ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের অতীত-বর্তমান : পর্ব-২

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২০, ৩০ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের অতীত-বর্তমান : পর্ব-২

(প্রথম পর্বে আমরা বলেছি, ভারতে কীভাবে মাওবাদী বা নকশালবাদীদের উত্থান হলো। নকশাল শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কেও বলেছি। দ্বিতীয় পর্বে থাকছে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই জারি রাখা মাওবাদীরা আসলেই কতটা শক্তিশালী বা আদৌ তাদের সেই শক্তি আছে কি না এবং তাদের কার্যক্রমের বস্তারিত। আলজাজিরা অবলম্বনে ভাষান্তর করেছেন রাসেল পারভেজ )

দ্বিতীয় পর্বের পর থেকে  :  প্রথম পর্বে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (সিপিআই) আলোচনা করা হয়েছে। এটিই এখন ভারতের সবচেয়ে বড় ও সংগঠিত কিন্তু নিষিদ্ধ মাওবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সিপিআইয়ের সশস্ত্র শাখা হলো পিপল’স লিবারেশন গেরিলা আর্মি (পিএলজিএ)। তারা মাওবাদী মুভমেন্টের সৈনিক। চোরাগোপ্তা ও অতর্কিত হামলা-হাঙ্গামায় ব্যাপক দক্ষ তারা। এ ছাড়া মাওবাদী আদর্শ ধারণ করে, এমন আরো কিছু সশস্ত্রগোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

মাওবাদী যোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে বলা হয়ে থাকে, পিএলজিএ-এর সদস্য সংখ্যা ৮ হাজার থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। ভারতজুড়ে সক্রিয় নকশালবাদীদের (মাওবাদীদের নকশালবাদীও বলা হয়) মোট সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার। তবে এ সংখ্যা ২৫ হাজার বলেও অনেকে উল্লেখ করেন।

তবে সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অনেক কম। ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু তাদের পার্লামেন্টকে অবহিত করেন, ‘প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিবেদন মতে, ভারতে বামপন্থি উগ্রতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার ৫০০ জন। তবে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী অনেক বড়।’



ভারতের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলে খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। এ দুই অঞ্চলে প্রায় ৮ কোটি ৪০ লাখ আদিবাসীর বসবাস। এখানকার খনিগুলোর কাজ নতুন করে শুরু হওয়ায় তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে বলে তারা মনে করে। এ ছাড়া তাদের অধিকাংশ বর্গাচাষি বা ভূমিহীন। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে তারা।

এ দুই অঞ্চলে মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ খুবই কম। না আছে ভালো রাস্তাঘাট, না আছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ। পানীয় জলের প্রকট অভাব রয়েছে।

ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড এবং ওডিশায় সরকার খনিজ সম্পদ তোলার পদক্ষেপ নেওয়ায় স্থানীয় হাজারো বাসিন্দা বসতভিটা হারানোর আশঙ্কায় নিমজ্জিজত হয়। অনেকে পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে এবং যাচ্ছে।

১৯৮০-এর দশকে অন্ধ্র প্রদেশের মাওবাদীরা ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের সংগঠিত করে ভূমির অধিকার আদায়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই সঙ্গে উদ্বাস্তু হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে লড়াই শুরু করে। এরপর ২০০০ সাল থেকে ভারত সরকার ছত্তিশগড়ে খনির কাজ শুরু করায় এ রাজ্য মাওবাদী আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

‘দি বার্নিং ফরেস্ট : ইন্ডিয়া’স ওয়ার ইন বাস্তার’ বইয়ের লেখক নন্দিনী সুন্দর মাওবাদী আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, বন রক্ষা করে রাখতে এবং ভূমির পুনর্বণ্টন করতে আদিবাসীদের তারা (মাওবাদীরা) সাহায্য করেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তাদের ৮০-৯০ শতাংশ ক্যাডার আসে স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্য থেকে। তারা গ্রামের মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ। তবে এর মানে এই নয় যে, গ্রামের সবাই তাদের সমর্থন করে।’

মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাকে ভারতে ‘রেড করিডোর’ বলা হয়। ছত্তিশগড়, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশে এ ধরনের রেড করিডোর রয়েছে। তবে বর্তমানে ভারত সরকার এসব এলাকার নিরাপত্তায় আধাসামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করায় মাওবাদীরা বিপাকে পড়েছে।

