কে ছিলেন সুলতান সুলেমান?
মিলন আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম
শিল্পীর তুলিতে আঁকা সুলতান সুলেমান
মিলন আশরাফ : ফর্সা।গাঢ় বাদামি চোখ।ভ্রু জোড়া লাগানো।খাড়া সরু নাক। লম্বা পুরুষ্ট গোঁফ। সুসজ্জিত দাড়ি। দীর্ঘদেহী এবং সুদর্শন। কণ্ঠস্বর স্পষ্ট ভরাট। আত্মবিশ্বাসী, বীর, দৃঢ়চেতা এবং সর্বোপরি মহান শক্তিধর এই মানুষটির নাম সুলতান সুলেমান। ইউরোপের ইতিহাসবিদরা তাঁকে ‘গ্রেট ম্যাগনিফিসেন্ট হিরো’ বলে মানতেন। ইতিহাসের এই গ্রেট ম্যাগনিফিসেন্টের জন্ম ১৪৯৪ সালের ৬ নভেম্বর, সাগর পাড়ের ট্রাবজন নামক এলাকায়। আয়েশা হাফসা সুলতান তাঁর মায়ের নাম। বাবা সুলতান সেলিম-১।
সুলতান সুলেমানের ছিল মাহিজিবরান, খুররম, গুলফাম ও ফুলেন নামে চার স্ত্রী। পুত্র সন্তান ছিল আট জন। তাদের নাম যথাক্রমে : সেলিম-২, বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির এবং মোস্তাফা। মিহরিমান ও রেজায়ী নামে দুই কন্যা সন্তানও ছিল তাঁর।
জানা যায়, তিনি চেঙ্গিস খানের বংশধর। তোপকাপি প্রাসাদের স্কুলে সাত বছর বয়স থেকেই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য থেকে শুরু করে সামরিক বিদ্যা পর্যন্ত শিক্ষা নেন তিনি। এসব প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান মূলত তিনি ইস্তাম্বুলে গিয়ে তাঁর দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর কাছ থেকে পান। তবে তাঁর ওস্তাদের মধ্যে আরেকজন পৃথিবী বিখ্যাত পণ্ডিত খিজির আফেন্দিও ছিলেন। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত সুলতান তাঁর বাবার কাছে ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা, সততা, বুদ্ধি ও প্রতিভার গুণে ওই বয়সেই তিনি গর্ভনর নিযুক্ত হন। প্রথমে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সরকি প্রদেশে। এরপর একে একে বলু, হিসর ও কিফিতে।
ইস্তাম্বুলে সুলেমান তাঁর চাচাদের মধ্যে বিরোধ সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর পিতা যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ২৫। সাল ১৫২০। সকলের ইচ্ছায় তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফা বা সুলতান মনোনীত হন। তাঁর নামের প্রস্তাবে সাধারণ জনগণ, অমাত্য পাশাদের দিক থেকে বেশি সাড়া পাওয়া যায়। দ্বিমত করার কোনো লোক সে-সময় খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি আলেক্সান্ডারের চেয়েও শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন। উসমানীয় সাম্রাজ্যের নীতিমালা নতুন করে তৈরি করেন তিনি। তাঁর সেইসব নীতিমালা বহুদিন বহু শতাব্দী ধরে চালু ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যে। সে জন্যে প্রাচ্যে তাঁকে বলা হয় ‘বিধানকর্তা’। তাঁর সততা ও যোগ্যতার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই। সারাদেশ আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে। ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর আনুকূল্য ছিল আজীবন। তিনি আল কুরআনের আটটি খণ্ড নিজে কপি করে সুলাইমানিয়া মসজিদে সংরক্ষণ করেন। পবিত্র কাবারও সংস্কার করেন কিছু। তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতিও ছিলেন উদার। তাঁর শাসন আমলে আমরা দেখি ধর্মীয় কোন্দলের কারণে বহু প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক এসে আশ্রয় গ্রহণ করে নিরাপদে বসবাস শুরু করে তাঁর রাজ্যে। ইতিহাসবিদ লর্ড ক্রেজি সুলতান সম্পর্কে বলেন, ‘খ্রিস্টান জগতে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের অবিচারের সময়ে সুলাইমান যে প্রশংসার দাবি রাখে অন্য কেউ সেটা পারেননি।’
