ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

রানা প্লাজা ধস

৫৯৪ জনের মধ্যে সাক্ষ্য শেষ ৮৪ জনের

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৮, ২৪ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ০৮:৫২, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
৫৯৪ জনের মধ্যে সাক্ষ্য শেষ ৮৪ জনের

রানা প্লাজার সামনে আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেন বেঁচে ফেরা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা

১১ বছর আগে এই দিনে সাভারের রানা প্লাজায় ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটে। এতে এক হাজার ১৩৬ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার ১১ বছরেও শেষ হয়নি। কবে নাগাদ শেষ হবে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষীর মধ্যে ৮৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ গত ২১ এপ্রিল মামলাটিতে ৪ জন সাক্ষ্য দেন। আগামী ২৮ এপ্রিল মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।

উল্লেখ্য, রানা প্লাজা ধসের পরপরই বেশ কয়েকটি মামলা হলেও মূল মামলা দুটি। এর একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে, অন্যটি ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরির। এছাড়া নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগে দুদক আরেকটি মামলা করে। ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলেও অধিকাংশ আসামি জামিনে আছেন। পলাতক রয়েছেন কয়েকজন।

পড়ুন: রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর: পুনর্বাসন-বিচার কোনোটাই মেলেনি

মামলার দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। যার একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা ও তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে এবং অন্যটিতে ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। দুটি চার্জশিটে মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। এ দুটি মামলায়ই পৃথক দুই আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন।

এছাড়া রানা প্লাজা নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।

রানা প্লাজার হত্যা মামলা
রানা প্লাজা ধসের পরদিন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই আলী আশরাফ। ওই মামলায় সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার। আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার পুলিশের মামলার সাক্ষী। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। চার্জশিটভুক্ত ৪১ আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে। রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বকর সিদ্দিক ও আসামি আবুল হোসেন জামিনে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্তমানে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হেলাল উদ্দিনের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ৮৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ গত ২১ এপ্রিল মামলাটিতে ৪ জন সাক্ষ্য দেন। আগামী ২৮ এপ্রিল মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।

হত্যা মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমদ্দার জানান, মামলাটির দীর্ঘ সময় লেগে যায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দিলে আসামিরা সেই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যান। শুরু থেকে মামলাটিতে বিভিন্নভাবে সময় নষ্ট হয়েছে। অন্যান্য আইনগত বাধা পেরিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আসে মামলাটি। কিন্তু সাক্ষীরা ঠিকমত হাজির না হওয়ায় সাক্ষ্য সমাপ্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা আদালত থেকে সাক্ষীদের বার বার সমন পাঠানোর পরেও তারা হাজির হচ্ছেন না। অনেক সাক্ষীকেই পুলিশ ধরে এনেছে।

তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৫৯৪ জন সাক্ষীরে মধ্যে ৮৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছি। আরও ১০০ জনের মত সাক্ষ্য নেওয়া লাগতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি, দ্রুত বিচার শেষ হবে এবং ভিকটিমের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে।

ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা
ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। সিআইডি তদন্ত শেষে এ মামলায় সোহেল রানা ও তার বাবা-মা সহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় এ চার্জশিট দাখিল করে। এ মামলায় ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ছিলো। তবে চার্জগঠনের আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি রিভিশন করায় সাক্ষ্য গ্রহণ আটকে যায়। সম্প্রতি মামলা স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে যান সোহেল রানা। পরে উচ্চ আদালত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন।

ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা সম্পর্কে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল জানান, গত বছরের ১৯ নভেম্বর ঢাকার সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বিচারক এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালত বিচারিক ক্ষমতা বলে হত্যা মামলাটির পাশাপাশি ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটিও নিয়ে যান। যাতে পাশাপাশি দ্রুত এই দুই মামলার বিচারকার্য শেষ হয়। তবে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলাটি যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো তারিখ পড়েনি। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত রয়েছে। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি যে পর্যায়ে ছিলো এখানেও সেই পর্যায়েও রয়েছে।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ১৪ জুন মামলাটির চার্জগঠন হয়। চার্জগঠনের পরপরই মামলাটি হাইকোর্টে চলে গেছে। এজন্য একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই মামলায় আসামির সংখ্যা ১৬ জন। এই মামলায় সবাই জামিনে রয়েছে।

নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণে দুদকের মামলা
রানা প্লাজা ধসের পর ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। নকশাবহির্ভুত ভবন নির্মাণের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সাভার থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে এই মামলাটি করে কমিশন। ভবনটি সোহেল রানার বাবার নামে হওয়ায় ওই সময় মূল অভিযুক্ত সোহেল রানাকে বাদ দিয়েই তার বাবা-মাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। তদন্তে সোহেল রানাই ভবনের মূল দেখ-ভালকারী ছিলেন প্রমাণ হলে চার্জশিটে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক এসএম মফিদুল ইসলাম ওই বছরের ১৬ জুলাই সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৬ সালের গত বছরের ৬ মার্চ দুদকের দেওয়া চার্জশিটে ত্রুটি থাকায় আদালত তা গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। দুদক পুনরায় তদন্ত করে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে আদালতে ফের চার্জশিট দাখিল করে। নতুন চার্জশিটেও রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ জিয়াউর রহমানের আদালতে বিচারাধীন মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। ১৬ তম সাক্ষী হিসেবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক পরিচালক মফিদুল ইসলামের সাক্ষ্য গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। আগামী  ২৮ এপ্রিল মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।

রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, রানা গত ৮ বছর ধরে জেল হাজতে রয়েছে। দুই আসামির পক্ষে হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার কার্যক্রম এগোচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে স্থগিতদেশ ভ্যাকেট করে মামলার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। মামলার রায়ে যা হওয়ার তাই হবে। এভাবে বিনা বিচারের ৮ বছর জেলে থাকা মানবিক দিক থেকে অন্যায়। তাই রাষ্ট্রপক্ষের উচিত স্থগিতাদেশ কাটিয়ে দ্রুত বিচারের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

তিনি বলেন, একমাত্র রানায় জেল হাজতে রয়েছে। বাকি সবাই জামিনে রয়েছেন। আশা করি রায়ে তিনি খালাস পাবে, কারণ এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র।

রানার আইনজীবী মাসুদ খান খোকন বলেন, ঘটনা ২০১৩ সালের। রানা ২০১৩ সাল থেকেই জেলে আছে। তারপক্ষে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। হত্যা মামলায় ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৪ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এখনো সাক্ষী চলমান। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটি উচ্চ আদালত স্থগিত করেছেন। যে মামলার সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর। আসামি হাজতেই আছে তার বেশি সময় ধরে। বিচারকাজ শুরু হয়নি। অপর সব মামলায় তিনি জামিনে আছে। এমনকি হত্যা মামলায়ও তার জামিন হয়। কিন্তু পরে জামিন স্থগিত হয়।

তিনি বলেন, এটা একটা দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় শত শত লোক মারা গেছে। এখানে রানার কোনো হাত ছিলো না। কোনো হস্তক্ষেপ না থাকার কারণেও ঘটনাটা ঘটে যায়। এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা। যদি সব সাক্ষীরা সাক্ষ্য প্রদান করে তাহলে রানা শতভাগ নির্দোষ ও নিরাপরাধ হবে। রানা খালাস পাবেন। কেননা কোনো সাক্ষীই বলতে পারেনি রানার কারণে ঘটনাটা ঘটছে। তাছাড়া যে জমির ওপর রানা প্লাজা স্থাপিত সেটাও রানার নামে না। দলিল অন্য জনের নামে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান, তার নামেরও পরে মৌখিকভাবে রানা প্লাজা। এ রানা প্লাজার কারণেই রানার জামিন হচ্ছে না। আসলে রানার ব্যক্তিগত কোনো ভূমিকা ছিলো না এবং এ মামলার জুডিশিয়ার রেকর্ডে বা আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষীদের মাধ্যমে কোথাও রানার কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি। রানা নির্দোষ। আশা করছি, তিনি খালাস পাবেন। 

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়। 

/এসবি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়