ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর তুলনা আসলে বঙ্গবন্ধুই

তানভীর মাজহার তান্না || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৬, ১৫ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১১:৫৮, ১৬ আগস্ট ২০২১
বঙ্গবন্ধুর তুলনা আসলে বঙ্গবন্ধুই

আমি ধানমন্ডি ক্লাবে ফুটবল খেলতাম। কতই-বা হবে তখন বয়স? তেরো কি চৌদ্দ। ওখানে কামালও খেলতো, সেসময় আমি সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়ি। খেলার মাঠেই শেখ কামালের সঙ্গে পরিচয়। ও ক্রিকেটও খেলতো। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের হয়ে আমিও তখন ক্রিকেট খেলি। উদিতি ক্লাবের সীতারাম ভাই, জীবন ভাই, মাসুদ ভাই এদের সঙ্গে কামালও ক্রিকেট খেলতো। সেই ক্রিকেট অনুশীলনে আমিও ছিলাম। তো এভাবে খেলতে খেলতেই কামালের সঙ্গে বন্ধুত্ব। আমরা ভালো বন্ধু হলাম। কামাল আমাকে তার বত্রিশ নম্বরের ওই বাসায় নিয়ে যেত। আমার তখন সবকিছু জুড়ে শুধু স্পোর্টস।

১৯৬৫ সালে শাহীন স্কুলে ভর্তি হলাম। কামালও একই স্কুলে আমার সহপাঠী। ক্লাস নাইনের আর্টস বিভাগে আমরা সবমিলিয়ে সম্ভবত ২০ জনের মতো ছিলাম। শুধু মাঠে না, স্কুলে আমরা জুটির মতো ছিলাম। ক্লাসে পাশাপাশি বসতাম আমরা। কামাল শুধু ফুটবল বা ক্রিকেট নয়, বাস্কেটবলও ভালো খেলতে পারতো। আমি ক্রিকেট খেলতাম ভিক্টোরিয়ায়। কামাল উদিতি ক্লাবে।

স্কুল-মাঠ-খেলা এসব কিছু নিয়েই আমাদের দিন কাটছিল। তখন রাজনীতি নিয়ে কিছুটা ধারণা থাকলেও আমি মূলত বঙ্গবন্ধুকে চিনতাম কামালের আব্বা- এই হিসেবেই। আমি তাঁকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করতাম। বত্রিশ নম্বরে কামালের সঙ্গে ওর বাসায় গেলে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে কথা বলতেন। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, খোঁজ নিতেন। ভীষণ আশ্বাস দেওয়া এবং আদুরে গলায় বলতেন-‘ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে।’

আজও যখন আমি বঙ্গবন্ধুর ছবির দিতে তাকাই তাঁর সেই কণ্ঠস্বর মনে পড়ে- ‘ভালো মানুষ হতে হবে।’

সম্ভবত সালটা ১৯৬৮ বা ১৯৬৯ হবে। কামাল একদিন আমাকে ফোন করে বলল, জলদি বাসায় আয়। আমি তাড়াহুড়ো করে ওর বাসায় ছুটলাম। আমরা তখন ধানমন্ডি ২৪ এ থাকি। বেশি দেরি হলো না ওর বাসায় যেতে। গিয়ে দেখি বত্রিশ নম্বরের বাসার সেই পোর্চে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে একটা পুলিশের জিপ দাঁড়ানো। আমি একটু অবাক। খোঁজ নিচ্ছি কী হচ্ছে? এরই মধ্যে দেখলাম বঙ্গবন্ধু এলেন। হাত নেড়ে সবাইকে বললেন, আমি যাচ্ছি, দেখা হবে পরে সবার সঙ্গে। গেলাম। 
একজন সহকারী একটা স্যুটকেস নিয়ে গাড়িতে রাখল। বঙ্গবন্ধু ডাঁটের সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসলেন। আমি তখনো বুঝতে পারিনি কী হচ্ছে? কামালকে জিজ্ঞেস করতেই ও বলল, ‘আব্বাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়।’

পুলিশের জিপে কেউ এমন দৃঢ়তা নিয়ে উঠতে পারে এটা সম্ভবত তাকেই মানায়! কি বিশাল ব্যক্তিত্ব!

