আমার কাছে শিক্ষক মানে আলোর ভুবন
অনন্য প্রতীক রাউত || রাইজিংবিডি.কম
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মানুষ গড়ার সূতিকাগার, আর একজন শিক্ষক হলেন সেখানকার কারিগর। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি সুনিপুণ দক্ষতায় একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। প্রাণী জগতের অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা হিসেবে বোধশক্তি জাগ্রত করণে এই শিক্ষকরাই রাখেন অবিরাম ভূমিকা।
যার কাছ থেকে আপনি একটি নতুন শব্দ শিখবেন, তিনিই আপনার শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে গুরুজনদের কাছে এসব কথা সবাই আমরা শুনেছি। জীবনে নতুনত্বের সন্ধান দেওয়া, আলোর দিশারী বা পথপদর্শক ব্যক্তিই শিক্ষক। জীবনে সফলতা অর্জনের পিছনে থাকে যার সুনিপুণ দক্ষতা বা দিক-নির্দেশনা। তিনি আলোর মতো সরলরেখায় অবিরাম বিলিয়ে যান জ্ঞানের ভাণ্ডার। সুস্থ, রুচিশীল জাতি গঠনে থাকেন সবার সামনের সারিতে।
‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটিকে সর্বক্ষণ বাস্তবরূপ দিয়েছেন, তাঁরাই শিক্ষক। এ জগতের মহান পেশাগুলোর মধ্যে শিক্ষকতা সবার উপরে। ইংরেজিতে বলা হয় ‘Teaching is a noble profession’।একজন শিক্ষকের সন্মান সবার উপরে হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে তাঁদের অবস্থা অন্য দেশের চেয়ে ব্যতিক্রম। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন শিক্ষক আছেন অহরহ। যারা দিনশেষে নিজের কথা না ভেবে, ভেবে যাচ্ছেন প্রিয় ছাত্রদের কথা। কারণ, তাঁর হাতে গড়া শিক্ষার্থীরাই একদিন দেশকে নেতৃত্ব দেয়, হাল ধরে আগামীর বাংলাদেশের।
প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশারও বিকাশ লাভ করেছে। এক সময় গ্রামীণ কোনো বটতলায় শিক্ষকরা খুলতেন পাঠশালা। বিলিয়ে দিতেন সমৃদ্ধির আলো। কালের পরিক্রমায় বটতলা পরিণত হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। পাল্টেছে শিক্ষার ধরন, বেড়েছে শিক্ষার হার। গুণগত মান কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই বিতর্কে না যাওয়াই সমীচীন। কেননা, যেভাবেই হোক এ প্রজন্মই তো একসময় দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তাই সমলোচনা না করে অনুপ্রেরণা প্রদান করা উচিৎ। যেন বাঁধামুক্ত হয় তাঁদের পথ পরিক্রমা। শিক্ষকরা যেন তাঁদের সর্বোচ্চ ইতিবাচক স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাতে পারেন মেধার, মননের সেটাই কামনা।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, বটতলার শিক্ষাব্যবস্থা বদলে গেছে ঠিকই, তবে তখনকার মতো মানুষ হওয়ার শিক্ষা এখন আর নাই। সেটিও পাল্টে গেছে আমাদের অনৈতিক চর্চার আড়ালে। মুখস্থ আর জিপিএ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা ঢুকে গেছি। বাড়ছে নম্বরের বোঝা, তবে কমছে মনুষ্যত্ব বোধের অবস্থান হৃদয় থেকে। এটার জন্য আমরা যেমন দায়ী, তেমননি অনেক অপেশাদার শিক্ষক নামধারী কিছু অশিক্ষক দায়ী৷ যারা নিজের অর্থবিত্ত বা ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রমাগত পথ ভ্রষ্ট করাচ্ছেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে। ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ধারাকে। তাদের সুস্থ বোধের হোক উদয়, রক্ষা পাক দেশ ও জাতি।
ভালো-মন্দের দোলাচলেই জীবন। স্বাভাবিকতার মাঝে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকেই। সেজন্য, পুরো শিক্ষক সমাজের দিকে আঙ্গুল তোলা বোকামির শামিল। শিক্ষক দিবসের মতো মহান দিনে নেতিবাচকতার দিকে ইঙ্গিত দিতে চাই না আর। ছাত্র ও শিক্ষক সম্পর্ক আসলে বন্ধুর মতো হওয়া উচিৎ যেন ‘প্রোপার কমিউনিকেশন’ সৃষ্টি হয়। বৃদ্ধি পায় গুণগত মান। বেত নিয়ে দৌড়াবেন শিক্ষক, ছাত্র ভয়ে পড়বে, এটা আসলে প্রাচীন থিওরি।
