগেও এসএমএ রোগীদের কেউ ওষুধ পেলে আশ্বস্ত হতে পারতো। কিন্তু গত মাসে কৌশানী নিয়মিত ওষুধ পাওয়ার পরেও মারা যাওয়ায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে ওষুধই কি একমাত্র সমাধান নয়? কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে এর সঠিক কারণও জানা যায়নি। তারা বলেন, যেহেতু এখনও এসএমএ রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে একেবারেই সূচনালগ্নে। ফলে চিকিৎসা বিষয়ে অভিজ্ঞতা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, রোগীর সহায়ক চিকিৎসা এবং প্রয়োজনীয় সেবার অভাব- এর বড় কারন।

বাংলাদেশে সীমাবদ্ধতা

এসএমএ রোগের টেস্ট বাংলাদেশে করা যায় না। পাশের দেশে এই টেস্ট করা হলেও খুব ব্যয়বহুল। ফলে এই রোগের লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা করেন ডাক্তাররা। এ ছাড়া, প্রায় কাছাকাছি লক্ষণ দেখা যাওয়া অন্যান্য রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।  এসব কারণে এসএমএ-তে বাংলাদেশে মৃত্যুহার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি।

সম্প্রতি পোশাক কারখানায় কাজ করা নারায়ণগঞ্জের এক দম্পতি বাচ্চার টেস্ট করানোর জন্য অলঙ্কার বিক্রি করেছেন। কিন্তু পরবর্তী চিকিৎসা কীভাবে করাবেন তারা জানেন না। এমন উৎকণ্ঠার মধ্যেও তারা শুধু নিশ্চিত হতে চান, তাদের বাচ্চার যেন এসএমএ রোগ না হয়। কারণ এরই মধ্যে তারা জেনেছেন, এই রোগের চিকিৎসা কতটা দীর্ঘমেয়াদী এবং ব্যয়বহুল।

এসএমএ রোগের থেরাপিসহ অন্যান্য চিকিৎসাসেবার জন্য ডেডিকেটেড কোনও হাসপাতাল নেই। এমনকি, কোনও এসএমএ ক্লিনিকও এখনও গড়ে উঠেনি; যেখানে নিয়মিত এবং ঝামেলা ছাড়া রোগীরা পরামর্শ নিতে পারেন।

যেহেতু জীবিত রোগীর নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই দেশে, ফলে এই রোগে যারা মারা যাচ্ছে, তাদেরও কোনও পরিসংখ্যান রাখা হচ্ছে না। অথচ গত দু’মাসেই দুজন রোগী মারা গেছেন। ২ বছর ৭ মাস বয়সে আল আমিন মারা যায় অক্টোবরে, এরপর কৌশানী।

একটা বড় স্পেকট্রাম-জুড়ে হয় এই বিরল রোগের চিকিৎসা। আর সেই স্পেকট্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সব চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তার প্রতিটিই ব্যয়বহুল। চিকিৎসা শাস্ত্রের ১০ থেকে ১২টি বিভাগ এই রোগের ম্যানেজমেন্টে একসঙ্গে কাজ করতে হয়। এর ফলে, রোগটা সম্পূর্ণ না সারলেও রোগীর কষ্ট কিছুটা কমে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে যে বিভাগ এই রোগের মাল্টি নোডাল থেরাপি দেয় তা হলো- পেডিয়াট্রিক্স বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, নিউরো ডেভেলপমেন্ট, পেডিয়াট্রিক্স নিওন্যাটোলজি, পালমোনোলজি, নিউরোলজি, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশানাল থেরাপি, অর্থোটিস্ট, প্রস্থেটিস্ট স্পাইন সার্জন, নেফরোলজিস্ট, ইউরোলজিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট প্রভৃতি। একসঙ্গে ১০ থেকে ১২টি বিভাগের চিকিৎসক পাওয়া আমাদের দেশে বলতে গেলে অসম্ভব। ফলে বেশ মুশকিলে পড়তে হয় রোগীর পরিবারকে।

বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হুইলচেয়ারসহ বিভিন্ন ইক্যুপমেন্ট প্রয়োজন হয় এসব রোগীদের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত সাপোর্ট দেওয়ার প্রতিষ্ঠান খুবই কম। যে দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে রোগীরা খুব বেশি জানে না। ফলে বাধ্য হয়েই বেশি টাকা ব্যয়ে এসব ইক্যুপমেন্ট ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়।

আইসিডিডিআর,বির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২৪ হাজার ৩০০ শিশুর মৃত্যু ঘটছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এসএমএ আক্রান্ত রোগীদেরও ঠাণ্ডা সংক্রান্ত সমস্যা থাকে।

দেশে এসএমএ রোগীদের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে একটি ফাউন্ডেশন, যার নাম ‘কিউর এসএমএ বাংলাদেশ’। এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রতিবছর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যেসব শিশু মারা যায়, যদি এসএমএ টেস্ট করা যেত তাহলে হয়তো একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা এসএমএ আক্রান্ত পাওয়া যেত। কারণ, এসএমএ আক্রান্ত রোগীদের একটি অন্যতম উপসর্গ হচ্ছে এই নিউমোনিয়া।

কেস স্টাডিও করুণ কাহিনীর

আমিনুল ইসলাম, বাড়ি রংপুরে। সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী হিসেবে রংপুরে বেশ পরিচিতিও রয়েছে তার। ১৮টি গাড়ি নিয়ে তার ছিল ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা। আমিনুল ইসলাম দম্পতির দুই সন্তান। প্রথম সন্তান আজমাঈন নাফী নূর স্বার্থক। ৭ মাস বয়সে তার এসএমএ শনাক্ত হয়। বর্তমানে তার বয়স সাড়ে ৬ বছর। এই দীর্ঘ সময় সার্থককে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করছেন। এর মধ্যে একই রোগে মাত্র ৫ মাস ১৭ দিন বয়সে তাদের দ্বিতীয় সন্তান আছওয়াদ নাফী নূর মারা যায়। বড় সন্তান স্বার্থকের চিকিৎসাব্যয় বহন করতে গিয়ে একে একে গাড়ি বিক্রি করেছেন ১৬টি, বিক্রি করেছেন শহরের বাড়িও। বর্তমানে অনেকটা নিঃস্ব আমিনুল ইসলাম।

এই দম্পতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা আর সন্তান নেবেন না। এর কারণ হিসেবে আমিনুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার জীবনের সব সঞ্চয় শেষ করেছি দুই বাচ্চাকে নিয়ে। যদি আমাদের এরপর সুস্থ বাচ্চাও হয়, তার এসএমএ ক্যারিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে ৫০ শতাংশ। আমার বাচ্চার জন্য তো কিছু রেখেই যেতে পারছি না, যেটা বিক্রি করে সে তার বাচ্চার চিকিৎসা করাবে। তাই যতদিন সার্থক বেঁচে থাকবে, ওকে নিয়ে বেঁচে থাকবো।’

উল্লেখ্য যে, এসএমএ রোগটি বাবা-মায়ের জিনগত সমস্যার কারণে হয়। যদি কোনও দম্পতি এসএমএ ক্যারিয়ার হয় বা এসএমএ রোগ হওয়ার জন্য দায়ী জিন বহনকারী হয়, তাদের বাচ্চার ২৫ শতাংশ আশঙ্কা থাকে এসএমএ রোগ হওয়ার; ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে সুস্থ বাচ্চা হওয়ার, আর ৫০ শতাংশ আশঙ্কা থাকে, সুস্থ বাচ্চা হলেও এসএমএ ক্যারিয়ার হওয়ার। যেমন, আমিনুল ইসলাম দম্পতির দুই সন্তানই এসএমএ আক্রান্ত হয়েছেন। যেমনটি হয়েছে শাহাদাত হোসেন দম্পতির ক্ষেত্রে। তাদের প্রথম সন্তান একই রোগের লক্ষণ নিয়ে মারা যায়। দ্বিতীয় সন্তান নবনীও এসএমএ আক্রান্ত। বেসরকারি চাকরিজীবী ওমর ফারুখের দুই সন্তান, উভয়ই এসএমএ আক্রান্ত। রিপন হোসেন এবং তানজিনা আফরিন দম্পতির প্রথম সন্তান মারা গেছেন ৯ মাস বয়সে এসএমএ আক্রান্ত হয়ে। এই দম্পতি দ্বিতীয় সন্তানের স্বপ্ন দেখছেন। এরই মধ্যে তারা ভারত থেকে এমনিওটিক ফ্লুইড পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, অনাগত সন্তানের রোগটির উপসর্গ নেই। এই টেস্টও বেশ ব্যয়বহুল। অনেক বাবা-মা এই টেস্ট সম্পর্কে জানেন না। জানলেও দেশে এ টেষ্টের ব্যবস্থা না থাকায় ভারত থেকে অনেক টাকা খরচ করে করতে হবে ভেবে সাহস পান না। সব মিলিয়ে কোনও একটি পরিবারে এসএমএ রোগটি হলে সেই পরিবারটি দুই প্রজন্মের মধ্যেই থেমে যাচ্ছে। বিপরীতে পরিবারগুলোর পক্ষ থেকেও প্রশ্ন উঠছে, দুই প্রজন্মেই কি থেমে যাবে এসব পরিবার? সরকার বা বিত্তবানরা কি এগিয়ে আসবে না?