দুর্নীতি সহ্য করতে পারতেন না তিনি একদম । এ বিষয়ে কাউকে তিনি ন্যূনতম ছাড় দিতে নারাজ ছিলেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে তিনি তাঁর আপন জামাতাকেও গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দেন। পুরো সাম্রাজ্য অর্থাৎ খিলাফত তিনি ২১টি প্রদেশ ও ২৫০টি জেলায় বিভক্ত করে ফেলেন। এতে করে তাঁর শাসনকার্য পরিচালনা করতে সুবিধে হয়। রাজ্য বিস্তার করার লক্ষ্যে আইনের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেন তিনি। রাজ্যে ফিরিয়ে আনেন সুশৃঙ্খলা। তিনি একজন মহান রাজার পাশাপাশি ছিলেন একজন কবি। সুলেমানের শাসনামলে উসমানীয় সংস্কৃতির বিরাট উন্নতি হয় কেবল মাত্র তাঁর এই কবি মনোভাবের কারণে। তুর্কি ভাষাসহ তিনি ৫টি অন্যান্য ভাষায় কথা বলতে পারতেন। সেগুলো ছিল, আরবি, সার্বিয়, ফার্সি, উর্দু এবং সর্বশেষ বিলুপ্ত তুর্কি ভাষা চাগাতাই।
রণাঙ্গনেও সুলতান সুলেমান ছিলেন সমান পারদর্শী। তাঁর শাসনামলে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটে। তাঁর সেনাবাহিনী রোমান সাম্রাজ্য ও হাঙ্গেরির অনেক শহর করায়ত্ত্ব করে নেয়। যদিও তারা ভিয়েনা শহর দখল করতে ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি আফ্রিকায় আলজেরিয়াসহ অনেক বড় বড় অঞ্চলকে রোমান সাম্রাজ্যের হাত থেকে নিজের দখলে নিয়ে নেন। তাঁর নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বজায় রাখে তাদের আধিপত্য। ভারত মহাদেশ থেকে তিনি পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে এই উপমহাদেশে ব্যবসায়িক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটান।
এসব পরিচয়ের পাশাপাশি তাঁর দাম্ভিকতার পরিচয়ও উল্লেখযোগ্য। তিনি যে মহা পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন তার পরিচয় মেলে ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিসকে লেখা একটি চিঠিতে। তিনি লেখেন : ‘আমি সুলতানদের সুলতান। রাজার রাজা। পৃথিবীর সব রাজাদের মুকুটদাতা। আল্লাহর ছায়া থেকে শুরু করে শ্বেতসাগর, কৃষ্ণসাগর, রুমেলিয়া, আনাতোলিয়া, কারামানিয়া, রোম, জুলকাদ্রিয়া, দিয়ারবেকির, কুর্দিস্তান, আজারবাইজান, পারস্য, দামাস্ক, আলেপ্প, কায়রো, মক্কা, মদিনা, জেরুজালেম, সারা আরব, ইয়ামান এবং অন্যান্য সমস্ত দেশ যা আমার পূর্বপুরুষগণ (আল্লাহ তাদের কবরকে আলোকিত করুক) নিজ শক্তিবলে জয় করেছেন সেসব আমার বীরত্ববলে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি আমি। আমিই সেগুলোর সর্বেসর্বা কর্তা। আমি সুলতান সুলেমান খান। সুলতান সেলিম খানের পুত্র। সুলতান বায়েজিদ খানের পৌত্র। তোমার উদ্দেশ্যে ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস।’
অবশেষে এই মহান পরাক্রমশীল সুলতান ১৫৬৬ সালে ৭১ বছর বয়সে হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরে পরিচালিত এক অভিযানকালে নিজ তাঁবুতে আকস্মিকভাবে মারা যান। তাঁর মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক ও বার্ধক্যজনিত। অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমানে ইস্তাম্বুল) তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর মহান নাট্যকর উইলিয়াম শেকসপিয়ার ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকে প্রথম কোট করেছিলেন এই রাজাধিরাজের নাম।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ আগস্ট ২০১৬/তারা
রাইজিংবিডি.কম