ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

তিথির সাহসিকতা

তানজিনা ইভা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিথির সাহসিকতা

প্রতীকী ছবি

তানজিনা ইভা : তিথি সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। পুরো নাম জান্নাতুল তিথি। তিন বোন এক ভাই। সবার ছোট ভাই। তার বড় তিথি। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। বড় দুলাভাই অটো চালায়। বড় বোনের দুই সন্তান। মেজো দুলাইভাই কৃষক। তাদের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভাল না। বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকলে বোধহয় মেয়েদের খুব বেশি ভালো জায়গায় বিয়ে হয় না!

তিথীর বাবা দিনমজুর। টানাপড়েনের সংসার। তাই বড় দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। তবে মেয়েদের পড়ার প্রতি বাবার আগ্রহ কোনো কালেই ছিল না। এ কারণেই তো প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ শেষ করতে না করতেই দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার ইচ্ছা ছোট ছেলে বিল্টুকে পড়াশোনা করাতে হবে। ওকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারলেই তো তার কষ্ট দূর হবে।

তবে তিথির মায়ের চিন্তা অন্যরকম। তার মতে, দুই মেয়ের বিয়ে যখন হয়ে গেছে এখন তো আর কিছু করা যাবে না। তাদের বিয়েতেও মায়ের মত ছিলো না। তাতে কী? মেয়ের বিয়ের বিষয়ে মায়ের মত থাকলেই কী, আর না থাকলেই কী? তিথির মায়ের ইচ্ছা তিথি ও বিল্টুকে ভালোভাবে পড়াশোনা করাতে হবে। মানুষের মতো মানুষ করতে হবে।

তিথিরও সেই স্বপ্ন। সে পড়ালেখা করতে চায়। চাকরি করতে চায়। যেতে চায় বহুদূর। হতে চায় সমাজের উদাহরণ। সবাই তাকে দেখিয়ে বলবে দেখো মেয়েটাকে, কোথা থেকে কোথায় গেছে। তবে এ নিয়ে তার মনে সংশয়ও রয়েছে। সংশয় তার আত্মবিশ্বাস নিয়ে নয়, বাবাকে নিয়ে। ইতিমধ্যে তার বিয়ে নিয়ে বেশ কয়েকবার কথা বলেছেন বাবা। তিথি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে বিয়ে করবে না। সে পড়ালেখা করবে।

তিথি খুব দূরন্ত প্রকৃতির মেয়ে। সবকিছুতে তার দস্যিপনা। বয়স কম হলে কী হবে, মায়ের কাজে সাহায্য করে তিথি। বাবা কাজ শেষে বাড়িতে ফিরলে তার হাত-মুখ ধোওয়া পানি এগিয়ে দেবে, হাতে তুলে দেবে গামছাটা। ছোট ভাই বিল্টু এবার তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। তিথি-ই তার শিক্ষক। মাগরিবের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতি জ্বেলে বারান্দায় খেঁজুর পাটি বিছিয়ে ভাইকে নিয়ে পড়তে বসে। ভোরে উঠে আরবি পড়তে যায় মকতবে। তারপর বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়া করে যায় স্কুলে। ক্লাসে সে দলনেতা। তার মধ্যে যেন একটা নেতৃত্ব ভাব রয়েছে।

তিথির স্কুলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার আর ২০ দিন বাকি। সেদিন বাড়িতে দুই দুলাভাই এসেছিল তিথির বিয়ের বিষয়ে কথা বলার জন্য। তিথির বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বাবাও রাজি হয়েছেন। ছেলে তার থেকে ১০ বছরের বড়। বাজারে কসমেটিকসের দোকান আছে। ছেলেরা দুই ভাই, এক বোন। বড় ভাই আর বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেই ছোট। ছেলের বাবার ৪-৫ বিঘা ধানি জমি আছে। তিথির বাবা তার দুলাভাইয়েদের জানিয়েছেন, তাদের যখন পছন্দ, তাতেই হবে।

আগামী শুক্রবার দিন ঠিক হয়েছে। ছেলে পক্ষ তিথিকে দেখতে আসবে। তিথি এ কথা শোনার পরই বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে সে বিয়ে করবে না, পড়ালেখা করতে চায়। তিথির মায়েরও একই কথা। তিথি আর তার মায়ের কথায় কিছু আসে যায় না তার বাবার। তিনি যখন ঠিক করেছেন, বিয়ে দেবেন-ই।

নির্ধারিত দিনে ছেলে পক্ষ তিথিকে দেখতে এসেছে। তাকে দেখে ছেলে পক্ষের পছন্দ হয়েছে। তারা ওই দিনই বিয়ের দিন ঠিক করে গেছে। এক শুক্রবার বাদে পরের শুক্রবার বিয়ে। তারপরের দিনই তো তিথির স্কুলে পরীক্ষা শুরু হবে। দেনাপাওনা তেমন কিছু নেই। শুধু মেয়েকে সাজিয়ে দিলেই হবে!

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে এলো। তিথি কী করবে তা বুঝতে পারছে না। তার বিয়ে নিয়ে মা-বাবার বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছে। মায়ের কথায় কর্ণপাত করছে না ওর বাবা। তিথি কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু ঠিক করেছে এই বিয়েটা সে করবে না। যে ভাবেই হোক এটা ভাঙতে হবে। তিথি এটাও ভালো কারে জানে তার মা চাইলেও কিছু করতে পারবে না। এ কারণে তাকে অন্য পথ বেছে নিতে হবে। যেই কথা, সেই কাজ।

বিয়ের আগের দিন তিথি গেছে স্কুলের হেড মাস্টার শহিদুল হকের কাছে। তার কাছে সব কথা খুলে বলে এবং তিথির ইচ্ছের কথা জানায়। শহিদুল হক স্যার সব কথা শুনে তিথিকে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়িতে যায়। তিথির বাবার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু কাজ হয় না। তিথির বাবা জানায়, ভালো সম্বন্ধ, এ ছেলেকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।

শহিদুল হক তিথিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার স্কুলের দিকে যাচ্ছে। কী করে এই বিয়ে বন্ধ করা যায়- সেই চিন্তা করছে। এদিকে তিথি বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দৌঁড়ে যায় স্যারের পেছন পেছন। তিথি স্যারকে জানায়, সে থানায় যাবে। তার দুলাভাই আর বাবার নামে মামলা করবে। তবু বিয়ে করবে না। তিথির স্যারও তার কথায় সায় দিলো।

স্যার তিথিকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গেল। তিথি ঠিকই তার বাবা আর দুলাভাইদের নামে নালিশ করল। অবশ্য অনেক ভয়ে ভয়ে আছে তিথি। এরপর যে বাবা কী করবে তা ভেবেই গা শিউরে উঠছে। তিথি ভয়ে ভয়ে বাড়িতে গিয়ে ঘরের কোণে বসে আছে। কাউকে কিছু বলেনি। ওই দিনই পুলিশ এসেছে তিথিদের বাড়িতে। তিথির বাবাকে হুঁশিয়ারি করে দিয়ে গেছে। জানিয়েছে, তিথিকে বিয়ে দিলে বাল্য বিবাহ আইনে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। আইনে আছে, বাল্য বিবাহের সঙ্গে জড়িতদের দুই বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।

পুলিশ চলে গেছে। তিথির বাবার খুব মন খারাপ। তিনি তার দুই জামাইকে ডেকে বিয়ে বাতিল করতে বলেছেন। তবে তিথি ও তার মা খুব খুশি। এবারের যাত্রায় বেঁচে গেলো তিথি।

 

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/ইভা/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়