পরিসংখ্যান অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহতা প্রকাশ করে না

এসএমএ রোগীদের কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দেশে নেই। ‘কিউর এসএমএ বাংলাদেশ’র কাছে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। সংগঠনটির হিসাবে, দেশে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত রোগী ১৬৩ জন। দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ফার্মাসিউটিক্যালের কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে সংগঠনটি এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে।

তবে সংগঠনের সদস্যরাই বলছেন, এটি দেশের প্রকৃত চিত্র নয়। উন্নত বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার জনে একজন এসএমএ আক্রান্ত রোগী রয়েছে বলে ধরা নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে আত্মীয়তার মধ্যে বিয়ে বেশি হয়। তাই এই সংখ্যা এ অঞ্চলে বেশি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ, এই রোগ সাধারণত জীনগত সমস্যার কারণে হয়। আর এই জীনগত সমস্যা রক্তের সর্ম্পকের আত্মীয়তার বিয়ের হলে সেসব পুরুষ-মহিলার থেকে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যার অন্যতম কারণ ধরা হয় আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হওয়া। সে হিসাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু টেস্ট করার সুযোগ কম থাকায় এটি নির্ণয় দুরূহ বিষয় হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি এসএমএ টেস্ট সহজ ও কম খরচে করা সম্ভব হতো; তাহলে দেখা যেত, বাংলাদেশে মহামারি আকারে এটি ছড়িয়ে আছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ষড়ঋতুর দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে এতো বেশি নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু থাকার কথা নয়। এসব পেসেন্ট অ্যাডভোকেটদের ধারণা, দেশের নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের একটি বড় অংশ এসএমএ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। কেবলমাত্র টেস্টের মাধ্যমে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

যে কারণে এসএমএ বিরল রোগ

চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘বিরল রোগ’ বলতে সেসব রোগকে বোঝানো হয়, যে রোগগুলোতে দুই হাজার থেকে ২ লাখ জনসংখ্যায় মাত্র একজন আক্রান্ত হয়।  আক্রান্ত রোগীদের অভিভাবক এবং পেসেন্ট অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ‘কিউর এসএমএ বাংলাদেশ’র সদস্যরা বলছেন, এসএমএ টেস্টের খরচ কমিয়ে এবং সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে টেস্টের পরিধি বাড়ানো গেলে দেখা যাবে এর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। কারণ, গত দুয়েক বছর ধরে এসএমএ’র লক্ষণ দেখে টেস্ট করানো সকল রোগীদের ক্ষেত্রেই রোগটি ধরা পড়েছে। এ ছাড়া, এই রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া রোগীদেরও পরিসংখ্যানের আওতায় আনা হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হচ্ছে, বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ধারণার থেকে বেশি।

এ ছাড়া, জীনগত সমস্যায় এসএমএ ছড়ায় বলে এবং আত্মীয়তার সম্পর্কে বিয়ের প্রবণতা বেশি হওয়ায় আমাদের দেশে এসএমএ রোগী বেশি থাকার আশঙ্কাও করা হয়।

আগস্ট মাসকে ধরা হয় ‘বিরল রোগের মাস’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবার আগস্ট মাসকে বিরল রোগের মাস পালন করেছে এই এসএমএ সচেতনতা মাস হিসেবে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও আগস্ট মাসকে বিরল রোগ হিসেবে এসএমএ সচেতনতা মাস পালন করেছে। জাতীয় ভাবে বাংলাদেশেও আগামী বছর থেকে আগস্ট মাকে এসএমএকে প্রাধান্য দিয়ে ‘বিরল রোগের মাস’ হিসেবে পালন করা যেতে পারে।

