ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সত্যজিৎ রায়ের ১০২তম জন্মদিন

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২ মে ২০২৩   আপডেট: ১১:৫০, ২ মে ২০২৩
সত্যজিৎ রায়ের ১০২তম জন্মদিন

আমরা তাকে অনেকেই চলচ্চিত্রকার হিসেবে দেখি।  অথচ চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরেও তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সংগীত পরিচালক, কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক্স নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক। সব কিছুতেই রয়েছে তার উজ্জল অবদান। প্রতিটি বিষয়েই তার প্রতিভাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। 

সত্যজিৎ রায়ের ১০২তম জন্মদিন আজ। ১৯২১ সালের এই দিনে অর্থাৎ ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্ম কলকাতায় হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তার ছিল আত্মিক সম্পর্ক। সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার বড় মসুয়া গ্রামের অধিবাসী। 

তার পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর জন্ম বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে।  উপেন্দ্রকিশোর ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে তৎকালীন প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তিও পেয়েছিলেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি কলকাতায় চলে গেলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ থেকেই যায়। সেই সূত্রে সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায়ের বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো। সত্যজিৎ রায়ের জন্মের ছয় বছর আগে মারা যান উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, আর মাত্র আড়াই বছর বয়সে বাবাকে হারান সত্যজিৎ। তারপরও বাংলাদেশের সঙ্গে ছেদ পড়েনি তাদের। কারণ তার মামার বাড়ি ছিল ঢাকার ওয়ারীর র‍্যাংকিং স্ট্রিটে।

ঢাকার প্রথম আবাসিক এলাকা ছিল ওয়ারী। ছোটবেলায় দু-তিন দিন ঢাকায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বা ছয় বছর। সত্যজিৎ রায়ের সেটাই ছিল সর্বপ্রথম ঢাকায় আসা। তিনি পরবর্তী বার যখন ঢাকায় এলেন তখন হয়ে উঠেছেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, গুণী সাহিত্যিক। অন্যদিকে, বাংলাদেশ তখন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। সত্যজিৎ রায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয় ১৯৭২ সালের শহীদ দিবস উপলক্ষে। স্বাধীন বাংলাদেশে সে বছরই প্রথম পালিত হয় শহীদ দিবস। সত্যজিৎ রায়সহ ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক, পরিচালকরা ঢাকায় আসেন ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।

পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আয়োজনে শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সত্যজিৎ রায়। নিজের পিতৃভূমিতে এসে আবেগ সামলাতে পারেননি আজীবন আবেগ সামলে রাখা সত্যজিৎ রায়। প্রধান অতিথি হিসেবে সেদিন সত্যজিৎ রায়ের সে বক্তব্যে উঠে এসেছে ভাষার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের মমত্ববোধ, তার শৈশবের স্মৃতি, চলচ্চিত্র ও এদেশের প্রতি তার অসীম কৃতজ্ঞতা।

তিনি বলেন, ‘আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি যে পূর্ববঙ্গ নাকি আমার দেশ। আমার ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাম হয়তো আপনারা কেউ কেউ শুনেছেন। আমার তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু শিশুকাল থেকে আমি তার রচিত ছেলে ভোলানো পূর্ববঙ্গের কাহিনী ‘টুনটুনির বই’ পড়ে এসেছি, ভালোবেসে এসেছি। তার রচিত গানে আমি পূর্ববঙ্গের লোকসংগীতের আমেজ পেয়েছি। যদিও আমি এ দেশে আসিনি, আমার দেশে আমি কখনো আসিনি বা স্থায়ীভাবে আসিনি। এসব গান, এসব রূপকথা শুনলে আমার মনে হতো যে এ দেশের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ রয়েছে।’

‘যখন আমার পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, তখন আমি একবার ঢাকা শহরে এসেছিলাম। দু-তিন দিন মাত্র ছিলাম। আমার মামার বাড়ি ছিল ওয়ারীতে, র‌্যাংকিং স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখন আছে কি না জানি না। সে রাস্তা এখন আছে কি না জানি না। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই। মনে আছে শুধু যে প্রচণ্ড বাঁদরের উপদ্রব। বাঁদর এখনও আছে কি না, তা-ও আমি জানি না। তারপর মনে আছে পদ্মায় স্টিমারে আসছি। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেছে, মা আমাকে বাইরে ডেকে এনে দেখাচ্ছেন যে পদ্মার ওপর সূর্যোদয় হয়েছে। আর দেখাচ্ছেন যে পদ্মা ও মেঘনার জল যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে এক নদীর জলের রঙের কতো তফাত। সেই থেকে বারবার মনে হয়েছে যে একবার নিজের দেশটা দেখে আসতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সে আশা, বিশেষত দেশ বিভাগের পর ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হতে চলেছিলো। হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল, আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেলো এবং আজ শহীদ দিবসে এসে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে। ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা অংশে সফল হলো। এবার আমি অনেক জরুরি কাজ রেখে চলে এসেছি। এবার আর বেশি দিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে, আমার আশা আছে, অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এ দেশে ফিরে আসব। এ দেশটাকে ভালো করে দেখব। এ দেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব। এ আশা আমার আছে। আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না।’

এভাবে আবেগে তাড়িত সত্যজিৎ রায়ের কথার স্রোতে উদ্বেল হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। সে সফরে সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। একত্রে তারা দারুণ সময় কাটিয়েছেন। সেটাই ছিলো ঢাকায় সত্যজিৎ রায়ের সর্বশেষ সফর। 

সত্যজিৎ রায় বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতা। অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে তুলে ধরেছেন বিশ্ব মানচিত্রে। নির্মাণে এসে প্রথম ছবিতেই নিজের জাত চেনালেন সত্যজিৎ। ১৯৫২ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ থেকে সিনেমা নির্মাণ করেন ‘পথের পাঁচালী’। টাকার অভাবে শেষ করতে বিলম্ব হয় অনেকটা দিন। শেষমেষ মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। অস্কারসহ দুনিয়াব্যাপি খ্যাতি পায় সিনেমাটি। ডকুমেন্টারি ফিল্ম, শর্ট ফিল্ম, ফিচার ফিল্মসহ সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছেন মোট ৩৭ টি ছবি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অপরাজিত, পরশপাথর, জলসাঘর, অপুর সংসার, দেবী, তিনকন্যা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অভিযান, মহানগর, চারুলতা, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, জয়বাবা ফেলুনাথ, সোনার কেল্লা, ঘরে-বাইরে, গণশত্রু, শাখা-প্রশাখা, আগন্তুক। এসব চলচ্চিত্র সত্যজিৎ রায়কে বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের। 

বাংলা সাহিত্যে সত্যজিৎ রায় একটা বড় জায়গা দখল করে আছেন। বিশেষ করে শিশুতোষ গোয়েন্দা কাহিনী ফেলুনাথ সিরিজ ছেলে-বুড়ো সবার প্রিয়। এছাড়া বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কুও সবার কাছেও দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি একাধিক ছোট গল্প লিখেছেন।

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই মহান চলচ্চিত্রকার। মৃত্যুর মাত্র একসপ্তাহ আগে সত্যজিৎ রায় পান বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সন্মানজনক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার)। 

/টিপু/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়