প্রায় এক দশক আগে ভারতের ২০ রাজ্যের ২০০ জেলায় মাওবাদীদের আস্তানা বা রেড করিডোর ছিল। কিন্তু এই দশ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে তাদের অবস্থান দেখা যায় ১০ রাজ্যের ১০৬ জেলায়। এর মধ্যে ছত্তিশগড়, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে বর্তমানে তাদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্র প্রদেশেও এখন তাদের কার্যক্রম রয়েছে।

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদী বিদ্রোহকে ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০০৯  সালে তার সরকার তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে। গণমাধ্যমে এ অভিযান ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

আট বছর আগে ওই অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের মাওবাদীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সশস্ত্র সহিংসতা বেড়ে যায়, দুই পক্ষের লড়াইয়ের ফাঁকে পড়ে বহু নিরীহ ও বেসামরিক মানুষ নিহত হতে থাকে। চলতি বছরের এই কয়েক মাসে এ ধরনের সহিংসতায় নিহত হয়েছেন প্রায় ১০০ জন। গত বছর নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০ জন।

১৯৮০ সাল থেকে মাওবাদী গোষ্ঠীগুলো ও সরকারের মধ্যে লড়াই এবং সহিংসতায় এ পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।



ঘৃণ্য কাজের অভিযোগ
মাওবাদী আন্দোলন ও তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপের মধ্যে পড়ে গিয়ে বলির পাঠা হয় আদিবাসীরা। একে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে নকশালবাদীরা।

ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের যৌন নির্যাতন, বিচারবর্হিভূত হত্যা ও অধিকার হরণের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকরা প্রায়ই এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ তুলে ধরেন।

সরকারবিরোধী হামলার জন্য মাওবাদীরা গ্রামবাসীদের দলে ঢোকায়। সাদামাঠা থেকে অস্ত্রধারী হয়ে ওঠা গ্রামের এই লোকজন পরে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বন্দি ও নির্যাতনের শিকার হয়। তবে পুলিশের চর সন্দেহে গ্রামের অনেককে মাওবাদীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। আবার কখনো মুক্তিপণ আদায়ের জন্য গ্রামের লোকজনকে অপহরণ করে তারা।

ছত্তিশগড় রাজ্যে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে নজরদারির জন্য দল গড়ে তোলা হয়। সরকার তাদের সাহায্য করত। তবে এই দলের সদস্যরা প্রায়ই নিরীহ বেসামরিক লোকদের মাওবাদীদের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর নিপীড়ন চালাত। এ ধরনের একটি নজরদারি গোষ্ঠীর নাম সালওয়া জুদুম। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের গোষ্ঠীগুলো পুরোপুরি বেআইনি ঘোষণা করে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন।

তবে সম্প্রতি বেশ কিছু রাজ্যে সরকারের ছত্রছায়ায় আবার নজরদারি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা অধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পিপল’স ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের প্রেসিডেন্ট ড. লক্ষ্মণ সিং দাবি করেছেন, ‘ছত্তিশগড় রাজ্যের বাস্তার জেলায় গৃহযুদ্ধের অবস্থা বিরাজ করছে কিন্তু জাতিসংঘের নজরদারির ভয়ে ভারত সরকার হয়তো প্রকাশ্যে এ অবস্থার ঘোষণা দিতে পারছে না।’

ছত্তিশগড়ের পাঁচ দশকের পুরোনো মাওবাদী আন্দোলন চিরতরে উৎখাতের জন্য ভারত সরকার এ রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ১ লাখ সদস্য মোতায়েন করেছে, যাদের এক-তৃতীয়াংশ আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য। ১৯৯৫ সাল থেকে এ রাজ্যে সহিংসতায় ২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে।

ড. লক্ষ্মণ সিং আরো বলেন, ‘মাওবাদীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছত্তিশগড়ের বাস্তার অঞ্চলেই নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৬ হাজার সদস্য মোতায়েন রাখা হয়েছে। সেখানে প্রতি ৫৫ জন বেসামরিক লোকের বিপরীতে একজন সেনা মোতায়েন রয়েছে। যেখানে আফগানিস্তানের মতো সংক্ষুব্ধ দেশে প্রতি ১৫০ জন বেসামরিক লোকের বিপরীতে একজন সেনা রয়েছে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ এপ্রিল ২০১৭/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়