করুণ পরিণতি

এ রোগে আক্রান্তরা ধীরে ধীরে হুইল চেয়ারে বন্দি হয়ে পড়ে। শিরদাঁড়া এক দিকে বেঁকে যায়। চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় একে বলা হয় ‘স্কোলিওসিস’। এসএমএ রোগীদের ক্ষেত্রে দ্রুত হয় স্কোলিওসিস। ফলে, শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এই রোগে আক্রান্তদের। আর শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়ার থোরাসিক কেজ বা বুকের খাঁচায় ক্রমাগত চাপ পড়ে। এর ফলে এসএমএ আক্রান্তরা প্রায়ই সর্দি কাশি বা শ্বাস জনিত অন্যান্য রোগে ভুগতে থাকে। যখন শিরদাঁড়ার স্কোলিওসিস মাত্রাতিরিক্ত হয়, তখন প্রয়োজন হয় শিরদাঁড়ার অস্ত্রোপচার। ফিজিওথেরাপি এসএমএ রোগীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে এই রোগীদের ফিজিওথেরাপির স্পেশালিস্ট চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। চিকিৎসাবঞ্চিত হয়ে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও জটিলতার কারণে এসব শিশু সঠিক চিকিত্সা না পেলে একসময় মারা যায়। যদিও এই সময়টা টাইপ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন টাইপ-১ বাচ্চারা চিকিৎসা না পেলে জন্মের দুই বছরের মধ্যে মারা যায়।

এসএমএ’র রয়েছে চারটি টাইপ বা পর্যায়

টাইপ-১:  সাধারণত জন্মের কয়েক সপ্তাহ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এসএমএ টাইপ-১ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসা না পেলে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত এরা বেঁচে থাকতে পারে। শিশুর শরীর অত্যধিক নরম হয়। শিশুর ঘাড় শক্ত হয় না। শিশু উঠে বসতে পারে না। বাংলাদেশে এই পর্যায়ের রোগী বেশি চিহ্নিত হয়।

টাইপ-২: সাধারণত ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়সের মধ্যে টাইপ-২ এর লক্ষণ দেখা দেয়।  শিশু হাঁটা-চলা শুরু করার পর হঠাৎ ব্যাল্যান্স চলে যায়। শিশু হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়। শিশু হামা দেয়, কিন্তু হাঁটে না। এই পর্যায়ের রোগীও মোটামুটি রয়েছে।

টাইপ-৩: ১৮ মাস থেকে প্রাপ্ত বয়স্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লক্ষণ প্রকাশ পায়। সবকিছু স্বাভাবিক থাকার পর হঠাৎ দেখা দেয় রোগের লক্ষণগুলো। সাইকেল চালাতে কিংবা হাঁটতে চলতে অসুবিধা হয়।

সম্প্রতি এসএমএ’র টাইপ-৩ চিহ্নিত হয়েছে ঢাকার একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া এক ছাত্রের। এত বছর সুস্থ থাকলেও ১৭ বছর বয়সে তার এসএমএ ধরা পড়ে। তাকে এখন সাপোর্ট নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের একজন শিক্ষক। তিনি শিক্ষকতা পেশার শুরুতে কানাডায় মাইগ্রেট করার সুযোগ পেলেও যাননি দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে। বর্তমানে তিনি নিজেকে একজন ‘অসহায় বাবা’ মনে করছেন।

টাইপ-৪: বয়স ১৮ বছর পার হওয়ার পর দেখা দেয় লক্ষণগুলো। রোগীর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। রোগীর হাঁটা চলায় অসুবিধা হয়। ক্রমশ হুইল চেয়ারে বন্দি হয়ে পড়ে রোগী।

ওষুধ নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর

বিদেশি ওষুধ কোম্পানি নোভার্টিস গ্লোবাল ম্যানেজড অ্যাক্সেস প্রোগ্রাম (জিম্যাপ) কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবছর লটারির মাধ্যমে বিশ্বের এসএমএ আক্রান্ত দুই শিশুকে ২২ কোটি টাকা দামের জোলগেনসমা নামের ইনজেকশনটি বিনামূল্যে দিয়ে থাকে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে হাসপাতালের উদ্যোগে ২০২২ সালে রায়হান নামে বাংলাদেশের একটি শিশু এই টিকাটি পায়। বর্তমানে সে অনেকটা সুস্থ এবং স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই টিকা কেনা অনেকের জন্যই অসম্ভব।

