বেসরকারি কলেজে বিএড: যা বলছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি
আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম
শিক্ষকদের গুণগত মানোন্নয়ন, পদোন্নতিসহ নানা কারণে ব্যাচেলর অব অ্যাডুকেশন (বিএড) কোর্সটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ।
এ কারণে বিএড কোর্সটি আবার আলোচনায় এসেছে। কারণ, সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাঙ্ক্ষিত গ্রেড পেতে অবশ্যই এ কোর্সটি আগামী এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু এটি নিয়ে সুপারিশপ্রাপ্তরা নানাভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন।
রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে কয়েকজন শিক্ষক বলেন, সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের সুপারিশের পর দশম গ্রেড পেতে হলে বাধ্যতামূলক বিএড কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। এখন চিন্তা, বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানটি সরকার অনুমোদিত আর কোন প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদিত নয় এ নিয়ে। কারণ, এগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা অভিযোগ চোখে পড়ে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকেও এ ব্যাপারে ক্লিয়ার কোন ধারণা দেওয়া হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বিএড করতে। কিন্তু সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হচ্ছে খুবই সীমিত। এগুলোতে সবাই একযোগে ভর্তি হতে পারবে না। আবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড কোর্স করতে গেলে অনেক সময় লেগে যায়।
কলেজ শিক্ষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ, উন্নতিসাধন, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা বৃদ্ধিসহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সকল বিষয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বিএড পাঠদানকারী প্রফেশনাল কলেজগুলো প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ভিত প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
২০২০ শিক্ষাবর্ষে ওয়েব সাইটে প্রচারিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএড পরীক্ষার কেন্দ্র তালিকা মতে, বাংলাদেশে ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ১টি বিএমটিটিআই ও ৬৮টি বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ অভিন্ন পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির আলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিছু কলেজ তাদের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়ে ইতোমধ্যে ঝরে পড়েছে। মানহীন ৩৭টি কলেজকে ২০১৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় লাল তালিকাভুক্ত করে। এদের মধ্যে ২৩টি কলেজ আদালতের রায় নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বলা হয়, এসব কলেজ থেকে বিএড সনদের বিপরীতে স্কেল দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে বেসরকারি কোনো বিএড কলেজ থেকে প্রাপ্ত সনদের বিপরীতে স্কেল দেওয়া হবে না বলে পরবর্তী আরেক সিদ্ধান্তে জানানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে এসব কলেজের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে তারা কার্যক্রম চালিয়ে যায়। তবে জটিলতা দেখা দেয়, মাউশি এসব কলেজ থেকে সনদধারীদের বিএড স্কেল প্রদান না করায়। এক বছর পর সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে ২৩টি কলেজ।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে আদালত আপিলের শুনানিতে ২০০৮-২০১৬ সাল পর্যন্ত যেসব শিক্ষক কলেজগুলো থেকে বিএড সনদ নিয়েছেন তাদের স্কেল দেওয়ার আদেশ দেন। তবে কলেজগুলো তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে কিনা- বা চালালেও ভবিষ্যতে তাদের সনদ গ্রহণ করা হবে কিনা এ বিষয়ে আদেশে কিছুই বলা হয়নি। তবে কোনো বেসরকারি টিটিসির সনদের বিপরীতে বিএড স্কেল প্রদান না করার যে সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়েছিল সেটি মন্ত্রণালয়ের ওপর ছেড়ে দেন আদালত।
এমন পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালে মাউশির আইন কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব) ড. ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ২৩ কলেজ থেকে সনদধারীদের বিএড স্কেল দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-২) দুর্গা রাণী সিকদার স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়, আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন করে ২৩টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বাইরেও অন্য টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে অর্জিত সনদের বিপরীতে বিএড স্কেল প্রদান করা হচ্ছে। এতে সরকারের বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই অবস্থায় ২৩ কলেজের বাইরে অন্য কলেজগুলোর সনদ গ্রহণ না করতে মাউশির সকল আঞ্চলিক উপ-পরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশ দেয়া হয়।
