ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

ছেলের কপালে চুমু খেয়ে গেলেন কাজে, ফিরে এসে পেলেন লাশ

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৬, ১২ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৯:০২, ১২ জানুয়ারি ২০২৪
ছেলের কপালে চুমু খেয়ে গেলেন কাজে, ফিরে এসে পেলেন লাশ

মাহমুদুল্লাহ

মাহমুদুল্লাহর বয়স ছিল চার বছর। বাবা-মা-দাদির সঙ্গে বাস করত রাজধানীর দুয়ারীপাড়া এলাকায়। বাবা-মা কাজে গেলে দাদির সঙ্গে খুনসুটিতে কাটত সময়। গত বছরের ২৮ অক্টোবর দিনটিও সেভাবেই কাটছিল। বাবা রাজমিস্ত্রি আব্দুল জলিল সকালে চলে যান কাজে। মাহমুদুল্লাহ তখন ঘুমাচ্ছিল। ঘুমন্ত ছেলের কপালে চুমু খেয়ে অন্যের বাসায় কাজ করতে যান মা মাহমুদা। সেটাই ছিল মায়ের শেষ চুম্বন। এর পর অপহরণের শিকার হয় মাহমুদুল্লাহ। পাঁচ দিন পর শিশুটির গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। বাবার আক্ষেপ,‘শেষবারের মতো ছেলেকে বুকে জড়িয়ে একটু আদরও করতে পারিনি।’

মাহমুদুল্লাহকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় বাবা আব্দুল জলিল মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার করা হয় প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম আমিনকে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শিশুটির গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। আমিন এখন কারাগারে আছে। মামলার তদন্ত চলছে। আগামী রোববার (১৪ জানুয়ারি) এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য আছে।

আব্দুল জলিল বলেন, অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে আমিন আর আমরা একই বাসায় ঢুকি। আমাদের পাশের রুমে তারা স্বামী-স্ত্রী থাকত। তাদের সাথে আমাদের কথা হয়নি। আসামি আমিনুল ইসলাম আমিনের নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। তার স্ত্রী চাকরি করত। আমি সকালে কাজে যাই, রাতে বাসায় ফিরি। ঘটনার দিন আমি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। আমার স্ত্রী এর কিছুক্ষণ পরে কাজে বের হয়। তখন ছেলে ঘুমিয়ে ছিল।

তিনি বলেন, আমি বের হওয়ার সময় মাহমুদুল্লাহর দাদির কাছে টাকা দিয়ে যাই। দাদির সাথে গিয়ে দোকান থেকে ১০ টাকা দিয়ে একটা কেক কিনে আনে সে। দাদিকে বলে, ‘এখন খাবো না, বাসায় গিয়ে খাবো।’ বাসায় ফিরে গেটের সামনে এসে কেকটা খায়। ওর দাদি বাথরুমে যায়। সর্বোচ্চ তিন মিনিট তার দাদি কাছে ছিল না। এর মাঝেই মাহমুদুল্লাহ নাই। আমার মা বাথরুম থেকে বের হয়ে ওকে ডাকাডাকি করে। না পেয়ে সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে। আমিও ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাসায় ফিরে আসি। সবাই খোঁজাখুঁজি করতে থাকি। আমিনও খোঁজে। আমাকে বলে ভাই, মোবাইল দেন ফেসবুকে ছেড়ে দেই খবরটা। ফেসবুকে ছাড়ে। সবাই তন্নতন্ন করে দুয়ারীপাড়া খোঁজে।

জলিল বলেন, পরে জানতে পারি, আমিন মাহমুদুল্লাহর মুখে গামছা ঢুকিয়ে ব্রিফকেসের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। পরে আঘাত করে ছেলেটাকে মেরে ফেলে। শুনেছি, এক দিন এক রাত ওই বাসাতেই রেখেছিল ছেলেটাকে।

তিনি বলেন, ঘটনার দুই দিন পর ফোন করে মুক্তিপণ হিসেবে ৬০ হাজার টাকা চাওয়া হয় আমার কাছে। এর পর ৫০, তারপর ৪০ হাজার টাকা চায়। সবশেষ বলে, ‘তোদের কাছে কি ২০ হাজার টাকাও নাই। ওস্তাদের কাছ থেকে গোপনে ওকে ছেড়ে দিতাম।’ আমি বলি, কিডনি বিক্রি করে হলেও টাকা দেবো। পরে ২০ হাজার টাকা দেই। কিন্তু, ছেলেকে তো পেলাম না। রোগে মরে গেলেও তো বুকে জড়িয়ে আদর করা হয়। কিন্তু, আমি পেয়েছিলাম ছেলের গলিত লাশ। শেষবারের মতো বুকে জড়িয়ে ছেলেকে একটু আদরও করতে পারিনি। ওপর আল্লাহ আর আমি জানি, এটা কেমন কষ্ট। যার কারণে ছেলেকে হারিয়েছি, তার ফাঁসি চাই। দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।

