ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

হাজার বছর ধরে: নারীর প্রতি সহিংসতার এক চলমান উপাখ্যান

জাকিয়া সুলতানা চন্দ্র || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৭, ১৪ অক্টোবর ২০২০  
হাজার বছর ধরে: নারীর প্রতি সহিংসতার এক চলমান উপাখ্যান

বাংলা সাহিত্যে অবশ্যপাঠ্য উপন্যাসের তালিকা করলে কালজয়ী ঔপন্যাসিক জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ একটি অন্যতম জায়গা দখল করবে। 

এটি শুধু উপন্যাস নয়, যুগ যুগ ধরে চলমান নারীর সঙ্গে নির্মমতার গল্প। তিনি সেই লেখক, যার কলম বাংলার মানুষের বোবা কান্নাকে বিশ্বস্ত ভাষা দিয়েছে। তাঁর ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটির গতিপথে ফুটে উঠেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী নির্যাতনের এক স্থায়ী চলমান দৃশ্য।

জহির রায়হানের রচিত প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন একাধারে গল্পকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং প্রযোজক। চলচ্চিত্র প্রতিভার পরবর্তী আশ্রয়স্থল হলেও তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল কথাসাহিত্যে। ১৯৬৪ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ কালজয়ী উপন্যাসের জন্য আদমজী পুরস্কার, বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান তিনি।  

পরী দিঘির পাড়ের একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে এ গল্পের শুরু। বানের  জলে ভেলায় ভাসতে ভাসতে এসেছিল কাশেম সিকদার ও তার স্ত্রী। সেই থেকেই শিকদার বাড়ির পত্তন হয় গ্রামটিতে।  গল্পে শিকদার বাড়িতে বাস করে বৃদ্ধ মকবুল ও তার তিন স্ত্রীসহ আবুল রশিদ ও মন্তু এবং আরও অনেকে। বৃদ্ধ মকবুলের কনিষ্ঠ স্ত্রী চতুর্দশী টুনি। কিশোরী টুনির স্বভাব উড়ন্ত পাখির মতো। বৃদ্ধ মকবুলের শাসন-বারণ মানে না সে।  টুনির এই বাঁধনহীন জীবনের একমাত্র সঙ্গী মন্তু। অনাথ মন্তু আর টুনি রাতের অগোচরে মাছ ধরতে যায়, বর্ষায় শাপলা তুলতে যায়, অন্যের গাছ থেকে খেজুরের রসভর্তি হাঁড়ি চুরি করে।

বৃদ্ধ মকবুল তার স্বামী হলেও টুনি তার কল্পনা, স্বপ্নে কেবল মন্তুকেই খুঁজে পায়। অব্যক্ত ভালোবাসার জোয়ারে ভাসে ওরা দুজন। কিন্তু তাদের স্বপ্ন যে সমাজ-ধর্মে পাপ আর অপরাধের সমতুল্য। নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করাটা সমাজে যেন গুরুতর অপরাধ। কঠিন এ অচলায়তন সমাজে নারী হাতের পুতুল মাত্র। উপন্যাসটির পরতে পরতে নারীর প্রতি অবমাননা ফুটে উঠেছে, যা হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে। 

মন্তুর মতো পুরুষ সেই কঠিন সমাজের সঙ্গে পেরে ওঠে না। তাই ভালোবাসা থাকলেও তা আর আলোর মুখ দেখে না। গ্রামে কলেরা, ডায়রিয়া ও যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন লোকেরা যক্ষ্মাকে ওলাবিবি ধরেছে বলে মনে করে। সমাধানের মুক্তি হিসেবে তাবিজ, কবজ কিংবা পানি পড়ার দিকে ছুটে যায়। কুসংস্কার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও নারী নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো উপন্যাসটিতে হুবহু ফুটে উঠেছে।

উপন্যাসটির শেষ দিকে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ বয়সে পদার্পণ করে মন্তু। টুনি হারিয়ে গেছে মন্তুর জীবন থেকে। সেই টুনি, যে সুতোই বেঁধেছিল শাপলার ফুল, নাকি তার মন। আর সে সময় পুরনো ভাবনার মাঝে ধ্বনিত হয় হাজার বছরের সেই পুতি পড়া পুরনো জোৎস্না রাত। যেন একই পুতির সুর ভেসে বেড়ায় কালের আবর্তে। রাতের বেলা সুরত আলীর ছেলে বাপের মতোই পুতি পড়ে- শোনো শোনো বন্ধুগণ শোনো দিয়া মন, ভেলুয়ার কথা কিছু শোনো সর্বজন। সেই সঙ্গে রাত বাড়ছে, হাজার বছরের পুরনো সেই রাত। 

মানবিক সম্পর্কের মধ্যে বেড়ে ওঠা চলমান বিচ্ছিন্নতার দেয়াল। সে দেয়ালজুড়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী নির্যাতনের গল্প দিয়ে যেন এক একটি ইট গাঁথা। তৎকালীন আবহমান গ্রামবাংলার সহজ-সরল জীবনধারায় ফুটিয়ে তুলেছেন নারীদের প্রতি নির্মমতার অমিমাংসিত দৃশ্য। ‘হাজার বছর ধরে’ কালজয়ী উপন্যাসটি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীদের প্রতি নির্মমতা, নির্যাতন, অবিচারের রাজসাক্ষী হয়ে আছে। সময় যায়, প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে, শুধু পরিবর্তন আসে না অন্ধকার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম-বাংলার অচলায়তন সমাজে। 

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারহীনতার প্রশ্নরা থেকেই যায়। হাজার বছর ধরে আমরা প্রকৃতির বিপরীতমুখী ছুটে, তার সঙ্গে লড়াই করে যে পার্থক্য অর্জন করেছি, তার গালভরা নাম দিয়েছি সভ্যতা।

১৯৯৮ সালে অনুপম প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করেছে। বইটির প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৪। রকমারিতে বইটির মূল্য বর্তমানে ৯০ টাকা।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। 

ঢাকা/মাহি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়