সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আমাদের চিন্তার বাতিঘর
অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অলাত এহসান
‘সাহিত্যের সমালোচনা কি সম্ভব?’ প্রায়ই এই প্রশ্নে সাহিত্যাঙ্গন সরগরম হয়ে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু আমরা যখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্যসংশ্লিষ্ট প্রবন্ধগুলো পড়ি তখন আমাদের মনে হয়, সাহিত্যের সমালোচনা শুধু সম্ভবই নয়, সাহিত্যের সমালোচনা নিজেই সাহিত্যের একটি ধারা তথা ‘সমালোচনা সাহিত্য’ হয়ে উঠতে পারে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের পাঠকপ্রিয়তা অর্জন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যার অবদান তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। স্বাধীনতার প্রায় একযুগ আগে থেকেই তিনি লেখালেখি করে আসছেন। অধ্যাপক, লেখক, সাহিত্যিক, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ, মার্ক্সবাদী দার্শনিক এই ব্যক্তি ক্রমে পরিণত হয়েছেন আমাদের চিন্তার বাতিঘরে।
সেই গৌতম বুদ্ধের সময় থেকেই এ অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর এলাকা ঢাকার বিক্রমপুর। এই জেলার বাড়ৈখালা গ্রামে ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম। কথাসাহিত্য দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও প্রবন্ধ ও গবেষণায় তিনি বিপুল প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন।
প্রথমত তার লেখার প্রসাদগুণ যে কোনো পাঠককে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। যে কোনো বিষয় একটি সাধারণ বিন্দুসম জায়গা থেকে লিখতে শুরু করেন তিনি। লেখায় তার ভাবনার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে যায় আমাদের জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, সংগ্রাম, রাষ্ট্র ইত্যাদি। ছোট ছোট বাক্য, সহজ উদাহরণ, ঘনিষ্ট আলাপনে পাঠককে ধীরে ধীরে চিন্তার গভীরতম স্তরে নিয়ে যান অবলীলায়।
প্রচলিত কিংবা আপাত নিরীহ একটা কথা বা প্রবাদের ভেতর যে মনস্তত্ত্ব-সমাজতত্ত্ব থাকে তিনি আন্তরিকভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি দেখান আপাত নিরীহ একটা কথার ভেতরে লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের সংগ্রামের বা দাসত্বের ইতিহাস। কিংবা তার ভেতরে লুকিয়ে আছে গূঢ় রাজনীতি ও তত্ত্ব। তিনি যেমন তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন, তেমনি উদাহরণ দিয়ে পাঠককে হৃদয়াঙ্গমে সহায়তা করেন। ভাষার প্রসাদগুণ ছাড়াও তার প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্যতম দিক হলো বিষয় বক্তব্য। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় বক্তব্যের ভেতরে সব সময় একটা চাপা কৌতুক থাকে। তিনি বিষয় বিশ্লেষণ করেন দ্বান্দ্বিক বিচারে। অর্থাৎ শাসক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদ ও মানবমুক্তির মধ্যের দ্বন্দ্ব তার বিশ্লেষণ পদ্ধতি। যা তার শব্দ চয়ন ও বাক্য রচনার অসামান্য পারদর্শিতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। ফলে তার প্রবন্ধগুলো হয়ে ওঠে ক্লান্তিহীন ও চরিত্রসম্পন্ন।
বিশ্বে কোনো নতুন জ্ঞানতত্ত্ব হাজির হলে তিনি দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সে তত্ত্বের সামাজিক ভূমিকা ও উপযোগিতা ব্যাখ্যা করেন। যে কারণে প্রাচ্যবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, বিনির্মাণ বাদ, নিম্নবর্গীয় ইতিহাস চর্চা বিষয়ে সবার আগেই তাকে দেখি ব্যাখ্যা করতে। তিনি রচনায় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়ের মধ্যে শ্রেণিবৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে দেখতে পান। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও আকর্ষণীয় ভাষায় তিনি তা তুলে ধরেন। তিনি পাঠককে দ্বন্দ্বে ঝুলিয়ে রাখনে না। একটা শক্ত ভিত্তি দেন। ফলে প্রতিটি প্রবন্ধ পাঠ শেষে পাঠক বুঝতে পারেন এর দায় এবং তার করণীয়। অর্থাৎ পাঠককে তিনি শ্রেণি সচেতন করে গড়ে তোলেন। সমাজতন্ত্র তথা মানব মুক্তির জন্য সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করাই তার অধিকাংশ বক্তৃতা বা লেখার মূল প্রতিপাদ্য ও লক্ষ্য।
ইতিমধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বইয়ের সংখ্যা আশি ছাড়িয়েছে। তার বইয়ের শিরোনাম অনেক বেশি দ্বন্দ্ব ও প্রশ্ন নিয়ে উপস্থিত হয় পাঠকের সামনে। যেমন অনতিক্রান্ত বৃত্ত, উপরকাঠামোর ভেতরই, শেষ মীমাংসার আগে, উদ্যানে এবং উদ্যানের বাইরে, স্বপ্নের আলো ছায়া, কেউ বলে বৃক্ষ কেউ বলে নদী, দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্য-মিথ্যা, অপরিচিত নেতা পরিচিত দুর্বৃত্ত, এর পথ ওর প্রাচীর, বাঙালীর সময়-অসময়, ভূতের নয় ভবিষ্যতের, রাষ্ট্র ও কল্পলোক, বিরূপ বিশ্বে সাহসী মানুষ, বাঙালিকে কে বাঁচাবে ইত্যাদি। তার ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণ’ বই দু’টি বাংলাদেশের ইতিহাস গবেষণায় অনন্য সংযোজন। অন্যদিকে তার ‘স্বাধীনতার স্পৃহা ও সাম্যের ভয়’ এবং ‘রাষ্ট্র ও কল্পলোক’ প্রবন্ধগ্রন্থ দু’টি বিষয় বক্তব্য ও ইতিহাস বিবেচনায় বিশিষ্ট হয়ে আছে।
