বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী ‘মেঘনাদ’
টিপু || রাইজিংবিডি.কম
মেঘনাদ সাহা
শাহ মতিন টিপু : আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে ছড়িয়ে আছে কোটি কোটি নক্ষত্র। কী কী উপাদানে তৈরি সেইসব নক্ষত্র? নক্ষত্র থেকে বিকিরিত আলোক রশ্মির প্রকৃতিই বা কি? এসব তত্ত্ব জানতে কোমর বেঁধে হিসাব করতে শুরু করলেন একজন বাঙালি বিজ্ঞানী। এই বিজ্ঞানীর নাম মেঘনাদ সাহা।
তিনি নক্ষত্র থেকে বিকিরিত বর্ণালীতে বোর তত্ত্ব প্রয়োগ করে দেখেন, নক্ষত্রের ভেতরের উচ্চতাপমাত্রায় নক্ষত্রের গ্যাস পরমাণুগুলো আয়নিত হয়ে পড়ে। নক্ষত্রের উচ্চ তাপমাত্রার কারণে গ্যাস পরমাণু থেকে ইলেকট্রন খসে পড়ে, পরমাণু আয়নিত হয়ে যায়। তখন সেই আয়নিত পরমাণুর ভেতর থেকেই আলোক বর্ণালী নিঃসৃত হয়। আমরা সেই বর্ণালীকেই দেখি নক্ষত্রের আলোরূপে।
মেঘনাদ সাহা এই তাপ-আনয়ন তত্ত্ব প্রয়োগ করে সূর্যের বর্ণমালার আয়নন ও নিঃসৃত বর্ণালীর ব্যখ্যা প্রদান করেন। এটাই হলো তার তাপ-আয়নন সূত্র। এই থার্মাল আয়নাইজেসন তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন মেঘনাদ সাহা। তার আবিষ্কৃত ‘সাহা আয়োনাইজেসন সমীকরণ’ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মাবলী ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী কালে ব্ল্যাক হোল থিয়োরিতে সফলতার সাথে ব্যবহৃত হয়।
মেঘনাদ সাহার জন্মদিন আজ। ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার শেওড়াতলী গ্রামে বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানীর জন্ম। জগদীশচন্দ্র বসুর পর, মেঘনাদ সাহাই প্রথম বাঙালি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে অতি পরিচিত। উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লট্রন স্থাপিত হয় তার প্রচেষ্টায়। এই যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন পার্টিকেলের উপস্থিতি প্রমাণ করা যায়, বর্তমানে এটি বিগ ব্যাং থিয়োরি প্রমাণের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন চারবার। ধারণা করা হয় জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া চালু না হওয়ায় তিনি নোবেল পাননি। মেঘনাদ সাহা একজন স্বাপ্নিক বিজ্ঞানী। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানকে সাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্য করে তোলার অন্যতম প্রয়াসী ছিলেন তিনি। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন তিনি।
এই মহান বিজ্ঞানীর বাল্যকাল কাটে কঠোর দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থার মধ্য দিয়ে। এ কারণে মুদি ব্যবসায়ী বাবা জগন্নাথ সাহা ছোট বেলায়ই তাকে দোকানে বসিয়ে দেন। পরে বড় ভাইয়ের অনুরোধে পড়াতে রাজি হন। বাড়ি থেকে ১২-১৩ কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়া মডেল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করা হয়। প্রতিদিন বাড়ি থেকে এই পথ হেঁটে ক্লাশ করতেন মেঘনাদ। যা ওই বয়সে খুবই কঠিন ছিল।
অভাবের তাড়নায় বিদ্যালাভের সুযোগও হোঁচট খেয়েছে বার বার। শিমুলিয়া স্কুল থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। এর পরে ভর্তি হলেন কিশোরীলাল জুবলি স্কুলে। সেখান থেকে প্রবেশিকা পরিক্ষায় অংশ নিয়ে পূর্ববঙ্গের মধ্যে প্রথমস্থান লাভ করেন। ঢাকা কলেজ আইএসসি তে প্রথম শেণিতে তৃতীয় স্থান লাভ করে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে।
তিনি কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশকে সহপাঠী এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে পান শিক্ষক হিসেবে। গণিতে নিজের আগ্রহের কারণে তিনি স্যার প্রফুল্লের প্রিয় ছাত্রদের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেন। তিনি প্রথম শ্রেনিতে দ্বিতীয় হয়ে গণিতে সম্মান শেষ করেন।