পরে অন্যান্য কলেজগুলোর প্রতিনিধিরা এর প্রতিবাদ জানালে কয়েকদিনের মাথায় ওই নির্দেশ বাতিল করা হয়। তবে বাতিলের চিঠির স্মারক নম্বর উল্লেখ করে বাতিল ছাড়া বিস্তারিত কিছু না বলায় বৈধ কলেজগুলোর সমস্যা থেকেই যায়। এমনকি বাতিল করা চিঠি মাউশি অজ্ঞাত কারণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কিংবা নিজস্ব ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করেনি।
জানতে চাইলে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এমপিও আন্দোলন ফোরামের মুখপাত্র অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান রাইজিংবিডিকে বলেন, বর্তমানে যেসব বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ নিজের মান বজায় রেখে টিকে আছে তাদেরকে আরো গতিশীল করা এবং নির্দিষ্ট শর্তাবলি পূরণে সরকার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তরিকতা প্রয়োজন। যেসব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্তাবলি পালনে আগ্রহী নয় তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু যেসব কলেজ শর্তাবলি পূরণে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তাদেরকে আরো কিছুটা সময় দিয়ে কলেজগুলোর উন্নয়নে সুযোগ দেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, নির্দিষ্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে কলেজগুলোকে বিএড কোর্স পরিচালনার জন্য অধিভুক্তি প্রদান করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এসব শর্তাবলির সঙ্গে প্রতি বছর যোগ হয় নবায়ন সংক্রান্ত নতুন নতুন শর্ত। যা পালন করে কলেজ পরিচালনা করা অনেকাংশে অসম্ভব। তাছাড়া প্রতি বছর কলেজ নবায়ন না করে ৪/৫ বছরের জন্য একবারে নবায়ন দেওয়া যায় কীনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেবে দেখতে পারে। গভর্নিং বডির মেয়াদ পূর্বের ন্যায় ৪ বছর করা দরকার।
কোর্স সম্পন্নকারীরা শিক্ষকতা পেশার সাথে সরাসরি নিযুক্ত হন। তাই প্রশিক্ষণকালীন সময়ে কোনো প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে যদি কোনরূপ ঘাটতি বা দুর্বলতা থাকে তা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে প্রভাব ফেলে। এ কারণে এ কোর্সটি পরিচালনাকারী কলেজগুলোও সতর্কতার সঙ্গে কোর্স পরিচালনা করে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও এ কোর্সটির ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষা ও ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশ করে থাকে।
এদিকে টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি অধ্যাপক মশিউর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, আমরা আমাদের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে কাজ করছি। যদি তাদের মান খারাপ হয় ক্রমান্বয়ে তাদের বাদ দিয়ে দিতে হবে অথবা তাদের মানোন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু একটি বিষয় ক্লিয়ার করা দরকার, যেগুলো আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত প্রার্থীরা যেন সেগুলো থেকে কোর্স সম্পন্ন করেন। আমাদের অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা ভর্তির বিজ্ঞপ্তির সময় তালিকা দিয়ে দিই। এটি দ্বিধাদ্বন্দ্বের কিছু নেই।
বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষকরা দীর্ঘদিন এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ঠিক যে ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা আর্থিক সাপোর্ট না দেওয়াতে তাদের ভেতর বাণিজ্যিক চিন্তা গ্রো করতে পারে। তবে তাদের উচিত প্রতিষ্ঠানের মান বাড়ানো। তখন আমরা এমনিতেই তাদের নিয়ে চিন্তা করবো। তবে যারা মান খারাপ করবে অভিযোগ ও তদন্তের ভিত্তিতে তাদের অধিভুক্তি পর্যায়ক্রমে বাতিল হয়ে যাবে।
অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, অধিভুক্ত বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাদের মান বাড়ানো নিয়ে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। আশা করছি দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে এসব প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে কোর্সে আগ্রহীদের কোনোভাবেই বিভ্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। যতদিন এসব প্রতিষ্ঠান আমাদের তালিকাভুক্ত থাকবে ততদিন যারা এখান থেকে কোর্স করবে তাদের সনদ জটিলতা থাকবে না। অধিভূক্ত বাতিল হলেও আগে যারা অধিভূক্ত থাকাকালীন কোর্স করেছে তাদের সনদ বাতিল হবে না।
ঢাকা/টিপু