এখন পড়াশোনার ধরনের ক্ষেত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন। বাংলাদেশেও যার ছোঁয়া লেগেছে দারুণভাবে। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় মোড় নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে এই দশকেই। বছরের প্রথম দিন ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া যার যৌক্তিক উদাহরণ। পাশাপাশি শিক্ষাকে জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে, নুন আনতে সন্মানিত শিক্ষকদের আর পান্তা ফুরিয়ে যায় না। অন্তঃর্ভুক্ত করা হয়েছে চাকরির বয়স সাপেক্ষে বিভিন্ন ধরনের টাইম স্কেল এবং বিশেষ ভাতার।
বর্তমান সরকার সর্বক্ষেত্রেই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বা গুরুত্ব প্রদানের বিষয়ে সচেষ্ট। দুভার্গ্যবশত, নানা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে নানা সময়ে শিক্ষকরা নির্যাতিত হয়েছেন। পত্র-পত্রিকায় বারবার নিউজ এসেছে। কোথাও কোনো নেতার তরফ থেকে তার অন্যায় অনুরোধ না রাখায় শিক্ষককে করা হয়েছে লাঞ্চিত, কোথাও বা পরীক্ষার হলে নকল ধরায় হত্যা। জাতি হিসাবে এসব আমাদের ভাবমূর্তিকে কোন পর্যায়ে নিয়েছে একবার ভাবুন বা নিজেকে প্রশ্ন করুন? নানা জটিলতা বা অস্থিরতার মাঝেও শিক্ষকরা সচেষ্ট থাকেন একটি সৃজনশীল জাতি উপহার দিতে, সেখানে এ ধরনের অমানবিক তথা ক্ষমার অযোগ্য ঘটনা আমাদের হতাশ বৈকি কিছুই করে না।
আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন ব্যতীত এসব কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরা প্রায় অসম্ভব। এ ধরনের অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আমাদের সবার প্রতিবাদী ভূমিকাতে অবতীর্ণ হওয়াটাও সময়োপযোগী আমার মতে। তবেই, রক্ষিত হবে শিক্ষাগুরুর সঠিক মর্যাদা। স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল এবং কলেজ সর্ব ক্ষেত্রেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে শিক্ষকরা সর্বোচ্চটা বিলিয়ে দেন বলেই সৃষ্টি হয় বড় গবেষক কিংবা দেশের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া বীর সন্তানদের।
‘আরেহ তোরা বাচ্চা মানুষ ভুল করবিই তো, আমরা বলবোই, ওসব মনে রাখতে নেই পাগল’ শিক্ষকদের তরফ থেকে পাওয়া এক অকৃপণ আর্শীবাদ সবার ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয় এভাবে। মোটাদাগে যদি বলি, অ, আ, ক, খ থেকে শুরু মহাকর্ষ সূত্র বা নানা গবেষণার যৌক্তিক ফলাফল সব কিছুতেই লুকিয়ে থাকে শিক্ষকদের সুপ্ত নির্দেশনার বর্ণিল আলোকসজ্জার ছাপ।
স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের বাইরে সবার জীবনে একজন স্রষ্টা প্রদত্ত শিক্ষক থাকেন। যার হাত ধরে শুরু হয় সন্তানের প্রথম পথচলা। যার কাছ থেকেই একজন মানুষ প্রথম কিছু শিখে। প্রথম যা শিখে সেই শব্দটাও ‘মা’ এবং ব্যক্তিও নিঃসন্দেহে মা। যিনি পৃথিবীতে সন্তানের সবচেয়ে আপন এবং অকৃত্রিম বন্ধু। তাই, মাকে জীবনের শিক্ষকের মর্যাদা না দেওয়াটা অদূরদর্শীতা ব্যতীত কিছু নয় আমার কাছে। শিক্ষক এবং মা দুজনেই একজন সন্তানের সর্বোচ্চ ভালো নিশ্চিতে কাজ করেন সমান্তরালভাবে৷ সেই বিবেচনায় বলা যায়, ‘Mother is the first teacher and teacher is the second mother’.
পৃথিবীর সব শিক্ষক পাক সর্বোচ্চ সন্মান ও ভালোবাসা এ মোর চির আকুণ্ঠ প্রত্যাশা। আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষকদের তরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো অবিরাম। সব ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন প্রিয় আলোর পথের দিক-নির্দেশনাকারী দিশারীদ্বয় এ মোর এক চরম আকাঙ্ক্ষা। সবাই ধারণ করুক ছন্দের শেষোক্ত উক্তিটি-
‘হে প্রিয় শিক্ষক কিসে করিব আপনাকে অপমান
আমার আমিত্ব, আপনার ই যে দান।’
শুভ কামনা সব শিক্ষকের তরে। বৃদ্ধি পাক শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা। এগিয়ে যাক প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ তাঁদের হাত ধরে। সব অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে শুভ বোধের প্রতীক হিসাবে মনুষ্যত্ববোধের জাগরণের বিকাশে শিক্ষকরা হোক উদাহরণ।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
জবি/মাহি