১৯৪৫ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধে পারমানবিক বোমার ব্যবহার দেখে তিনি পারমানবিক শক্তি বোমার পরিবর্তে জ্বালানীর কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করলেন এবং প্রতিষ্ঠা করলেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। যা পরবর্তীতে সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নামকরণ হয়। ১৯৫০ সালের ১১ জানুয়ারি ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রেডিয়াম আবিষ্কারক মাদাম কুরীর কন্যা নোবেল বিজয়ী আইরিন জোলিও কুরী সহ ফ্রেডারিক জোলিও, রবার্ট রবিনসন, জে. ডি. বার্নাল প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী।
১৯১৬ সালে স্যার আশুতোষ মুখার্জি তাকে কোলকাতায় নতুন প্রতিষ্ঠিত College of Science G Physics and Mixed Mathematics বিভাগে লেকচারার পদে নিয়োগ দেন। তিনি আলবার্ট আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির ছাত্র ছিলেন এই তত্ত্ব¡টি প্রতিষ্ঠিত হবার অনেক আগে থেকেই। ১৯১৭ সালে ফিলজফিক্যল ম্যগাজিনে ম্যক্সওয়েল স্ট্রেসের উপর তার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ সালে তিনি তার ডক্টরেটট সম্পন্ন করেন এবং একই বছর তিনি ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্টুডেন্টশিপ’ বৃত্তি পান `Selective Radiation Pressure and its Application to the Problems of Astrophysics` শিরোনামের থিসিসের জন্য। পরের বছর `Origin of lines in steller spectra` বিষয়ে তিনি গ্রিফিথ পুরস্কার লাভ করেন। যদুনাথ সরকার ও আশুতোষ মুখার্জিও ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্টুডেন্টশিপ’ প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। মেঘনাদ সাহার এই থিসিসটিই তার জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানের আগমনের বার্তা।
‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্টুডেন্টশিপ’ এবং গুরুপ্রসন্ন স্কলারশিপ তাকে ১৯২০ সালে ইউরোপের দুয়ার পর্যন্ত যেতে সাহায্যা করে। এখানে তিনি কিছুসময় ইম্পেরিয়াল কলেজে কাজ করেন এবং তার বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানে থার্মাল আয়নাইজেসন তত্ত্ব প্রকাশনার কাজ করতে থাকেন। তার এই তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত হিসেবে হাজির হয়।
ভারতে বর্তমানে যে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা প্রচলিত তা তৈরিতে মেঘনাদ সাহার অবদান রয়েছে। এলাকাভেদে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে প্রায় অর্ধশতাধিক পঞ্জিকা ভারতে প্রচলিত ছিল। ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটির চেয়ারম্যন ছিলেন মেঘনাদ সাহা। এই পঞ্জিকা তৈরিতে সূর্যের অয়নগতি মাথায় রাখা হয়। এমনকি ১৯৫৪ সালে ইউনেস্কোর জেনেভা সম্মেলনে তিনি ওয়ার্ল্ড ক্যালেন্ডার রিফর্ম নিয়ে একটি প্রস্তাবনাও দিয়েছিলেন।
রাজনীতিতেও জড়িয়েছিলেন মেঘনাদ। ১৯৩৮ সালে তিনি জওহরলাল নেহেরু`র জাতীয় পরিকল্পনা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে সরকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন প্রতিষ্ঠা নিয়ে তার মতামত জানতে চায়। ঐসময় ভারতের প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ নেই এই যুক্তিতে এর বিরোধিতা করেন। ১৯৫১ সালে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। অবশ্য একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে আলবার্ট আইনস্টাইনের উক্তি :
‘Dr. M.N. Shaha has won an honoured name in the whole scientific world’
বাঙালি এই বিজ্ঞানী এখন সারা দুনিয়াতেই পরিচিত জ্যোতির্পদার্থবিদ হিসেবে। সবচেয়ে মজার বিষয়টা হল ইনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রই না। পড়াশুনাটা শুরু করেছিলেন মিশ্র গণিতে। তিনি কি জানতেন এর শেষটা হবে তারা গুনতে গুনতে।
১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মহান এই জোর্তিবিদের জীবনাবসান হয়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ অক্টোবর ২০১৫/টিপু
রাইজিংবিডি.কম