যখন মোবাইল ফোনে আব্দুল জলিলের সাথে কথা হচ্ছিল এ প্রতিবেদকের, পাশে ছিলেন মাহমুদুল্লাহর মা মাহমুদা বেগম। অঝোরে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল এ পাশ থেকে। তার বিষয়ে আব্দুল জলিল বলেন, ছেলে মারা যাওয়ার পর ওর অবস্থা খারাপ। সব সময় কান্নাকাটি করে। একা থাকলেই ছেলের কথা মনে করে কান্না করে। ছেলের ছবি দেখলেই কান্না করে। এ কারণে স্মার্টফোন ব্যবহার করা বাদ দিয়েছি। আর আমার মাও কান্নাকাটি করে। আমি আছি বড় বিপদে। আমি ভেঙে পড়লে তাদের সান্ত্বনা দেবে কে। নিজেকে যে কত কষ্টে স্বাভাবিক রেখেছি, আমি জানি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রূপনগর থানার উপ-পরিদর্শক মহসিন আলী বলেন, এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর আসামিকে গ্রেপ্তার করি। সে আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছে। সে বলেছে, ‘শিশুটি গেটের সামনে ছিল। তাকে ধরে রুমে নিয়ে যাই। উদ্দেশ্যে ছিল—জিম্মি করে টাকা আদায় করা। রুমে ব্রিফকেসে লুকিয়ে রাখি। দুই ঘণ্টা পর দেখি, মারা গেছে।’ তার দেখানো মতে লাশ উদ্ধার করা হয়। মামলার তদন্ত চলছে। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।

আসামিপক্ষের আইনজীবী রুহুল আমিন বলেন, ছেলে ভালো, হুজুর টাইপের। কেমনে কী করছে, বলতে পারে না। তার মোবাইলের দোকান ছিল। তার মোবাইল ব্যবহার করে হয়ত কেউ এটা করতে পারে। ঘটনার সাথে সে জড়িত না। মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে জানা যাবে আসল ঘটনা।  

যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয় আমিনকে

মাহমুদুল্লাহকে অপহরণের পর পুলিশ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমিনকেও জিজ্ঞাসা করে, মোবাইল চেক করে। আমিন তার স্ত্রীকে বলেছিল, তার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে। দুই দিন তার ফোন লাগবে। ওই ফোন থেকে মাহমুদুল্লাহর বাবার ফোনে ফোন দিয়ে ৬০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। আব্দুল জলিল বিষয়টি পুলিশকে জানায়। ফোন নাম্বারটি কার, সে বিষয়ে খোঁজ নিতে জলিলকে বলে পুলিশ। আব্দুল জলিল আমিনের স্ত্রীর কাছে ফোন নাম্বারের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তিনি জানান, আমিন ফোনটি ব্যবহার করছে। পরে পুলিশ আমিনকে গ্রেপ্তার করে।  

যেভাবে খুন ও লাশ উদ্ধার করা হয়:

আমিন জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, গত ২৮ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে দুয়ারীপাড়া বালুরমাঠ এলাকার ওই বাসার গেটের সামনে থেকে মাহমুদুল্লাহকে একা পেয়ে অপহরণের উদ্দেশ্যে বাসায় নিয়ে যায় আমিন। ভিকটিম বাবা-মার কাছে যাওয়ার জন্মা কান্না করতে লাগলে আমিন ধরা পড়ার ভয়ে ভিকটিমের মুখের মধ্যে গামছার এক মাথা দিয়ে চেপে ধরে, যেন কান্নার শব্দ বাইরের কেউ শুনতে না পান। তবুও কান্না না থামায় গামছা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পরে গামছা দিয়ে ভিকটিমকে পেঁচিয়ে ট্রলি ব্যাগের মধ্যে ভরে বাসার সানশেডের ওপরে রেখ দেয় আমিন। তার স্ত্রী পোশাক কারখানায় কাজে চলে গেলে এবং আশপাশের বাসার অন্যান্য লোকজন কাজে বেড়িয়ে গেলে ২৯ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে লাশভর্তি ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে রূপনগর থানাধীন বেড়িবাঁধস্থ বোর্ড ক্লাবের বিপরীত পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাসায় চলে আসে। পরবর্তীতে আসামি তার মোবাইল নাম্বার থেকে ভিকটিমের বাবার মোবাইল নাম্বারে ফোন করে জানায়, তার ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। ভিকটিমের বাবা আসামির নগদ নাম্বারে ২০ হাজার টাকা পাঠান। পরবর্তীতে ভিকটিমের বাবা ফোন দিলে মোবাইল নাম্বার বন্ধ পান। মামলার তদন্তকালে ওই মোবাইল নাম্বারে সিডিআর নিয়ে পর্যালোচনা করে পুলিশ দেখতে পায়, ওই মোবাইল নাম্বার দিয়ে শুধু ভিকটিমের বাবার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এর পর ওই সিম ব্যবহার করা মোবাইল ফোনের আইইএমআই উদ্ধার করা হয়। সেই মোবাইল ফোনে কোন কোন সিম ব্যবহার করা হয়েছে, সে তথ্যও সংগ্রহ করে পুলিশ। নাম্বার রেজিস্ট্রেশন যাচাই-বাছাই করে আমিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

/রফিক/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়