ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কেঁচো সার উৎপাদনে সফল উদ্যোক্তা হালিমা

কাওছার আহমেদ, টাঙ্গাইল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৫১, ২৮ মে ২০২৩  
কেঁচো সার উৎপাদনে সফল উদ্যোক্তা হালিমা

২০ বছর আগে স্কুলে পড়ুয়া অবস্থায় বিয়ে হালিমা বেগমের। স্বামীর কাপড়ের ব্যবসার পাশাপাশি তিনিও টেইলার্সের কাজ করে কোন রকম সংসার চালাতে থাকেন। পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে ১৪ বছর আগে ভার্মি কমপোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। কৃষি অফিসের সহযোগিতায় তিনি বসত ভিটায় কেঁচোর উৎপাদন শুরু করেন। সার উৎপাদন হলেও বিক্রি না হওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েন। পরবর্তীতে মাঠ দিবসসহ বিভিন্নভাবে তার সারের প্রচারণা শুরু করেন। বর্তমানে প্রতি মাসে দুই থেকে তিন টন কেঁচো সার উৎপাদন করে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন হালিমা বেমম।

তিনি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রাবনা নয়াপাড়া গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রী। তার সার উৎপাদনের কারণে পাশ্ববর্তীতে নারী পুরুষের কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি অনেক নারী কেঁচো সার উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারাও সফলতা পেয়েছেন। 

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কেঁচো সার ব্যবহার করলে ফসলের উৎপাদন ও গুণাগুণ বৃদ্ধি পায় এবং চাষের খরচ কম হয়। উৎপাদিত ফসলের বর্ণ, স্বাদ, গন্ধ হয় আকর্ষণীয়। ভার্মি কম্পোষ্ট´ বা কেঁচো সারে মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বায়ু চলাচল বৃদ্ধি পায়। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। আর মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায় বিধায় কেঁচো সার ব্যবহারে সেচের পানি কম লাগে। ক্ষারীয় লবণাক্ত মাটিতেও চাষাবাদ সম্ভব। রোগ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। জমিতে আগাছার ঝামেলা কম হয়। ফসলের বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। অধিক কুশি, ছড়া ও দানা গঠন হয়। মাটির বুনট উন্নত হয়। রাসায়নিক সারের চাইতে খরচ অনেক কম হয় এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকে।

হালিমা বেগম জানান, দশম শ্রেনী পড়ুয়া হালিমা বেগমের ২০০৩ সালে বিয়ে হয়। তার স্বামী পাশ্ববর্তী রসুলপুর বাজারের কাপড়ের ব্যবসার করে কোন রকম সংসার চালাতেন। সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে ২০০৮ সালে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় তার বসত ভিটায় দুটি রিং দিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। সার উৎপাদন হলেও বিক্রি না হওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েন। পরে তিনি আস্তে আস্তে সারের উৎপাদন বন্ধ রাখার চেষ্টা করেন। ২০১৫ সালে তিনি আবার সার উৎপাদন শুরু করেন। বিক্রি না হওয়ায় তিনি ঋণ করে গাভী পালন শুরু করেন। সেই গাভীর দুধ বিক্রি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। 

২০১৯ সালে দুটি গাভীর মধ্যে একটি গাভী মারা যায়। এতে তিনি তিন লক্ষাধিক টাকা ঋণ হন। পরে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় আবার কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। পরে তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার টিনের ঘরে বড় বড় ১০ টি হাউজে সার উৎপাদন হচ্ছে। এতে তার স্বামী, বিদেশ ফেরত ভাই ও স্থানীয় নারী পুরুষদের কর্মসংস্থান হয়েছে। তার উৎপাদিত ‘এম এম ভার্মি কম্পোস্ট’ সার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে। খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। তার সার উৎপাদন দেখে অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছে। 

তিনি আরও জানান, তার গরুর খামারের গোবর ও পঁচা ঘাস এবং মাটি হাউজে দিয়ে কেঁচো ছেড়ে দেন। ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সার উৎপাদন হচ্ছে। তার উৎপাদিত জৈব সার দিয়ে বাড়ীর আঙিনায় করল্লা, ডাটা, পাটশাক, ঢেরশ, লাউ, কুমরা, আলুসহ বিভিন্ন রকমের সবজি চাষ করে সফলতা মুখ দেখেছেন। গৃহিনী, দুস্থ, স্বামী পরিত্যাক্তা, বিধবা মহিলাদের কেঁেচা সার উৎপাদনে উৎসাহিত করে একটা ‘নারী স্বপ্ন উন্নয়ন সংগঠন’ নামে একটা সমিতি করেছেন। যেখানে হালিমা বেগম সভাপতি এবং সাথী আক্তার সম্পাদক। সদস্য সংখ্যা ৫২জন। প্রতি বৃহস্পতিবার তারা একত্র হয়ে উন্নয়নমূলক আলোচনা করেন। 

রাবনা নয়াপাড়া গ্রামের গৃহবধু শিল্পী বেগম ও মনিরা বেগম বলেন, আমরাও হালিমা বেগমের পরামর্শ ও সহযোগিতায় সার উৎপাদনে সফল হয়েছি। আমাদেরও এই সার থেকে বাড়তি আয় হচ্ছে। 

হালিমা বেগম বলেন, স্বামীর সংসারে বছরে পর বছর খুব কষ্টে দিন পার করছি। এখন জৈব সার উৎপাদনে আমি সফল। প্রথমে দুটি রিং থেকে সাত রিং ও পরবর্তীতে ৩২ টি রিং দিয়ে সার উৎপাদন করেছি। বর্তমানে বড় বড় ১০ টি হাউজে মাসে দুই থেকে তিন টন সার উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি কেজি সার ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমার উৎপাদিত সার ধান, বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ড্রাগন চাষে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়াও শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ে ছাদ বাগানে জৈব সার ব্যবহার হয়। 

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন উপ-সহকারী লতিফা আক্তার বলেন, কেঁচো সার প্রয়োগে যে কোনো ফসলের ফলন ভালো হয়। ফসলের রোগবালাই কম হয়। মাটির গুণাগুণ বেড়ে যায়। কৃষি অফিস থেকে উদ্যোক্তাদের এই সার ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়