ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রাল : হাজার বছরের স্বর্গীয় ধাম

শাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৯ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রাল : হাজার বছরের স্বর্গীয় ধাম

মোনরিয়েল ক্যাথেড্রালের চ্যাপেল

শাহিদুল ইসলাম : সৃষ্টির আদিযুগ থেকে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো পবিত্রতার এক অনন্য নিদর্শন। ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তা পালনের জন্য তৈরি হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি, যেগুলোকে বলা হয় ধর্মীয় বিধিবিধান। আর এসব নিয়মনীতি যথাযথভাবে পালনের জন্য গড়ে ওঠে উপাসনালয়। যুগে যুগে উপাসনালয়গুলো ধর্মীয় আচার-আচরণের নিয়ন্ত্রক হিসেবে টিকে থাকলেও পাশাপাশি বিজ্ঞান, দর্শন এমনকি বিচারের কাজে তা ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে- এমন ভূরি ভূরি নজির আছে। ইতালির ‘প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রাল’ এমনি একটি গির্জা। শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আজো টিকে আছে গির্জাটি।

 

সিফ্যালু ক্যাথেড্রাল

 

বিশ্বে অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে বর্তমানে যে প্রচেষ্টা দেখা যায়, হাজার বছর আগেও যে এ ধারা অব্যাহত ছিল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রাল। এটি ইতালির অদূরে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি, সামুদ্রিক প্রবাল আর সেমুটা নদীবিধৌত নয়নাভিরাম দ্বীপাঞ্চল সিসিলির উত্তর উপকূলে অবস্থিত। সিসিলি ইতালির অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপাঞ্চল।

 

সিসিলি দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হলো হাজার বছরের পুরোনো প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রাল গির্জাটি। এ বছরের ৫ জুন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো) গির্জাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। নয়নাভিরাম এই গির্জার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন সব স্মৃতি, যা মানুষকে ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়ে আসছে শত শত বছর আগে থেকে।

 

সান্তা মারিয়া গির্জা

 

১১৩১ থেকে ১১৪৫ সালের মধ্যে নির্মিত হয় গির্জাটি। এর নির্মাণের পেছনের ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, নরম্যান রাজা দ্বিতীয় রজার মূলত এর প্রতিষ্ঠাতা। ১০৯১ সালে সিসিলি দ্বীপ দখল করেন দ্বিতীয় রজার। দ্বীপবাসীর মধ্যে ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সামাজিকতার জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। এই পরিকল্পনা থেকে গির্জা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তার শাসনামলেই এটি তৈরি হয়।

 

প্যালেরমোর নয়নাভিরাম দৃশ্য

 

তবে ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, প্রথমে একটি কাঠের গির্জা তৈরি করা হয়। পরে সেখানে এমন এক গির্জা স্থাপন করা হয়, যা ওই সময়ে ইতালিতে খুবই কম ছিল। রোমান স্থাপত্যশিল্পের নজির রয়েছে এই গির্জায়। এখন সেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের সমাগম হয়। কেউ যায় দেখতে, আবার কেউ যায় প্রাচীন এই গির্জায় ঈশ্বরের আরাধনা করতে।

 

প্যালাটাইন চ্যাপেল

 

প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রালটি স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। এটি আরব, নরম্যান বা রোমান এবং বাইজেনটাইন স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে  তৈরি। যতদূর জানা যায়, পৃথিবীর অন্য কোনো স্থাপনা তৈরিতে এমন তিনটি বিখ্যাত স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ ঘটানো হয়নি। চোখে না দেখলে আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এত পুরোনো অথচ এখনো কতটা চকচকে মনে হচ্ছে গির্জাটি।

 

প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রালটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে বিশাল প্রাসাদ। এই প্রাসাদটি রাজপ্রাসাদের মতো সাজানো-গোছানো। থাকা, খাওয়া, বিনোদনের যাবতীয় ব্যবস্থা আছে এর মধ্যে। মূল গির্জা ছাড়াও আছে কয়েকটি ছোট গির্জা। আছে ক্যাথেড্রাল। ছোট ছোট খালের ওপর গড়ে ওঠা সেতুগুলো টিকে আছে আজো।

 

প্যালেরমোর রয়্যাল প্যালেস

 

তবে এর মধ্যে সিফ্যালু ও মোনরিয়েল ক্যাথেড্রাল দুটি বিখ্যাত। শুনে অনেকেই আশ্চর্য হবেন, গির্জার কিছু কিছু অংশ মাটি দিয়ে তৈরি। আরো অবাক করা তথ্য হলো- এই মাটি জেরুজালেম থেকে বয়ে আনা হয়েছিল। যিশুখ্রিষ্টের জন্মস্থান জেরুজালেম। মহান যিশুর স্পর্শ রয়েছে যে মাটিতে, গির্জায় সেই মাটি থাকা মানে যিশুর পদধূলি পাওয়া। হয়তো এমন চেতনা থেকে জেরুজালেম থেকে মাটি বয়ে আনা হয়েছিল।

 

তবে গির্জাটি শুধু খ্রিষ্টানদের জন্য, এমন নয় কিন্তু। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এটি এমন এক স্থাপনা যার মধ্যে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য ও ঐতিহ্য মিলেমিশে রয়েছে।

 

মোনরিয়েল ক্যাথেড্রালের ভেতরের একটি অংশ

 

পাথরের বড় বড় খিলান, গম্বুজসহ পুরো ক্যাথেড্রাল অবাক করা সব কারুকার্য দিয়ে সাজানো। এর মধ্যে যিশুখ্রিষ্ট ও মা মেরির অসাধারণ ছবিগুলোই সবার আগে চোখে পড়ে। তবে ক্যাথেড্রালটি চাঁদের আলোয় এবং কৃত্রিম লাল আলোয় এক অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়ায়। লাল আলোয় দূর থেকে দেখলে মনে হয় এ যেন স্বর্গীয় এক ধাম, যা হাজার বছর পেরিয়েও স্বগৌরবে যিশুখ্রিষ্টের মহানুভবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 

সিসিলি দ্বীপ পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। তবে যারা সিসিলি দ্বীপে যায়, তারা প্যালেরমো ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রালে না গিয়ে কি থাকতে পারে! ধর্মীয় তীর্থ এখন পর্যটকদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে।

 

সিসিলি দ্বীপঘেরা ফেনিল নীল জলরাশি ও সিফ্যালু ক্যাথেড্রালের অপার সৌন্দর্য সব মিলিয়ে অবসরকালীন ভ্রমণের জন্য এটি এক আদর্শ স্থান।


লেখক : শিক্ষার্থী, টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্ট্যাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



**

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ আগস্ট ২০১৫/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়