ঢাকা     শুক্রবার   ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২২ ১৪৩১

‘পলিথিনে মোড়ানো’ জীবনে এখন সুখের ঠিকানা

এসকে রেজা পারভেজ, চরফ্যাশন (ভোলা) থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১০ জুন ২০২৪   আপডেট: ০৯:৩৫, ১১ জুন ২০২৪
‘পলিথিনে মোড়ানো’ জীবনে এখন সুখের ঠিকানা

একসময় স্বামীকে নিয়ে নদীর পাড়ে খাস জমিতে থাকতেন জুলেখা বেগম (৬০)। পুরনো ঘরে ঝড়-বৃষ্টিতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সহ‌্য করেছেন। টিন কেনার সামর্থ‌্য না থাকায় পুরনো পলিথিন দিয়ে বৃষ্টির পানি আটকানোর চেষ্টা করতেন প্রতিনিয়ত। নিজে ভিজে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রক্ষা করতেন বৃষ্টির পানি থেকে। সরকারি ঘর পেয়ে এখন তার কষ্ট ঘুচেছে। এজন‌্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন‌্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে দোয়া করেন তিনি।

জুলেখার মতো এমন লাখো গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে জমিসহ ঘর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একসঙ্গে এত মানুষকে ঘর করে দেওয়ার নজির বিশ্ব ইতিহাসে অভূতপূর্ব এবং অনন‌্য নজির। 

মঙ্গলবার (১১ জুন) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ‌্যমে পঞ্চম ধাপে সারাদেশের ২৬ জেলার ১৮ হাজার ৫৬৬টি পরিবারের মাঝে ২ শতক করে জমিসহ নতুন ঘরের মালিকানা হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ভোলা, কক্সবাজার ও লালমনিরহাটের উপকারভোগীদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে ঘর হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এর মধ‌্যে ভোলার চরফ‌্যাশন এলাকার কচ্ছপিয়া আশ্রয়ন প্রকল্পও রয়েছে।

সরেজমিনে ভোলার চরফ‌্যাশনের কচ্ছপিয়া আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর পাওয়া সুবিধাভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের সবারই আলাদা আলাদা কষ্টের গল্প আছে। আছে জীবন সংগ্রামে হেরে যাওয়ার কাহিনি। তবে, আশ্রয়নের এই ঘর তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সাহস দিয়েছে।  

ভোলার গৃহহীন মানুষের বেশিরভাগেরই গল্প নদীভাঙনের শিকার হয়ে ভিটামাটি হারানোর। এমন একজন মোহাম্মদ আব্বাস। ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন‌্য তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সব হারিয়ে ভোলার ঢালচর এলাকায় সন্তানদের নিয়ে একসময়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন তিনি। পুরনো টিন আর পলিথিনের মিশেলে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন নিজ উদ‌্যোগে। সেখানে কষ্টের সঙ্গে সন্ধি করে এগিয়ে নিচ্ছিলেন জীবন। এই পরিস্থিতিতে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর পেয়ে জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, এখানে-সেখানে থেকেছি। কীভাবে সন্তানদের নিয়ে কষ্ট করেছি, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমাদের ওপর প্রধানমন্ত্রী দয়া করেছেন। ঘর দিয়েছেন। বিল্ডিংয়ে থাকছি। জীবনে আর কী চাওয়াও আছে?’

ঘর পেয়ে বেশি খুশি সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মোহাম্মদ ইমরান। এমনও দিন গেছে, প্রতিদিন বই ভিজত। পড়াশোনার জন‌্য টেবিল ছিল না। বই রাখার জায়গা ছিল না। বৃষ্টি এলে বই রক্ষা করার যুদ্ধে নামতে হতো তাকে। এখন বাবা-মা-ভাইকে নিয়ে আশ্রয়নের বাড়িতে থাকে। আছে পড়ার টেবিল, চেয়ার। বই ভেজা নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না।

ইমরান জানায়, তার বাবা কৃষক। কখনও কখনও বাবাকে সহায়তা করেন। এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। বড় হয়ে ভালো চাকরি করে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চায় সে।   

ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া এলাকায় আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন জমেলা খাতুন। এর আগে দক্ষিণ আইচায় ভাড়া ঘরে বসবাস করতেন তিনি। স্বামীহারা জমেলার ৪ ছেলে-মেয়ে। তাদের নিজস্ব কোনো জমি ছিল না। অর্থকষ্টের মধ্যে কোনোরকম দিনাতিপাত করতেন৷ মাস গেলেই তাকে গুনতে হতো ভাড়ার টাকা। কোনো মাসে ভাড়া দিতে একটু দেরি হলে শুনতে হতো বাড়িওয়ালার কটু কথা। এবার  সেই মানসিক যাতনা থেকে মুক্তি পেতে চলেছেন জামেলা খাতুন। চর কচ্ছপিয়া এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পে দুই শতক জমিসহ ঘর পাচ্ছেন তিনিও। ইতোমধ্যে তাকে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জমেলা খাতুন বলেন, ‘বিয়ের ৭ বছর পর স্বামীকে হারিয়েছি। তার কোনো ঘর ও জমি জমা ছিল না। নিজেদের জমি না থাকায় মানুষের ঘরে ভাড়া থেকেছি। ঘর ভাড়া দিতে দেরি হওয়ায় কত কথা শুনতে হয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জামেলা খাতুন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানে আজকে আমিসহ  অনেকে পাকা ঘর পেয়েছে। আমরা তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। এখন থেকে আমিও ঘরের মালিক। ভাড়া দিতে দেরি হলে আর কারো কটু কথা শুনতে হবে না।’

খালের পাড়ে ঝুপড়ির ঘরে করে থাকা শাহ আলম ফরাজিও এবার আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় পাকা ঘর পাচ্ছেন। ভোলার দৌলতখান উপজেলার চর পাতা ইউনিয়নে তার পৈত্রিক নিবাস। নদীভাঙনে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন তিনি। হারান বাপ-দাদার ভিটেমাটি। শূন্য হাতে চলে আসেন মধ্য চর আইচায়। খালের পাড়ে পলিথিন আর খড়কুটো দিয়ে ঘর তুলে বসবাস শুরু করেন। এভাবেই কেটে গেছে তার জীবনের ৭৫ বছর। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দুই শতাংশ জমিসহ পাকা ঘর দিচ্ছেন। মঙ্গলবার সেই ঘর বুঝে পাবেন। জমিসহ ঘর পাওয়ায় তিনি খুবই খুশি।

শাহ আলম ফরাজি বলেন, নদী আমার বাপ-দাদার ভিটেমাটি কেড়ে নিয়েছে। এর পর থেকে আমি ভূমিহীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি। নিজের কোনো জমি নেই। খালের পাড়ে ঘর তুলে থেকেছি। সমাজের বাইরে ছিলাম। আমার কোনো ঠিকানা ছিল না। আমি ও আমার পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তার জন‌্য দোয়া করি, আল্লাহ তাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুন। 

ভোলা জেলায় সরাসরি ১ হাজার ২৩৪টি ঘর ভূমিহীন-গৃহহীনদের মাঝে হস্তান্তর করা হবে মঙ্গলবার (১০ জুন)। আগেই ভোলা সদরকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এবার এ জেলার আরও তিন উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হবে।

এ প্রসঙ্গে ভোলার জেলা প্রশাসক ( ডিসি)  আরিফুজ্জামান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীন ও  ভূমিহীনদের ঘর দেবেন। ইতোমধ্যে ভোলা সদর উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি ছয় উপজেলাকে ভূমিহীনমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে জমি ও ঘর দেওয়া হচ্ছে। মোট ৬ হাজার ৩৫৬টি ঘর আমরা বরাদ্দ পেয়েছি। ভোলার চরফ্যাশন, বোরহানউদ্দিন ও মনপুরা উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে ৭০টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হবে। এর মাধ্যমে মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশকে গৃহহীন ও ভূমিহীন মুক্ত করার প্রত্যয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশ। এক ধাপ এগিয়ে যাবে এসডিজি বাস্তবায়নের পথেও।

তিনি বলেন, ‘ভোলা নদীভাঙনকবলিত এলাকা। এখানে প্রতিনিয়ম মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়। তখন ভূমিহীন হয়ে পড়ে। সেসব নিঃস্ব, অসহায় মানুষকে আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হবে। বিভিন্ন প্রকার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় তাদের কর্মসংস্থান করা হবে।’ 

আশ্রয়ন প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম পর্যায়ে সারাদেশে ২ লাখ ৬৬ হাজার ১২টি পরিবারকে ২ শতক করে খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে নির্মিত গৃহ হস্তান্তর করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ইতোপূর্বে ৬ দফায় ৩২টি জেলার সকল উপজেলাসহ মোট ৩৯৪টি উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে রয়েছে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, গাইবন্দা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, বরিশাল, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ ২৬টি জেলা।

এলাকার জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদদের সাথে সমন্বয় করে চরফ্যাশনের আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে, জানিয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, অনুন্নত খাস জমিগুলোকে আশ্রয়ন প্রকল্পের উপযোগী করতে কিছুটা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হয়েছে। যেহেতু, আমরা দেশকে ভালোবাসি এবং এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রকল্প এবং মানুষের সাথে সম্পৃক্ত; সুতরাং আমরা কোন কিছুকে প্রশ্রয় না দিয়ে কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়, সেটি খেয়াল করছি। ৪৮.১ একর খাস জমি দখলমুক্ত করে অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

পারভেজ/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়