এ ছাড়া, বাংলাদেশে অনুমোদন পাওয়া রোশ ফার্মার ওষুধ রিজডিপ্লামও দুটি বাচ্চাকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। সৌভাগ্যবান দুটো শিশু এই ওষুধ পায়। এর মধ্যে প্রথম ওষুধ পাওয়া নবনী আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ। তবে ওষুধ পেয়েও সাত মাস ওষুধ খেয়ে চলতি মাসে মারা গেছেন কৌশানী। তার বয়স হয়েছিল আড়াই বছর। তার বাড়ি কুষ্টিয়ায়।

পরিবারগুলোর প্রয়োজন সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট

একটি শিশু রোগাক্রান্ত হলে পুরো পরিবারের ওপর তার প্রভাব পড়ে। আর, পরিবারের একটি শিশু এসএমএ’র মতো বিরল রোগে আক্রান্ত হলে বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠা, মানসিক চাপ, আর্থিক ব্যয়ের কোনও সীমা থাকে না। যেহেতু এসএমএ’র কোনও একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা সম্ভব না এবং এখনো দেশে এ বিষয়ের কোনও গাইডলাইন নেই— তাই বাবা-মায়েদের ভোগান্তিও পোহাতে হয় বেশি। এই অবস্থায় তাদের মানসিক সাপোর্ট জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে এসএমএ ইউরোপের একটি আর্টিকেলে চিকিৎসক ডেমির লিখেছেন, যাদের শিশুর এসএমএ ধরা পড়ে, পিতামাতার জন্য মনস্তাত্ত্বিক সহায়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিয়মিত কাউন্সেলিং জরুরি।

প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ

ওষুধের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এই রোগের জন্য আনুষঙ্গিক যেসব থেরাপির প্রয়োজন হয়, এ বিষয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি উদ্যোগ নেই। এমনকি, ওষুধের উচ্চমূল্যের আরেকটি কারণ, এখনও দেশে এই রোগটি বিরল রোগ হিসেবে সরকারের তালিকাভুক্ত নয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে বাড়তি ট্যাক্স যোগ হয়ে ওষুধের দাম বেশি হয়। সংশ্লিষ্টদের দাবি, রোগটিকে দ্রুতই বিরল রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা। তাহলে অন্তত ওষুধের দাম কিছুটা কম হবে। কারণ, এই রোগের ওষুধটি বর্তমানে সাধারণ ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত। তাই কর আসে বেশি। পাশাপাশি এ বিষয়ে সরকারের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ বিষয়ে অনেক বেশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন, যাতে জনসাধারণ এসএমএ রোগটি সর্ম্পকে জানতে পারে। তাহলে দুটো বিষয়ের প্রাথমিক সমাধান পাওয়া সম্ভব। প্রথমত, রোগের লক্ষণ দেখেই টেষ্ট করা ও চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, আত্মীয়তার মধ্যে বিয়ে হলে সেই দম্পতি গর্ভাবস্থায় এমনিওটিক ফ্লুইড পরীক্ষাটি করতে আগ্রহী হবে।

তবে হয়তো আমাদের বাস্তবতায় এখনই দাবি উঠেনি, বিয়ের আগে জেনেটিক টেষ্ট করার বিষয়ে। তবে ইউরোপের অনেক দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানসহ অনেক দেশেই বিয়ের আগে এ ধরনের ক্ষেত্রে টেষ্ট করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমনকি বিষয়টি সরকারের অর্থায়নে সম্পন্ন হয়।

উদাহরণ হতে পারে ভারতের অভিজ্ঞতা

প্রতিবেশী দেশ ভারত এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৫০০-এর বেশি। এই বিশাল সংখ্যক রোগীর সহায়তায় দেশটিতে বেসরকারি উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে ‘কিওর এসএমএ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’। এই ফাউন্ডেশন দেশটির সরকার ও ফার্মা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করছে। এরই মধ্যে কমপ্যাশনেট প্রোগ্রাম ও হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাকসেস প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ওষুধ স্পিনরাজা এবং রিজডিপ্লাম পাচ্ছে অসুস্থ শিশুরা। একই সঙ্গে দেশে অননুমোদিত কিন্তু ৩য় পর্যায়ের ট্রায়াল উত্তীর্ণ ওষুধগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডিজিসিএ’র অনুমোদন পেতে ও আইনি জটিলতা কাটাতেও কাজ করে এই অভিভাবকদের সংগঠন। সারা দেশের ২২ জন চিকিৎসককে তাদের পাশে পেয়ে কিওর এসএমএ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া তৈরি করেছে একটি এসএমএ টাস্ক ফোর্স। এই টাস্ক ফোর্সের কারণে সারাদেশে বেশকিছু রোগী বিনামূল্যে পাচ্ছেন ওষুধ। রোগীদের অভিভাবকদের এই সংস্থা আক্রান্তদের প্রতিদিনের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজখবর রাখে। পাশাপাশি যে সমস্ত শিশু ও কিশোর-কিশোরী আক্রান্ত তাদের প্রতিভা খুঁজে বের করে তাদের আঁকা ছবি সম্বলিত ২০২১-এর একটি ক্যালেন্ডারও প্রকাশ করেছে।

