ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

পুণ্যআশায় রথের মেলায়

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৯, ২০ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৯:১২, ২০ জুন ২০২৩
পুণ্যআশায় রথের মেলায়

প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব সাড়ম্বরে পালন করে। এর এক সপ্তাহ পর উল্টোরথ উৎসব হয়। রথে ডানে প্রভু জগন্নাথ, মাঝখানে তাঁর বোন সুভদ্রা এবং বামে বলভদ্র। অর্থাৎ কৃষ্ণ, সুভদ্রা ও বলরাম রথে আসীন থাকেন। ভক্তদের বিশ্বাস, রথোপরি আসীন দেবমূর্তি দর্শন ও রথ টেনে নেয়ার সুযোগ তাদের জন্য দেবতার আশীর্বাদ লাভের সহায়ক। 

কথাগুলো বলার কারণ প্রতি বছর আষাঢ় মাস এলেই ডেনির কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পাই সিলেটে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা দর্শনের। প্রায় একশ চুরানব্বই বছর ধরে চলে আসছে এই রথযাত্রা উৎসব। কিন্তু সময় কেন জানি  সময় দিচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত উপস্থিত হলাম রথযাত্রায়। দূর থেকে দেখা পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত রথের যেখানে আসীন আছেন প্রভু জগন্নাথ, মাঝখানে তাঁর বোন সুভদ্রা এবং বামে বলরাম। শত শত পুণ্যার্থী রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা দূর থেকে প্রণাম করলাম। এদিকে আমাদের পাইলট সাহেব বললেন আজ এই সড়কে জ্যাম থাকবে, সামনেই মেলা বসেছে তাই আপনারা হেঁটে গেলে অনেক আগেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন।

আমরা আর দেরী না করে পদব্রজে রওনা করলাম। আমাদের মতো শত শত মানুষ পদব্রজে এগিয়ে চলছে। সবারই সম্ভবত গন্তব্য রথের মেলার দিকে। কিছু দূর যেতেই দেখা পেলাম রাস্তার দুই পাশে মেলা বসেছে। মেলা কেন্দ্র করে জমে উঠেছে পুরো এলাকা। ছোট ছোট দোকানগুলোতে ছোট থেকে বড় সব শ্রেণীর মানুষের ভিড়। মাটির খেলনা, লেইস ফিতা, আসবাবপত্র, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, কাঠের সামগ্রী, হস্ত শিল্প, কারুপণ্য, তামা, কাঁসা, লোহা কি নেই মেলায়। দেখা পেলাম হাতের তৈরি কাপড়ের পুতুল নিয়ে বসেছেন এক বিক্রেতা। তাকে ঘিরে রেখেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। শহুরে জীবনে এমন পুতুল দেখতে পাওয়া যায় না। আমরা আমাদের বাসার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সপ্তকের জন্য পুতুল কিনলাম।

আমরা এগিয়ে চলছি কিন্তু রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ আমাদের মতো পদব্রজে চলছে এগিয়ে। এদিকে  মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরতেই ওপর প্রান্ত থেকে ডেনি বলে উঠলো- স্যার কি চলে এসেছেন? আরেকটু পরেই মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। তাই পা চালিয়ে চলে আসেন। আরেকটা কথা- মোবাইল, মানিব্যাগ খুব সাবধানে রাখবেন স্যার। আমি বললাম- পা চালাবো কীভাবে? সামনেই এগিয়ে যাওয়া দুষ্কর এতো মানবজট। এর পরেও আসার চেষ্টা করছি। 

আমরা চেষ্টা করলাম দ্রুত পা চালাতে। কিন্তু ডেনির দ্বিতীয় কথা মাথায় ঢুকে গেলো। তাই মোবাইল আর মানিব্যাগের প্রতি ধ্যান দেয়ার ও চেষ্টা করলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা মূল অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছালাম। ডেনি আগের থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাদের নিয়ে গেলো মূল অনুষ্ঠান স্থলে। একটি মাঠের ভেতর অনেকগুলো রথ। রথগুলো কাঠের তৈরি। মাটি থেকে উচ্চতা প্রায় বিশ-পঁচিশ ফুটের মতো হবে। প্রতিটি রথ খুব সুন্দর করে সাজানো। রথের চাকাগুলো ও কোনটি কাঠের আবার কোনটি সিমেন্টের। চারপাশে ধূপকাঠির মোহনীয় গন্ধ শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, ঢাক বেজেই চলছে । এ এক অন্য রকম পরিবেশ আমাদের নিয়ে গেলো এক অপার্থিব ভুবনে। দেখা হলো সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক কবি এ কে শেরামের সঙ্গে। সিলেটে মণিপুরীদের রথযাত্রা অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন রথযাত্রা অনুষ্ঠান সনাতন ধর্মাবলম্বী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী মণিপুরীদের এক প্রধানতম অনুষ্ঠান। সিলেট শহরে ১২টি মণিপুরী পাড়া আছে। প্রতিটি মণিপুরী পাড়া থেকে নির্ধারিত দিনে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব, সুভদ্রা, বলভদ্র ও অন্যান্য দেব-দেবীর বিগ্রহ দিয়ে সাজানো রথ টেনে নিয়ে আসা হয় রিকাবীবাজারের এই স্থানে। তারপর একসাথে আরতিসহ পূজার যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান শেষ করে সন্ধ্যার আগেই আবার রথ টেনে নিয়ে ফিরে আসা হয় নিজ নিজ মন্দির প্রাঙ্গনে। উল্টোরথ বা পুণযাত্রার দিনও একইভাবে রথ টানা হয়। তাছাড়া রথযাত্রার দশদিন ধরে প্রতিটি মণিপুরী পাড়ায় মন্দিরে রাতে বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং পাড়ার সকলকে খিচুরি মহাপ্রসাদ দিয়ে আপ্যায়িত করার প্রথা সেই প্রাচীন কাল থেকে চলে এসেছে এবং এখনও অব্যাহত আছে।

