ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

শিশুশ্রমিক বেড়েছে সাড়ে ৮৬ হাজার

কোমল হাতে সংসারের হাল

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২০, ১ মে ২০২৪   আপডেট: ১৭:২৩, ১ মে ২০২৪
কোমল হাতে সংসারের হাল

গ্রাফিক্স: রাইজিংবিডি

লেগুনার পেছনে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠা-নামানোসহ টাকা তুলছেন সবুজ মিয়া (১২)। রাজধানীর মিরপুর-১ থেকে মাজাররোড রুটে সবুজের ডিউটি। শুধু এ রুটেই নয়; যাত্রাবাড়ী-চিটাগাংরোড, গুলিস্তান-বাসাবো, মিরপুর-১০, মিরপুর-১, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, গুলশান, সিপাইবাগ-গোরান, গুলিস্তান, কদমতলী, সদরঘাটসহ বিভিন্ন রুটে অনেক শিশুশ্রমিককে ‘কোমল হাতে’ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দেখা যায়।

জানা গেছে, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে দেশের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, লেগুনা, বাসের হেলপারসহ সব জায়গায় এখনও শিশুরা কাজ করছে।

বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন-২০১৮ অনুযায়ী, কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু সেখানে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ‘শিশু’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ‘কিশোর’ বিবেচনায় কাজে জড়ানোর বৈধতা দেওয়া হয়।

শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনও প্রতিষ্ঠানে অল্প বয়সীদের কাজে নিয়োগের আগে সে শিশু না কিশোর বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে জন্মনিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে। কোনও অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে কাজের জন্য অনুরোধ করলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরকে পরীক্ষা করে কাজের কতটুকু সক্ষমতা তার সিদ্ধান্ত দেবেন। চিকিৎসকের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে কোনও কিশোরকে কোন কারখানায় হালকা কাজে নিয়োগ দিলেও দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কাজ করানো যাবে না।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে কথা হয় সবুজ মিয়ার সঙ্গে। সবুজ জানায়, তার বাবা নেই। সংসারে অভাবের কারণে বাধ্য হয়েই কাজ করতে হচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রম করে দিনশেষে মায়ের হাতে ২৫০-৩০০ টাকা তুলে দেয় সে। আর তিন জনের সংসার চালাতে বাসাবাড়িতে কাজ করেন মা।

গুলিস্তান-বাসাবো রুটে লেগুনা চালকের সহকারীর কাজ করে ১৪ বছরের কবির মিয়া। রাইজিংবিডিকে জানায়, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সহকারীর কাজে এসেছে সে। নদীর গর্ভে ভিটামাটি হারিয়ে মা-বাবার সঙ্গে ঢাকায় আসা। দুবছর ধরে লেগুনা চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করছে।    
 
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী ৩৫ লাখ শ্রমজীবী শিশু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৮ লাখ শিশুশ্রমে রয়েছে। আর ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু আছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫ জন। এর মধ্যে, কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। আর ৫ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন, যা মোট শিশুর ৪.৪ শতাংশ।

এক দশক আগে ২০১৩ সালে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ বা ৪.৩০ শতাংশ। অন্যদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন, যা মোট শিশুর ২.৭০ শতাংশ। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ৩.২ শতাংশ।

জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুসারে, পল্লী এলাকায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ৮ লাখ ১০ হাজার শ্রমজীবী শিশু রয়েছে। এর মধ্যে শিশুশ্রমে নিয়োজিতের সংখ্যা পল্লী এলাকায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ৪ লাখ ৪০ হাজার। অন্যদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিতের সংখ্যা পল্লী এলাকায় ৮ লাখ ২০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ২ লাখ ৪০ হাজার।

শিশুশ্রমিকদের গড় মাসিক আয় ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা। এ ছাড়া, ২০ লাখ ১০ হাজার শিশু গৃহকর্মী রয়েছে, যাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। ৮০ হাজার শিশু শ্রমিক পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত। উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। তিনটি প্রাথমিক খাত কৃষি, শিল্প ও পরিষেবা যথাক্রমে ১০ লাখ ৭০ হাজার, ১১ লাখ ৯০ হাজার এবং ১২ লাখ ৭০ হাজার শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে।
 
পরিসংখ্যান ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন বলেন, সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে শিশুশ্রম নির্মূলে সম্ভাব্য সব উপায়ে কাজ করছে। সরকার ‘শিশুশ্রম শূন্যের কোটায় চলে এসেছে’ এমন দাবি না করলেও ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে শিশুশ্রম নির্মূল হবে।

গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, দেশে শিশু শ্রমে নিয়োজিত শিশুর মোট সংখ্যা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন (দেশে ১৭ লাখ শিশু)। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, এর আগে ২০০৩ সালের সমীক্ষায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন।

বাংলাদেশ কাউন্সিল ও লেবার রাইটস সাংবাদিক ফোরাম (আইটিইউসি) তথ্য অনুযায়ী, আগে দেশে শিশু শ্রম ছিল, তা এখন অনেক কমেছে। তারপরও বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪৭ লাখ। শিশুশ্রম বন্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আইটিইউসি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা পরিবহন খাতে কোনো শিশু শ্রমিক দেখতে চাই না। পরিবহন খাত শিশুশ্রম মুক্ত করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও কাজ করতে হবে। কোনো পরিবহনে হেলপার ও ড্রাইভার হিসেবে যেন কোনো শিশু না থাকে, সে বিষয়ে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা যে অর্থ উপার্জন করে, সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠাতে হবে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ বলেন, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের একটি পরিবহন খাত। ঝুঁকির মধ্যে থেকে কঠোর পরিশ্রম করছে শিশুরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে শিশু শ্রম অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ করলে ১০ থেকে ২০ হাজার শিশুশ্রমিক যাবে কোথায়? এ কারণে পুনর্বাসনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন  অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে সেখানে শিশুশ্রম থাকতে পারে না। শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরিদ্র শিশু শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিলে শিশুশ্রমিক কমবে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার শ্রমবান্ধব। শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।  আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমমুক্ত করতে চাই। সবার সহযোগিতায় আমরা ২০৩০ সালের আগেই শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে পারব।

/এনএইচ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়