ফান্ড সংগ্রহে অনুকরণ হতে পারে বিরাট কোহলি ও আনুশকা শর্মা

২০২১ সালের মে মাসে ভারতে এসএমএ আক্রান্ত এমনই এক শিশু আয়াংস গুপ্তার জন্য জোলগেনসমা ইনজেকশনটির জন্য ১৬ কোটি টাকা ফান্ড সংগ্রহ করে দেন তারা। প্রসঙ্গত, ভারতে এই ইনজেকশনটির দাম পড়ে প্রায় ১৬ কোটি, বাংলাদেশে খরচ পড়ে প্রায় ২২ কোটি টাকা।

শিশুটির বাবা যোগেশ ও মা রূপাল গুপ্তার পক্ষে ব্যয়বহুল এই ওষুধ কেনার সামর্থ্য ছিল না। সাহায্যের আর্জি জানিয়ে তারা টুইটারে আবেদন জানান। তারা টুইটারে ‘আয়াংসফাইটসএসএমএ’ নামে একটি পেজ খোলেন। ঘটনাচক্রে ওই টুইট নজরে আসে ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলি ও তার স্ত্রী বলিউড অভিনেত্রী আনুশকা শর্মার। তারা উদ্যোগী হয়ে অর্থ সংগ্রহে নামেন। তাদের উদ্যোগেই জোগাড় হয় এই বিপুল অর্থ।

বাংলাদেশে সরকারের পাশাপাশি তারকা এবং খেলোয়াড়রা এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, ফান্ড সংগ্রহে ভূমিকা রাখাসহ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তারকাদের ভূমিকা রাখার এবং সফল হওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে।

চিকিৎসকরা যা বলছেন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেমন বর্তমানে আমরা কাজ করছি ডেঙ্গু নিয়ে। সারাদেশেই এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। বাস্তবতা হচ্ছে, এসএমএ’র মতো বিরল রোগগুলোকে সেক্ষেত্রে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া সরকারের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না। তবে, সরকারের এ ধরনের রোগের বিষয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করছি, আগামী দিনে এ সংক্রান্ত পরিকল্পনায় বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্স ডা. জোবাইদা পারভীন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমাদের দেশে এই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার জন্য পুরোপুরি ব্যবস্থা নেই। তবে নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল এসএমএ ক্লিনিক চালু, চিকিৎসার আওতা বাড়ানো, ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিতসহ এ বিষয়ে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর পাশাপাশি সরকার এগিয়ে আসলে, আমরা আশা করছি রোগীদের একটি আশা আলো দেখাতে পারবো।’

তিনি বলেন, সম্প্রতি এসএমএ চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি করতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোশ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস। চুক্তি অনুযায়ী তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসায় সহায়তা করবে উল্লেখিত তিন প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ‌্যাপক ডা. শাওলী সরকার বলেন, আগামী মাসে আমরা ‘নিউরো মাসকুলার ক্লিনিক’ চালুর কাজ হাতে নিয়েছি। এখানে এ সংক্রান্ত রোগীরা ওয়ানস্টপ সার্ভিস পাবে। পাশাপাশি এসএমএ রোগীদের কল্যাণে আরও কিছু কার্যক্রম হাতে নিচ্ছি আমরা।

অলিভিয়া সঞ্চারি নবনীর মুখে খাওয়ার ওষুধ ‘রিজডিপ্লাম’ দিয়ে দেশে প্রথম এসএমএ রোগীর চিকিৎসা শুরু করে শিশু হাসপাতাল। রোশ বাংলাদেশ বিনামূল‌্যে এই ওষুধটি সরবরাহ করে। এ ছাড়া, শিশু হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন এসএসএ রোগী সার্থক। এসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এসএমএ রোগীদের চিকিৎসাকে প্রাধান্য দিয়ে শিশু হাসপাতাল আরও কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে বলেও জানান ডা. শাওলী সরকার।

ঢাকা/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়