আমরা এগিয়ে গেলাম রথের দিকে। হাজার হাজার মানুষের মধ্যেও প্রতিটি রথ দেখার চেষ্টা করলাম। পূজা অর্চনা শুরু হয়েছে। প্রতিটি রথের মূল পুরোহিতরা একত্রিত হয়ে পূজা শুরু করেছেন। মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ আমাদের বিমোহিত করলো। শুরু হলো মঙ্গল আরতি। চারপাশে বেজে উঠলো খোল করতালের ধ্বনি। অসাধারণ পরিবেশ! সবাই প্রার্থনায় মগ্ন দেশ ও দশের মঙ্গল কামনায়। আমি পাপী মানুষ তারপরেও শামিল হলাম সবার সাথে। মঙ্গল আরতির পর লুট দেয়া হলে সবাই লুটের প্রসাদ গ্রহণ করলো। এবার আমাদের জগন্নাথদেবের প্রসাদ দেয়া হলো। আমরা ভক্তিভরে তা গ্রহণ করলাম। ডেনি আবার জগন্নাথদেবের গলার থেকে আমাদের ফুলের মালা এনে দিলো। 

দেখা পেলাম রথযাত্রা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নৃপেন্দ্র  সিংহের সাথে। আমাদের সাথে দেখা হতেই সাদরে গ্রহণ করলেন। তার কাছে জানতে চাইলাম সিলেটে মণিপুরীদের এই রথযাত্রার শুরুর ইতিহাস। তিনি বললেন কবে থেকে কীভাবে শুরু হয়েছিল এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে যে সিলেটে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তার বেশ আগে থেকেই এই অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়ে এসেছে তা শ্রী অচ্যুতচরণ চৌধুরী তও্বনিধি রচিত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে উল্লেখিত একটি ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট হয়। 

১৮২২ বা ১৮২৩ সালের দিকে রাজা গম্ভীরসিংহর অনুগামী হয় অনেক মণিপুরী প্রজা, যারা সিলেট শহর এবং পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেই সময়ে রাজা গম্ভীরসিংহ যেখানেই যেতেন সাথে তাদের রাজ পরিবারের কূলদেবতা শ্রীগোবিন্দজীর বিগ্রহ নিয়ে যেতেন। এবং সেখানে মন্দির নির্মাণপূর্বক  দেবতার প্রতিষ্ঠা করে রাজকূলদেবতা শ্রীগোবিন্দজীর নিয়মিত পূজা অর্চনার পাশাপাশি রথযাত্রা, রাস পূর্ণিমার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আয়োজন করতেন। এটাই ছিল প্রচলিত প্রথা। সিলেটেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেই সময়ে  রাজেন্দ্রবর্গ যেখানে বসতি স্থাপন করেন সেই এলাকাটি এখনো মণিপুরী রাজবাড়ী নামে পরিচিত। 

আজ সময়ের পরিক্রমায় দীর্ঘ একশ চুরানব্বই বছর ধরে আয়োজিত হয়ে আসছে এই রথযাত্রার অনুষ্ঠান। এদিকে রথ সমূহের নিজ দেবতা গৃহে ফেরার সময় হয়ে এলো। সবাই রথ নিয়ে ফিরে চললো দেবতা গৃহের দিকে। আমরাও রথের পেছনে পেছনে গেলাম পুণ্য লাভের আশায় রথের দরি ধরে টান দিলাম। কথিত আছে রথের দরি ধরে টানলে স্বর্গ লাভের পথ প্রশস্ত হয়। আমরা রথ টেনে রথের মেলা ঘুরে দেখতে গেলাম। এদিকে আমার পেটে রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এবার পেটে কিছু দিতেই হবে। দেখা পেলাম নিমকি , কাটাগজা, খাজা, খৈয়ের উফরা আরও কতো কি! সেখান থেকে পেট পূজার জন্য নিয়ে নিলাম নিমকি, কাটা গজা। পেট পূজা শেষ করে আমরা এগিয়ে চললাম। দেখতে দেখতে আমাদের সময় ফুরিয়ে এলো। এবার আমাদেরও ফিরে যেতে নিজ গৃহের দিকে।

এই উপলব্ধি প্রাপ্ত হলাম যে, মানুষের জীবন রথের প্রতীকমাত্র। ভোগের পথ ছেড়ে মুক্তির পথে যে যেতে চায় তার জীবন সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। শান্ত হতে হবে, সমাহিত হতে হবে। রথের রথী অর্থাৎ অন্তর্যামী, তিনি নির্লিপ্ত। তাঁর যথার্থ স্বরূপ এই নির্লিপ্ততা। সেই স্বরূপকে এই দেহরথের মধ্যে উপলব্ধি করতে হবে। অতি সূক্ষ্ম সে অন্তরাত্মা পুরুষ মানুষের হৃদয়ে সর্বদা অবস্থান করেন। তিনিই রথী। এ রথীর দর্শন বা সাক্ষাত হলে মুক্তি লাভ সম্ভব হয়।

যাবেন কীভাবে 

ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে। ভাড়া ৩৬০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে । সেখান থেকে রিকশায় রিকাবীবাজার রথের মেলায় যেতে ভাড়া নেবে ৬০ টাকা।  

শান্ত//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়