জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
প্রেমে ও ধ্যানে তাঁকে পাওয়া যায়
স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে অনুগত হওয়া যায়, আর আত্মস্থ করলে হতে হয় অভিন্ন অংশ। গ্রহণ করার এই দ্বিতীয় মাধ্যমটি নিজেকে যতটা ডুবিয়ে দেয়, অন্যকে ততটা ভাসিয়ে রাখে। যা কিছু নিজের অংশ হয়ে ওঠে তা আলাদা করার উপায় কি! সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় ক্যানভাস হলো প্রেম। যা হৃদয়ে প্রবেশ করলে ভাবনায় অনুরণন তোলে ঊর্বর কোনো গান। এই গানের সুর, ছন্দ, তাল, লয় আর গহীনের আহ্বান এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
মহাদেব সাহা সেই কবি যিনি প্রেমিক, তিনি আত্মস্থ করেন নারী প্রেম, এরপর প্রকৃতিই নারী হয়ে ওঠে। মহাদেব সাহা সেই প্রেমিক যিনি ভালোবাসার প্রতি হৃদয়পুষ্পস্তবক রেখে যেতে যেতে ক্ষুধার্ত কৃষকের ঘরে প্রবেশ করে বুঝতে পারেন তার নারী প্রেম, প্রকৃতি প্রেম, সুগন্ধের প্রতি যে মাদকতা আর মোহ তার থেকে অধিক প্রিয় একমুঠো ভাত।
আদতে একজন মানুষের ‘মানুষ’ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু নিশ্চিত না হওয়ার জায়গাজুড়ে এই কবি হৃদয় বিছিয়ে রাখেন। যেন জোসনার মিহি সুতায় সেলাই করা সেই হৃদয়ানুভূতি, যেখানে জুঁইফুলেরা ঝরে পড়লেও কবি বলতে চান-
‘তাই আর কতোবার বলবো জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই
অধিক সুন্দর’।
জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর’ কবিতায় এই জীবনবোধের চিহ্ন রেখেছেন কবি।
যার আমিত্বের ধারণা বিস্তৃত তিনিই কেবল এমন স্বীকারোক্তি দিতে পারেন। যার কবিতা সৌন্দর্য নষ্টকারী আন্তর্জাতিক শোষণের কথা ভাবে, মনু মিয়ার হাঁড়ির খবর নেয় আবার হোটেলের নাচঘরের প্রতি নিজের কোনো আকর্ষণ নেই জানিয়ে দৈহিক ভোগবাদিতা পাশ কাটিয়ে একটি নগ্ন শিশুর ধুলোমাখা গালে অনবরত চুমু এঁকে দেয়। এই কবি রচনা করেন শাশ্বত প্রেমের রূপরেখা।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি’ কবিতায় উচ্চারিত হয়-
‘তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো
ভালোবেসেছি তোমাকে।‘
এ কোনো সরল স্বীকারোক্তি নয়, আত্মস্থ করার পর তাকে আলাদা করতে না পারার অনুভূতি।
মহাদেব সাহার প্রেমের কবিতায় হৃদয়ের অধিক ব্যবহার। ‘তুমি’ এই শব্দটি বরাবর কবির আবেদন নিবেদনের যেন শেষ নেই। অশেষ আকুলতা প্রকাশ করে এই শব্দটিকে কবি অশেষ করে তোলেন। শরীরি অবয়ব দিয়ে তাকে আবার অশীরি এবং নৈর্ব্যক্তিক করে তোলেন।
‘তোমার দূরত্ব’ কবিতায় কবি লিখেছেন:
‘তোমার ভালোবাসা থেকে দুই পা সরে দাঁড়ানো
তার চেয়ে কোনো দূরত্ব আমার জানা নেই
আমার জানা নেই।’
অধুনা জটিল জীবনে অভ্যস্ত পাঠকের মনে হতে পারে, এতো সরল স্বীকারোক্তি! তার আগে বলে নেওয়া দরকার মহাদেব সাহার ঊর্বর কবিতার জমিনে হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির বীজ ছড়ানো। বিস্তৃত সৃষ্টিকর্ম, ভাবনা বৈচিত্র সেখানে মাঠের সবুজ ফসলের মতো দোল খায়। সুগন্ধ ছড়ায়। অস্তিত্বের সবল জানান দেয়। তবে শরীর সেখানে উপেক্ষিত নয়।
‘এই শীতে আমি হই তোমার উদ্ভিদ’ কবিতায় কবির শরীরি আবেদন কবিতার একেবারে শেষে উচ্চারিত হয়েছে এভাবে-
‘এই শীতে তোমার নিবিড় উষ্ণতা ছাড়া নিউ ইয়ার্স গিফট
কী আর চাওয়ার বলো আছে!’
এ যেন প্রোথিত এক কবি। শিল্পস্রষ্টা এক জীবনে অনেক জনমের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন। তার সুখ, প্রেম, কাম, বিদ্রোহ বলে যা কিছুই থাক না কেন, তিনি যৌক্তিক শৈল্পিক বুননে না গেঁথে সামনে এগোতে পারেন না। মহাদেব সাহার কবিতায় যে উপাদানই থাক হঠাৎ চলে আসে না, যৌক্তিকতা এবং শৈল্পিকতার দাবিতে আসে।
ষাটের দশক থেকে যার দাপুটে পথচলা, এরপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপটের ঘোরতর পরিবর্তন এসেছে, সেসব কবিকে ভেঙেচুড়ে গড়ে যেখানে দাঁড় করিয়েছে, সেখানেও তিনি প্রেমের প্রতি অধিক যত্নশীল। হৃদয়ের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেননি।
অধুনা জটিল জীবনে দুর্বোধ্যতায় পরিপূর্ণ। এই জীবন যাপন অভিযোজন করতে করতে অভ্যস্ত পাঠকের মনে হতে পারে মহাদেব সাহার কবিতা সরল। কিন্তু এ কথা সত্য যে, তাঁর কবিতার রস আস্বাদন করার জন্য প্রেম ও ধ্যান জরুরি। হৃদয়ের প্রেমানুভূতি অগ্রাহ্য করে মহাদেব সাহার কবিতায় প্রবেশ নিষেধ। এর ব্যতিক্রম ঘটলে তার কবিতা সহজবোধ্যতার দায়ে পাঠকের কাছে সৌন্দর্য হারাতে পারে।
তারা//