বুদ্ধিজীবী কে? তাদের চরিত্র কী? কী তাদের ভূমিকা? প্রায়ই এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে এক জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখাতে পারি। বিশেষত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চায় তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পেশাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তবে তার জ্ঞানের পরিধী সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদের ভূমিকা ছাড়িয়ে যায়। তিনি এরিস্টটল, শেক্সপিয়র, টলস্টয়, ইয়েটস, বার্টান্ড রাসেল, টিএস এলিয়ট প্রভৃতি বিশ্ব ইতিহাস ও সাহিত্যের দিকপালের পাশাপাশি বাংলা ভাষার কবি সাহিত্যিক- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মীর মোশারফ, কাজী আবদুল ওদুদ, জীবনানন্দ, সুকান্ত প্রমুখ নিয়ে আলোচনা করেন। প্রাজ্ঞতার জায়গা থেকেই তিনি রাজনীতিতে গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ, জিন্নাহ, ভাসানী, ফজলুল হক, মণি সিংহ, বঙ্গবন্ধু, সিরাজ সিকদার, কমরেড ফরহাদ ইত্যাদি নেতার মধ্যে যে তুলনামূলক বিচারের দক্ষতা-নিরপেক্ষতা দেখিয়েছেন, তা অত্যন্ত সাহসী কাজও বটে।
আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন মুক্তচিন্তা চর্চার পথগুলো বন্ধ হয়ে যায়, শিক্ষকরাও চিন্তার দেউলিয়াপনায় ভুগে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে আচ্ছন্ন হয়, পদ-পদবি প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তখন খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথা আমাদের মনে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক দু’বার উপাচার্য হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নির্মোহ ও নীতি-আদর্শের যে নজির স্থাপন করেছেন আমাদের দেশে তা বিরল।
১৯৫৭ থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এমিরেটাস শিক্ষক নির্বাচিত হন। শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস্ এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি সব সময় বাক্-স্বাধীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়ত্বশাসন, মানবিক অধিকার, দুর্নীতি প্রতিরোধ, পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে গেছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার, দেশের তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষার জন্য রাজপথেও নেমে এসেছেন তিনি। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন লেখনির মাধ্যমে, কখনো আবার সশরীরে উপস্থিত হয়ে।
ওসমানী উদ্যানে গাছ কেটে ফেলার সর্বনাশী উদ্যোগ যখন নিয়েছিল সরকার, তখন তিনি ছাত্র ও বাম সংগঠনগুলো নিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। একইভাবে তিনি আড়িয়ল বিলের কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে বিমান বন্দর করতে সরকার যে অপচেষ্টা চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধেও তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিও করতে চেয়েছিল। ১৯৯৬ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গড়া গণ-আদালতের বিচারক ছিলেন তিনি। একইভাবে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ ও এডিবি’র কার্যক্রম নিয়ে গঠিত গণ-আদালতের (ট্রাইব্যুনাল) বিচারকদের একজন তিনি। ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদসহ বহু জনগুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
প্রায়ই দেশের ক্রান্তিতে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নিয়ে আমাদের দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। তখন আদর্শ উদাহরণ হিসেবে তাকেই পাওয়া যায়। তিনি একজন মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী। কিন্তু তার মার্ক্সবাদচর্চা কোনো উদ্ধৃতিতে আবদ্ধ নয়। তিনি একে সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-দর্শনসহ দৈনন্দিন জায়গায়ও বিস্তার ঘটিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সব সময় জনগণের পক্ষে, সমাজ প্রগতির পক্ষে কথা বলেন। এই প্রগতিশীল ভূমিকার জন্য একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যার যে তালিকা হয়েছিল সেখানে তারও নাম ছিল। কৌশলের কারণেই তিনি বেঁচে যান।