স্বাধীনতার পরে আমরা যখন আবাহনী ক্লাব গঠন করলাম তখন বঙ্গবন্ধুর আরো কাছে আসার সুযোগ হলো আমাদের। আমি ছিলাম আবাহনীর ফাউন্ডার ভাইস চেয়ারম্যান। ক্লাবের ফুটবল মূলত আমিই পরিচালনা করতাম। বঙ্গবন্ধু ফুটবল অনেক পছন্দ করতেন। আমরা যখন আবাহনী গঠন করলাম তখন ক্লাব পরিচালনার জন্য বেশ কিছু টাকা প্রয়োজন পড়ল। প্রায় ২৫/৩০ হাজার টাকা। আমরা তখন সবাই ছাত্র। এতো টাকা পাবো কোথায়? ছুটলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। বিকেলে অফিস শেষে বঙ্গবন্ধু বাসার ছাদে মাঝেমধ্যে ইজিচেয়ারে বসে গল্প করতেন। সেখানেই তাঁর কাছে গিয়ে আব্দার করলাম। সব শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, তোরা ক্লাব করেছিস, ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো সেখানে থাকতে পারবো না। আমি ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আমি তোদের সাহায্য করতে পারবো না। আর হ্যাঁ, কোনো ধনী লোকের কাছ থেকে টাকা নেয়া যাবে না। তোমাদের নিজেদের এই টাকা যোগাড় করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু আসলে সেই সময় ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের সাংগঠনিক দক্ষতা দেখতে চেয়েছিলেন বলেই এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা তখন আমাদের সামর্থ্যবান বন্ধুদের নিয়ে ক্লাবের তহবিল গঠন করি। আমাদের বন্ধু আজিজ এগিয়ে আসে। সেই সময় তার স্টিল মিল ছিল। সে আর্থিক সহায়তা করে।

আবাহনীকে এগিয়ে নিতে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। বিদেশি ফুটবল কোচ হিসেবে আইরিশ বিল হার্টসকে দায়িত্ব দেই। বিল হার্টস ফুটবল কৌশল বদলে দিলেন। ওয়ানটাচ ফুটবলের পদ্ধতি শেখালেন। বিদেশি কোচের এই স্টাইল বঙ্গবন্ধু খুব পছন্দ করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তরুণ এবং যুব সমাজই হচ্ছে অন্যতম শক্তি। আর এই শক্তিকে পরম নির্ভরতায় শক্তিমান করার জন্য ক্রীড়াঙ্গনই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। নিজে খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু জানতেন খেলার প্রতি আগ্রহী হলে, খেলার স্পিরিট মেনে চলতে শিখলে কেউ বিপথে যেতে পারে না। স্বাধীনতার পরপরই মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, পিডব্লইডি, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, ওয়ান্ডারার্সসহ বিভিন্ন ক্লাবকে খেলাধুলার উন্নয়নের জন্য তিনি নীরবে প্রায় সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মাত্রা ছিল তুলনাহীন। দেখামাত্র যে কাউকে নিজের করে নেওয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিল তাঁর- ভীষণ উদারমনা।

স্বাধীনতার পরপর পুরো দেশের অবকাঠামো ভাঙ্গাচোরা। রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট ধসে গেছে। অর্থনৈতিক অবস্থাও দুর্বল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন সব দিক সামাল দিতে বঙ্গবন্ধুর প্রচুর ব্যস্ততা। কিন্তু এত কঠিন সময়ের মধ্যেও দেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার ছিল।

বঙ্গবন্ধু একটা বিষয় বুঝতে পেরেছিলেন তরুণদের উদ্দীপ্ত করতে, তাদের মন মানসিকতায় আলো ছড়াতে দুটো আবশ্যিক শর্ত পালন করতেই হবে। প্রথমত শিক্ষা। দ্বিতীয়ত স্পোর্টস। তবে শুধু বাহ্যিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। শিক্ষার সঙ্গে স্পোর্টসের যদি একটা সমন্বয় না থাকে তাহলে আমি তো মনে করি সেই শিক্ষা অপূর্ণ। শিক্ষা আপনাকে শেখাবে। আর খেলা আপনাকে যা দেবে তার নাম শৃঙ্খলা। খেলায় কোচের নির্দেশ শোনা। সময়মতো অনুশীলনে আসা। স্পোর্টিং স্পিরিট। একজোট, একদল হয়ে খেলার অনুপ্রেরণায় নিজেকে শানিয়ে নেয়ার প্রবণতা। লড়তে শেখা। চেষ্টা করে যাওয়া। পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানো। জিততে জানা-এমন গুণাবলী অর্জন শুধু স্পোর্টস থেকেই সম্ভব। বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে এটা বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই শিক্ষা এবং স্পোর্টস যেন একজোট হয়ে চলে সেটাই তিনি করতে চেয়েছিলেন। খেলার জন্য বড় বাজেট বরাদ্দ তিনিই প্রথম করেছিলেন। তাঁর সময় প্রতিটি স্কুলে গেমস টিচারের একটা পদ ছিল। স্কুলে আন্তঃবিভাগ ক্রীড়ার আয়োজন ছিল। আন্তঃস্কুল খেলা ছিল। খেলার প্রতি ভালোবাসা কৈশোর থেকেই বেড়ে উঠলে সেই তরুণের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। তাই বঙ্গবন্ধু স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলা অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে আমি যতবারই বঙ্গবন্ধুর কাছে সমস্যা নিয়ে গিয়েছি, শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি হাসিমুখে তার সমাধান খুঁজে দিয়েছেন। সেই আশ্রয়, সেই ছায়া, সেই নির্ভরতাকে আমি আমৃত্যু মিস করবো। 

বঙ্গবন্ধুর তুলনা আসলে বঙ্গবন্ধুই। আর কিছু নয়! 

লেখক: ক্রিকেট সংগঠক, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার, বিসিবির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক, আবাহনী লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাকালীন ভাইস চেয়ারম্যান
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়