ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

উপজেলা নির্বাচনে আগ্রহী বিএনপির তৃণমূল, সংশয়ে কেন্দ্র 

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১০, ৩০ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৬:১৫, ৩০ জানুয়ারি ২০২৪
উপজেলা নির্বাচনে আগ্রহী বিএনপির তৃণমূল, সংশয়ে কেন্দ্র 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় এ নির্বাচন বয়কট করেছে দলটি। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর পর আসছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করলেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছে বিএনপি।

দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলের বেশিরভাগ নেতা স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন বয়কটের আন্দোলন কর্মসূচিকে ঘিরে মামলা, হামলা, গ্রেপ্তার ও আত্মগোপন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে নির্বাচনকেই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা মনে করছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতারাও এটা বুঝতে পেরেছেন বলে গত সপ্তাহে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। তবে, বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে দলে দুই ধরনের মত রয়েছে। তৃণমূলসহ দলের বিভিন্ন স্তর থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরামর্শ আসছে। এর ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে একটি অংশ সোচ্চার রয়েছেন। তারা মনে করছেন, দলের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিলে সেটা দলের জন্য ইতিবাচক হবে।

বিএনপির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের যে আন্দোলন চলছিল, তার অংশ হিসেবে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার জেরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মির্জা আব্বাসসহ প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া, আন্দোলনকে ঘিরে ঢাকাসহ সারা দেশের নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া হয়ে পড়েছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে লাখো নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। 

এ অবস্থায় বিএনপি সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২৮ অক্টোবর থেকে বন্ধ থাকার পর গত ১১ জানুয়ারি রাজধানীর নয়া পল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খোলা হয়। সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোও পর্যায়ক্রমে খুলতে শুরু করে। যদিও এখনো বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। বিএনপি দ্বাদশ সংসদ বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জোরালো কর্মসূচি নিয়ে এখনো মাঠে নামতে পারেনি দলটি। এমন প্রেক্ষাপটে দলটির অনেক নেতাকর্মী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ বলে মনে করছেন।

তারা বলছেন, সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলনের তোয়াক্কা না করে সরকার ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করে। এতে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। মন্ত্রিসভাও গঠন করা হয়েছে। 

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন নয়। যেহেতু, বিএনপির মূল টার্গেট—আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন, সুতরাং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া, এই নির্বাচনে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে, বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের জয়ী হওয়ার সুযোগও বেড়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলনের অংশ হিসেবে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে তারা।

বিএনপির এই নেতাদের অভিমত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ফলাফল কী হবে, সেটা পরের বিষয়। নির্বাচনে অংশ নিলে সারা দেশের নেতাকর্মীরা আত্মগোপন অবস্থা থেকে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পাবে। এতে দল ফের চাঙ্গা হবে, যা আগামীতে সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য সহায়ক হবে।

বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত দলগতভাবে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রেও নির্বাচন প্রক্রিয়াটি দলের সবার জন্য, বিশেষ করে যারা প্রার্থী হতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। তাতে নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার ভয় থাকবে না। বিএনপিকে বর্তমান বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে সংগঠিত করতে প্রয়োজনে দলের এমন সিদ্ধান্ত অঘোষিত থাকবে। বিএনপির হাইকমান্ড এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন তারা।

অপরদিকে, বর্তমান সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধীদের মতও বেশ জোরালো। তাদের যুক্তি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছে। এর মাত্র তিন-সাড়ে তিন মাসের মধ্যে সেই একই সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে সারা দেশের নেতাকর্মী-সমর্থক ও জনগণের মধ্যে ভুল বার্তা যাবে। অনেকেই এটাকে দলের দ্বিমুখী অবস্থান মনে করতে পারেন।

বিএনপির এই পন্থী নেতারা মনে করেন, স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও তেমন কোনো লাভ হবে না। কারণ, এ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। বরাবরের মতো এবারও জোর করে বিএনপির প্রার্থীদের হারিয়ে দেওয়া হবে। তাছাড়া, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলায়ও একক আধিপত্য ধরে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের নতুন করে হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার শুরু করতে পারে। সুতরাং অনিশ্চিত নির্বাচনে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। যেখানে বিএনপির মূল টার্গেট সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, সেখানে ফেল করেছে দল। বিএনপির কঠোর আন্দোলন সত্বেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সরকারও গঠিত হয়ে গেছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও দ্বিমত রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। তবে, উপজেলা নির্বাচনের যেহেতু এখনো বেশ দেরি রয়েছে, তাই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দল এখন বছরব্যাপী সরকারবিরোধী আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়ন সাপেক্ষে ঘুরে দাঁড়াতে নতুন করে কর্মকৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত রয়েছে।

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, উপজেলা নির্বাচনের তফসিলের আগেই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা কারাগার থেকে মুক্তি পেতে পারেন বলে মনে করছেন তারা। এসব নেতার মুক্তির পরই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসতে পারে। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে দল ঘুরে দাঁড়াতে উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে দলের তৃণমূলের একটি অংশ। খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন বিভাগ-জেলা-উপজেলা পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে তাদের এমন মনোভাব জানা গেছে। তবে, এ ব্যাপারে দল এখনো অবস্থান স্পষ্ট না করায় কৌশলগত কারণে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কখনোই শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু হয়নি; হবেও না। তাই, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না, সেটা আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে। বিএনপি এখনো সেই সিদ্ধান্তে অটল আছে। তারপরও কৌশলগত কারণে বিএনপি স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

/রফিক/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়