শুধু জ্ঞান আহরণ নয়, জ্ঞান সৃষ্টির জন্যও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তার স্ত্রী শিশুসাহিত্যিক ও শিক্ষক ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার আগ্রহ এবং অর্থায়নে স্মারক বক্তৃতা প্রবর্তন করেছেন তিনি। ইতিমধ্যে তার সম্পাদিত অত্যন্ত উঁচুমানের সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্ত’ প্রকাশনার এক যুগ পার করেছে। এই পত্রিকা সম্পর্কে তার মত হলো, ‘আমরা এমন একটি অন্যায্য ব্যবস্থার ভেতর বাস করি যেটিকে বদলাতে না পারলে সমষ্টিগত মুক্তি নেই। বদলানোর জন্য উদ্যোগ ও আন্দোলন চাই। সেজন্যই আমরা গড়ে তুলেছিলাম সমাজ রুপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র। প্রাথমিক চিন্তা ছিল তিনটি- প্রথমটি হচ্ছে পত্রিকা বের করা। মূলত সেই থেকেই চলছে নতুন দিগন্ত।’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিভিন্নভাবে তার শ্রম ও সাহিত্যের জন্য মূল্যায়িত হয়েছেন। অবশ্য তার প্রাপ্য সম্মান রাষ্ট্রযন্ত্র দেয় কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু তিনি যে বিপুল মানুষের সম্মান ও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন তা সন্দেহাতীত। তিনি লেখক সংঘ পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আবদুর রহমান চৌধুরী পদক(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), একুশে পদক, ঋষিজ পদকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
কর্মজীবনে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ষাট, সত্তুরের দশকে তার ছোটগল্পগুলো বিশেষভাবেই উজ্জ্বল। কথাসাহিত্য গ্রন্থের মধ্যে¬ রয়েছে গল্পগ্রন্থ : ভালো মানুষের জগৎ, দরজাটা খোলো; উপন্যাস : শেষ নেই, কণার অনিশ্চিত যাত্রা, বাবুলের বেড়ে ওঠা; উল্লেখযোগ্য অনুবাদগ্রন্থ : এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব, ইবসেনের বুনো হাঁস, হাউসম্যানের কাব্যের স্বভাব ও হোমারের ওডেসি। তিনি আনোয়ার পাশা রচনাবলী (তিন খণ্ড) ও Dhaka University Convocation Speeches (দুই খণ্ড) সম্পাদনা করেছেন। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দুই যাত্রায় একযাত্রী(দুই খণ্ড), আপনজন, পিতার মুখ ইত্যাদি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি ও পারিবারিক কাহিনি ছাপিয়ে এক সময় সাহিত্য কথায় রূপান্তরিত হয়েছে।
অনেক সময় কেউ কেউ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাজনৈতিক দর্শন ও দলীয় অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে যান। এ কথা ঠিক যে, তিনি কখনো রাজনৈতিক দল করেননি। কিন্তু ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশের তথাকথিত কমিউনিস্ট মতাদর্শি-ভাবাদর্শি রাজনৈতিক দলের অনেক ডাকসাইটে নেতা, কর্মীরা যখন একেবারে বদলে ফেলার গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন, দীর্ঘ দিনের নীতি-আদর্শ খোলনলচে বদলে ফেলতে চেয়েছেন তখনও তিনি বিচলিত বা বিকৃত হননি। সেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা চেতনা বাতিঘর হয়ে বিভ্রান্ত অনেক নাবিক ও যাত্রীকে বন্দরের দিশা দিয়েছেন। তখন নিশ্চয়ই তাকে অনেক বেশি প্রতিকূল সময় ও স্রোতের বিরুদ্ধে জ্ঞান ও তাত্ত্বিক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। তার সংগ্রামের ফসল এখন বহু বীজে অঙ্কুরোদগম করছে, তা বলা যায়। সোভিয়েত বিপর্যয় নিয়ে তার বিশ্লেষণ হলো, ‘সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেয়েও বেশি প্রয়োজন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়া এবং সমাজের চেয়েও বেশি দরকার সংস্কৃতির। কেননা সমাজ আত্মরক্ষামূলক, সংস্কৃতি অগ্রসরমান এবং অগ্রসর না হলে অগ্রগতি তো হয়ই না, আত্মরক্ষাও হয় না।’
দার্শনিক বীক্ষণে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আধিবিদ্যাকেই উত্তম মনে করেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমাজ এবং সমাজের শ্রেণি দ্বন্দ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচার করেন না কখনোই। শিল্পে কলাবৈকল্যবাদী চিন্তায় ভোগেন না তিনি। যে কারণে শুধু সাহিত্যই রচনা করেননি, তিনি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তবে তার কলমের মাধ্যমে, যার শক্তি কিন্তু রাস্তার লড়াইয়ের চেয়ে কম নয়। সে দিকে দিয়ে তিনি কর্মবীরও বটে।
ব্যক্তিগতভাবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মদিন পালনে আগ্রহী বা বিশ্বাসী নন। এ নিয়েও তার দর্শনগত অবস্থান সুস্পষ্ট। এমন উন্মূল দিনে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকে, সেখানে আবার ঘটা করে জন্মদিন উদযাপন কিসের জন্য? তার এই সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখেই বলা যায়, কর্ম ও চিন্তা বিবেচনায় তার জন্মদিন অনেক আগেই আমাদের উদযাপনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে তার প্রতি মানুষের ঋণ, শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা থেকেই জন্মদিন উদযাপন করা হয়, মানুষের মাঝে তার আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য।
লেখক : গল্পকার, সাংবাদিক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুন ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম