ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

ছোটগল্প

অরিন্দম রায়ের দিন-রাত্রি

অদিতি ফাল্গুনী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩১, ১০ এপ্রিল ২০২৪  
অরিন্দম রায়ের দিন-রাত্রি

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

‘মারাঠাদের দেশে পেশওয়াদের শাসনের সময়, অস্পৃশ্যরা কোন জনপথ বা সড়ক ব্যবহার করার অনুমতি পেত না যদি সেই পথে কোন হিন্দুকে আসতে দেখা যেত, যাতে তার ছায়ায় কোন হিন্দু অপবিত্র না হয়ে যায়। অস্পৃশ্যকে তার হাতের কব্জিতে বা গলায় একটি কালো সুতো ঝুলিয়ে রাখতে হতো যাতে ভুলেও হিন্দুরা তার কাছে এসে অপবিত্র না হয়ে যায়।’ 

ডিভানের ওপর শুয়ে আম্বেদকারের ‘অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট’ বইটি পড়ছিল অরিন্দম। ভেতরের কোন যন্ত্রণায় যে পরশু কলেজ স্ট্রিটের একটি বইয়ের দোকান থেকে ঝটিতি... নিজে নামেনি গাড়ি থেকে... হাজার হোক সে সেলিব্রিটি... ড্রাইভারকে দিয়েই বইটি আনিয়েছে। তাঁর গাড়ির ড্রাইভার ব্রাহ্মণ। মাসতিনেক আগে অরিন্দমের ব্রাহ্মণ স্ত্রী যখন আরেক ব্রাহ্মণ অভিনেতার সাথে বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হলো, তখন একদিন এই ড্রাইভার অতর্কিত এক মুহূর্তে মোবাইলে কারো সাথে কথা বলার সময় অরিন্দম শুনে ফেলেছিল তার সব কথা: ‘এতদিনে আমার বাড়ির বউমণি ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে আবার ব্রাহ্মণের ঘরেই গেছে। যত বড় গায়ক হোক আর যত হ্যান্ডসামই হোক, ওরা কি আমাদের জাতের? আমাদের সাথে মেশার যোগ্য? আজকালকার ছেলে-মেয়েরা তো এসব মানতে চায় না!’

পরমুহূর্তেই অরিন্দমকে দেখে কুঁকড়ে উঠেছিল ড্রাইভার গণেশ। অরিন্দম এমন ভাব করেছে যেন শুনতে পায়নি। কত আর লড়াই করা যায়? তার জীবনটাই যে লড়াই! ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-টুইটারে যতই পশ্চিম বাংলা-বাংলাদেশ-আসাম-ত্রিপুরা মিলিয়ে তার মিলিয়ন মিলিয়ন ফলোয়ার থাকুক, পাঁচ ফুট আটের ফর্সা রং-টিকোলো নাক-সুন্দর চুলের সুদর্শন অরিন্দমের জন্য লাখ লাখ মেয়ের হৃদয় কাঁদুক... এই মহান ভারতে তাকে যে সর্বদাই পরিচয় লুকিয়ে থাকতে হয়। 
‘বাং-লা-দে-শ!’

একটি শ্বাস ফেলে শোবার ঘরের জানালার কাঁচ থেকে বাইরে তাকায় অরিন্দম। আজকাল বরং ঢাকাতে গেলেই তার শান্তি লাগে? সেখানে প্রতি মুহূর্তে মানুষ জানতে চাচ্ছে না তার পরিচয় কী, পদবি কী, সে কোন জাতের? সরল ছেলে-মেয়েগুলো কখনো ‘দাদা’আর কখনো ‘ভাই’বা ‘ভাইয়া’বলতে অট্রোগ্রাফ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওদের আমরা কেন ঘৃণা করে এসেছি এতদিন? সেদেশে যে মানুষের গুণ আর রূপই একমাত্র বা দুইমাত্র যোগ্যতা! নিছক একটি পদবি দিয়ে মানুষের যে কোনো মাপ হয়- সেই হিসাবই বোধ হয় চলে না ওদেশে। অথচ একই তো বাংলা ভাষায় কথা বলা, একই মাছ-ভাত-ডাল-সবজি-মুরগি খাওয়া- হয়তো ভাষার উচ্চারণ একটু ভিন্ন। 

ডিভান থেকে উঠে পড়ে অরিন্দম। কাজের মাসী চলে এসেছে। তবু নিজেই নিজের হাতে কফি বানায়। তার কোনো ভাই-বোন নেই। মা আছে। বাবা? মা’র জীবনের গল্পটাও হুবহু অরিন্দমের গল্পের মতই। খুলনা থেকে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে মাতামহ সুনীল কুমার রায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বনগাঁয় কিছু দিন থেকে কলকাতায় চলে আসে। সমস্যা হলো মা’র গায়ের ফর্সা রং নিয়ে। 
‘কী নাম?’
‘বীণাপাণি রায়।’ 
‘রায় মানে রায়চৌধুরী? রায় তো মানে কায়স্থ বা ব্রাহ্মণদের ভেতরও আছে।’ 
‘না- আমরা ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ নই।’

ফর্সা, সুশ্রী মেয়েটি উচ্চবর্ণ নয় শুনে সবাই বিষম খেতো। বাবা সুনীল কুমার রায়ের কড়া নির্দেশ ছিল যে সত্যবদ্ধ থাকাই বড় ধর্ম। নিজের পরিচয় লুকানো কোনো কাজের কথা না। 
‘বাবা ওদেশে থাকতে- আমরা যখন পালিয়ে এলাম- সেই যেবার খুলনায় হিন্দু পাড়া বা হিন্দু পাড়ার ধার ঘেঁষা সব জায়গায় বিহারি মুসলমানরা সব আগুন দিচ্ছিল আর তুমি বিহারিদের কাছে বলছিলে যে, আমার নাম ‘আমিনা খাতুন’আর আমার খুব অসুখ বলে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছ ডাক্তার দেখাতে... মা আর দুই ভাইও আমার সাথে সাথে যাচ্ছে। তখন জানতাম যে ভারত হিন্দুদের দেশ। আমার বয়স তখন মাত্র দশ। তবু মনে আছে সব। এখন এ দেশে এসেও কেন মনে হয় আমার নাম না হোক, পদবিটা লুকিয়ে রাখতে হবে?’ 
‘সেই তো কথা রে মা! জানি না যোগেন মন্ডল আসলে ভুল করছিল না ঠিক করছিল? পুরা খুলনা-যশোর-ফরিদপুর আর বরিশালেও আমরা যোগেন বাবুর কথায় পাকিস্তান সাপোর্ট না করলে বাংলায় তো হিন্দুরাই মেজরিটি হয়। কিন্তু আমাগের সাথেও যে ব্যবহার চলতো তা কবার মতো না। আমাগের দ্যাশ যে কুনটা- পাকিস্তান হবার কিছুদিনের মাথায় যোগেন বাবু রিজাইন করি ভারত চললেন। এখানেও দুদিন পরপর দাঙ্গা। এখন এ দেশে আসি আর এক সংগ্রাম। তবু নিজের পরিচয় লুকোতি নাই মা! মনে রাখতি হবে যে বাল্মিকী, বেদব্যাস, জাবাল সত্যকাম- এরা কেউ ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ছেলো না।’ 

বীণাপাণি রায়- কলকাতার বেহালার পাশে এক কলেজে সোশ্যাল ওয়ার্কে অনার্স পড়তে পড়তে তার সুশ্রী চেহারার জন্যই প্রচুর বিড়ম্বনার শিকার হয় যেটা করুণা বিশ্বাস বা অর্চনা মন্ডলদের হতে হয়নি। তাদের ‘বিশ্বাস’বা ‘মন্ডল’পদবির সাথে গাঢ় শ্যামবর্ণ রং উচ্চবর্ণদের মনে কোনো আঘাত দেয়নি। বীণাপাণির খানিকটা ফর্সা রং এবং লেখাপড়ায় ভালো মাথার জন্য পদে পদে অপমানই জোটে। বিশ্বাস-মন্ডল বা যে ‘রায়’রা ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ নয়, ওরা পড়লেও পড়বে ওই বাংলার মতো কোনো বিষয়ে। ইংরেজি ওরা পারবেই না। ওদের ‘কোটা’য় পাস করতে হবে, ওরা কোটাতেই চাকরি পাবে। কিন্তু বীণাপাণি সব পরীক্ষায় ক্লাসে প্রায়ই ধুম করে প্রথম হয়ে বসে। সে ইংরেজিতে ভালো এবং কোটা ছাড়াই সে ভালো চাকরি পেয়ে গেল মাত্র তেইশ বছর বয়সে। সেটা ১৯৭৮ সাল। সেখানেই নীলাঞ্জন চ্যাটার্জি নামে ছেলেটি তাকে দেখে অবাক হলো। কি করে যে ‘রায়’নয় ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ, তেমন এক ‘রায়’হয়ে বীণাপাণি বেশ ফর্সা বা তার ইংরেজি সত্যিই ভালো? আর ‘কোটা’ ছাড়া চাকরি পেয়ে গেছে? এ যে আরো বড় অপমান! অফিসের ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ কয়েকজন নারীই একাধিকবার বীণাপাণির হাত বা মুখে আঙুল ঘষে পরখ করতে এলেন যে, সে কতটা পাউডার মেখে এমন ফর্সা! একবার নীলাঞ্জনের চোখে এমন অশালীনতা চোখে পড়তে সে প্রতিবাদ করে বসলো, ‘এটা কেমন অসভ্যতা? মনে রাখবেন আমাদের পূর্বপুরুষের করা বৈষম্য আর পাপেই নিজ দেশে সংখ্যালঘু হয়ে, বিতাড়িত হতে হয়েছে আমাদের!’

শুনে উল্টো হেসে গড়িয়ে পড়ল সবাই আর বীণাপাণি যে তুকতাক জানে, বীণাপাণি আসলে ডাইনি- এ বিষয়ে সবাই একমত হলো। তবু শুরুতে যুদ্ধটা কিছু দিন ভালোই করেছিল নীলাঞ্জন।

‘এসব ছাড়ুন। আপনার আর আমার কাস্ট তো এক নয়। আমার নিজের কাস্টেই কোনো ছেলেকে- বাবা একটি ভালো ছেলে দেখেওছেন-’ বীণাপাণি মাথা নিচু করে বলেছিল, ঢোঁক গিলতে গিলতে। 
‘তোমরা মেয়েরা শ্লা সব প্রতারকের জাত! আমাকে দেবদাস বানাতে চাও, না?’ চেঁচিয়ে উঠেছিল নীলাঞ্জন। সেসব ছটফটানিতে ভুলেছিল বীণাপাণি। কালী মন্দিরে গিয়ে মালা বদল ও কপালে সিঁদুর। কিন্তু তারপরেই শুরু হয় নীলাঞ্জনদের পরিবারে অসহ নিগ্রহ। ফর্সা হলেও বীণাপাণি খুব বেশি লম্বা ছিল না। খুলনা থেকে পালিয়ে এসে শুরুতে কিছু দিন বস্তিতেও থাকতে হয়েছে। বাড়ের সময়টাতেই তেমন ভালো খাবার পায়নি বীণাপাণি- ডিম-দুধ জুটতোই না। সে নিয়েও শ্বশুরবাড়িতে কম কথা শুনতে হয়নি। 
‘ছোট জাতের ভেতর আবার লম্বা হয় নাকি? এত ফর্সা হলো কিভাবে? এদের মায়েরা-দিদিমারা কোথায় গিয়ে কী করেছে কে জানে!’ 

কথায় কথায় যে কোনো নোংরা কথা বলা যেত বীণাপাণিকে। অথচ অন্য জায়েদের চেয়ে সব মিলিয়ে তাকেই সুশ্রীতর দেখতে, তারই রেজাল্ট ভালো ছিল, চাকরিও সে একাই করতো। তবু অন্য জায়েরা, ননদরা বা বাড়ির শাশুড়ি মায়েরা...শাশুড়ি, মাসী শাশুড়ি, পিসী শাশুড়ি, জেঠি শাশুড়ি, কাকি শাশুড়ি থেকে বাড়ির পুরুষেরাও...শ্বশুর, মেসো শ্বশুর, পিসে শ্বশুর, জেঠা শ্বশুর, কাকা শ্বশুর তাকে উঠতে-বসতে ‘সাপ-কুমীর-শেয়াল-বেশ্যা-বাঈজি-পতিতা-ধাঙর-মেথরানী-দলিত কিছুই বলতে ছাড়েনি। 

যদিও বীণাপাণির বাবা পাকিস্তান হবার এক বছর আগেই ইংরেজিতে বিএ পাস, যোগেন মন্ডলের শিষ্য হিসেবে পাক সংসদে তাঁর একাধিক ইংরেজি বক্তৃতার খসড়া রচনাতেও হাত দিয়েছিলেন যা খোদ জিন্নাহর সামনে উচ্চারিত হয়েছিল, অনর্গল ইংরেজি বলতেন...বীণাপাণি বছরখানেক মুখ বুঁজে সহ্য করেছে আর ভেবেছে নীলাঞ্জন এসবের প্রতিবাদ করবে। কিন্তু কোনোদিনই একটিও প্রতিবাদ করেনি। তারপর বীণাপাণির গায়ে সবার হাত তোলা যখন একরকম নিয়ম হয়ে দাঁড়ালো আর বাড়ির জেঠা শ্বশুর নিজে হাসতে হাসতে খাবার টেবিলে সবার সামনে একদিন যেদিন দক্ষিণ ভারতে আগে দলিত মেয়েদের বুক ঢাকার নিয়ম ছিল না বা বুক ঢাকলে ‘কর’দিতে হতো- বড় বুকের দলিত মেয়েদের অনেক কর দিতে হতো বলে; মা হতে শুরু করা বীণাপাণির একটু স্ফীতকায় শরীরের দিকে ঠেস দিয়ে কথা বললে বাড়ির অন্য সব বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ ও নারী সদস্যরাও হেসে গড়িয়ে পড়ল এবং নীলাঞ্জন এটারও কোনো প্রতিবাদ করল না... তখন... অরিন্দম তখন গর্ভে তিন মাসের শিশু... একটি চাকরিকে সম্বল করে... বাবার বাড়িতে এক বস্ত্রে চলে এসেছিল বীণাপাণি বা অরিন্দমের মা। 

‘শোন- ওদের চেয়ে মুসলমানরাও ভালো। আমার কাকাতো দিদির মেয়ে মুসলমান বিয়ে করায় আমরা পাকিস্তানে থাকতি শোকে পাগল হয়ে গিয়িছিলাম ঠিকই কিন্তু ওকে তো সেই সংসারে রাজরানি করে রাকিচে। নাম বদলাতি হয়িচে, ধর্মও বদলাতি হয়িচে... কিন্তু তাকে রাজরানির মর্যাদা আর আদর যে সেই সংসারে দেয় তা সবাই জানে। কেন গেলি মা ওঘরে? অপমান হতি কেন গেলি?’

সেই থেকে বীণাপাণি রায়ের একাকি মায়ের লড়াই। গর্ভের পুত্র একদিন অরিন্দম রায় নামে জন্ম নেয়। খুব জেদি মা বাবার পদবিও দেয়নি তাকে। বাবার মতো পাঁচ দশ না হয়ে পাঁচ আট হলেও বাবার মতো কালো হয়নি। মা’র রং পেয়েছে সে। তা অরিন্দম বড় হতে হতে মা’র ছোট দুই ভাই বা দুই মামাও লেখা-পড়া শিখে, চাকরি-বাকরিতে থিতু। ‘ছোট জাতের মামারা তো বটেই, মামিরাও যেন ‘বড় জাতে’র বাবার ছেলে অরিন্দমকে খানিকটা সমীহ আর মমতার সাথেই বড় করেছে। মা তো চাকরি করেইছে। এমনিতে পথে বের হলে মানুষ চ্যাটার্জি-মুখার্জিদের ছেড়ে অরিন্দমকে তাকিয়ে দেখেছে সবসময়। রাজপুত্রের  মতো চেহারা। তবু পূর্ব বাংলা থেকে ‘ছোট জাতের’রিফিউজি ভরা এই পাড়ার মাঝে তাকে নিয়ে ফিসফাঁস কি তার কাণে আসেনি?’
‘গেছিলো তো তার মা বড় জাতের পোলার লগে বিয়া বসতে। লাথি খাইয়া আসছে। তা পোলাডা বড় সুন্দর।’ 
‘ওই ব্রাহ্মণ পোলা কি আসলেই বিয়া করছিল না জাউরা পোলা?’
‘অগো বিয়া করলে এই জোটে কপালে। তার চেয়ে মুসলমান বিয়া করাও ভালো। মুসলমান তোমার ধর্ম বদলাবে কিন্তু কথায় কথায় অপমান করবে না।” 
‘না- অরিন্দমের মা’র বিয়াই হইছিল। একদিন শুধু একটা তত্ত্ব দিতে বীণাপাণি দি’র শ্বশুরবাড়িতে অর মামাগো সাথে আমারও যাতি হইছিল। কি যে ব্যবহার! মানুষ বাড়ির কামের মাইয়ার সাথেও এর চেয়ে ভালো ব্যবহার করে।’ 
‘বাপ আর খোঁজ নেয় নাই, না?’
‘সে এক গাঙ্গুলি মাইয়ারে বিয়া করছে। তয় দেখছি সেই বেডিরে একবার। কালা- আমাগো বীণাপাণিরেই বরং তার তুলনায় ব্রাহ্মণ মনে হয়। অরিন্দমের বাপও তো কালো- ব্রাহ্মণ তো কি? তয় লম্বা ছিল।’
‘লম্বা কি আমাগো মধ্যে নাই নাকি? বরং বীণাপাণির জন্য যে পাত্র দেখা হইছিল, সে উঁচা-লম্বা আর গায়ের রং- সবকিছুতেই ওই ব্রাহ্মণটার চেয়ে বেশি সুন্দর ছিল।’ 

তখন মাত্র বড় হচ্ছে অরিন্দম। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স। এসব কথা কানে আসার পর হিরোইন বা প্যাথিড্রিনের দিকে ঝুঁকতে গিয়েও যে ঝোঁকা হয়নি; তা একদিন ছোট মামা আর সে বাড়ি থেকে গলিতে বের হবার সময় চায়ের দোকানে তাদের নিয়েই এসব আলাপ শোনার পর ছোট মামা সেদিনই তাকে গিটারের দোকানে নিয়ে গিয়ে মাসের পয়লা তারিখের বেতনে গিটার কিনে দেয়। তার মা’র একাকী লড়াই, মামা-মামিদের সংসারের প্রেক্ষাপট হিসেবে পাড়ায় অন্য মানুষদের মুখের কথা, মামিদের মুখে মাঝে মাঝে ‘দূর দিদি- না হয় উঁচা জাতে বিয়া না-ই করতা’ জাতীয় বাক্যবন্ধ ভুলতে অরিন্দম পড়ার সময়টুকু ছাড়া সব সময়ই গিটার হাতে বসে থাকত। 

তবে পৃথিবীতে তার মায়ের মতই রূপের রক্ষাকবচ নিয়ে জন্মেছিল অরিন্দম। দূরের পাড়ার কোনো মন্দিরের সামনে দিয়ে মা’কে নিয়ে হাঁটতে গেলে, পূজারী ব্রাহ্মণ মা’কে আর তাকে জোর করে ভজন শোনাতে ভেতরে ডেকে আনতো- কিন্তু সে যতটা সময় তার বা তাদের পরিচয় লুক্কায়িত! ততক্ষণই শুধু গৌর বর্ণ বা সুছাঁদ নাক-চোখের আদর। পরিচয় প্রকাশ হলেই যেন নেমে আসবে নিরন্তর অপমান অথবা বড় জোর করুণা। সেসব ভুলতে সায়েন্সের ম্যাথস, ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই পড়ার খাতায় পেন্সিলে লিরিকস লিখে বসতো অরিন্দম। আর এক দুর্বিষহ বিষাদ যার কোনো তল নেই- কোনো কিনারা নেই! সেই দুর্বিষহ বিষাদ ঘোচাতে গুনগুন সুর ভাঁজতো অরিন্দম। 

২. 
যাদবপুরে কম্পিউটার প্রকৌশলে যখন চান্স পেলো অরিন্দম, মা খুব খুশি হয়েছিল। তবে সেই সাথে কেমন এক চিন্তা ও বিষাদও পেয়ে বসেছিল তাঁকে। দিদিমা তখনো বেঁচে। নাতিকে জড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মেইয়ির কষ্ট আমি বুঝি। ওরও তো ভালো রেজাল্ট ছিল। ভালো চাকরি। দাদারে- কোন বড় জাতের মেইয়িকি বিয়ি করিস না।’
অরিন্দম লাজুক হেসেছিল। তারপর আর যাদবপুর। সেখানে দিকে দিকে সাম্যবাদের পতাকা। মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেলিন-মাও সে তুং-গ্রামসি মুখস্থ রাখতে হয় প্রকৌশল বিজ্ঞান থেকে সাহিত্যের ছাত্র- সবাইকেই। তবু অরিন্দমের ‘রায়’ পদবিটি কি ব্রাহ্মণ বা কায়স্থের ‘রায়’ বা অন্য কোনো ‘রায়’ এমন প্রশ্ন প্রায়ই তাকে করে ফ্যালে বিশিষ্ট বাম ছাত্রনেতারা। অরিন্দম উপেক্ষার ভাণ করে পড়ে আর সময়ে-অসময়ে গিটার বাজায়। তটিনী বিশ্বাস নামে মেয়েটির সাথেও এই যাদবপুরেই পরিচয়। মা’র জীবনের দুর্ভোগ মনে ছিল অরিন্দমের। সে জানে ঝকঝকে গাঙ্গুলি-মুখার্জি-চ্যাটার্জি-ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী মেয়েদের সাথে প্রেম হলেও মায়ের মতো হয়তো সেই একই ভবিতব্য। কাজেই পাশ করার পর, তটিনীকে বিয়ে করে বেঙ্গালুরু চলে যাওয়া। তটিনীও আইটি স্পেশালিস্ট- তবে খানিকটা শ্যামলা। বছরের পর বছর আইটি সেক্টরে দু’জনেই পায়ের নিচে মাটি পেতে নিরন্তর সংগ্রাম করার সময়েই মাঝে মাঝে গানের জন্য প্রাণ কাঁদে অরিন্দমের। সে কি এক অখ্যাত, অজ্ঞাত গায়ক হিসেবেই পড়ে থাকবে এই আইটি সেক্টরে? বড় জোর বন্ধু, বন্ধু-দম্পতিদের আসরে প্রতি উইকেন্ডে গিটার বাজিয়ে এক/দুটো গান করা? 

‘আমার কিচ্ছু হবে না, তটিনী!’
তটিনী ল্যাপটপে কাজ করতে করতে বা রুটি বেলতে বেলতে হাসতো। এমন কোনো কাজের বা ব্যস্ততার সপ্তাহ শেষেই একবার সুমিত্র বসু নামের ছেলেটা- বেশ ভদ্র ব্যবহারই ছিল- জীবনেও সে অরিন্দমের ‘রা ‘কোন জাতের ‘রায়’ সেটা জানতে চায়নি- একদিন মোবাইলে ফোন দিলো,
‘ব্যস্ত খুব?’
‘কেন?’
‘শোন- আজ কলকাতা দেখে আমাদের এক দাদা আসবেন। শৌনক গাঙ্গুলী। উনি নতুন চলচ্চিত্র পরিচালক। একটি সিনেমা বানাচ্ছেন। তাঁর সাথে এক নামী সিঙ্গার ও লিরিসিস্ট কথা দিয়ে কথা রাখেনি। টাকা নিয়ে যে কয়টি গানের লিরিকস লিখবে ও সুর করে, গাইবে বলেছিল তার একটিও করেনি। উনি এখন বেশ বিপদে। উনি খুব ফ্রেশ বা নতুন কোনো লিরিসিস্ট ও সিঙ্গারকে খুঁজছিলেন। তুই আয় না একবার আমার বাসায়। ওনার সাথে তোকে পরিচয় করিয়ে দিই!’
‘যাহ- কি বলিস- আমাকে দিয়ে বুঝি আর কিছু হবে?’
‘হবে না মানে? কেন জানি মনে হচ্ছে- শৌনক দা ওনার সিনেমার স্টোরি-লাইন যা বলেছেন তার সাথে তুই গত পরশু কেন্টিনে আমাকে যে ‘আমাকে আমার মতো হারাতে দাও- আমি নিজেকে নিজের মতো পালাতে দিয়েছি’ গানটি বেশ যাবে। প্লিজ, আয়!’

খুব ক্যাজুয়ালি গেছিল অরিন্দম। মনে কোনো প্রত্যাশা না রেখেই। সেই শৌনকদা আর সুমিত্র বসুর সামনে লাজুক মুখে গিটার হাতে যখন গানটি সে ধরলো, শেষ করার পর লাফিয়ে উঠলেন শৌনকদা, ‘তুমি আমাকে বাঁচালে ভাই! কলকাতা কবে আসছো?’
‘মানে?’
‘আরে-স্টুডিওতে প্রফেশনাল রেকর্ডিং করাতে হবে না? আর টুম্বা দা’কেও শোনাতে হবে একবার।’ 
টুম্বাদা মানে অরিজিৎ ভট্টাচার্য? বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির শেষ নিঃশ্বাস? তার সামনে যেতে হবে অরিন্দমকে? বলে কি? সে তো স্বর্গ হাতে পাবার মতো বিষয়। 
‘আমাকে আমার মতো হারাতে দাও- আমি নিজেকে নিজের মতো পালাতে দিয়েছি,
যেটা হয়নি হয়নি সেটা না হওয়াই থাক
সব হলে ভ্রষ্ট জীবন!’
টুম্বা দাকে দেখা গেল হাতে সিগারেট নিয়ে বিস্মিত, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। 
‘আমি ওদিসিয়ুস
কর্ফূ দ্বীপে এসেছি
পদ্মভুকদের রাজ্যে,
আমার রণতরী হেরে লুপ্ত
তবু কাব্য গাইছি বাঁচবার
আমি শুনতে চাই না আর তার
কোনো ভর সন্ধ্যের আবদার...
না না না না না’-
‘শৌনক- হুম ইউ হ্যাভ কালেক্টেড, ম্যান? দিস সং উইল রিভাইভ মি- ইট উইল গিভ মি লাইফ এগেইন!’

গান শেষ হলে স্বয়ং টুম্বাদা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন অরিন্দমকে। তারপরের গল্পটি পুরোটাই রূপকথা। শত শত বিলবোর্ডে-রেডিওতে-সিনেমার প্লেব্যাকে-ম্যাটিনী বা ইভনিং শোতে-রিকশা-বাস-স্কুটার-গাড়ি-পাব-ভার্সিটি-কলেজ ক্যাম্পাসে অরিন্দম রায়। দেবদূত প্রতিম দেখতে এক যুবক যার পিছে লাখ লাখ বিশ্বাস-মন্ডল-চ্যাটার্জি-ব্যানার্জি-রহমান-খানসহ যাবতীয় তরুণ-তরুণীরা অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে দৌড়াচ্ছে দুই বাংলায়। সে সব বাঙালি মেয়ের স্বপ্নের রাজপুত্র। আর তখনি- তটিনীর সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিলো। তটিনী ভয় পাচ্ছিল তাদের প্রতিদিনের সহজ জীবনে হুট করে এসে পড়া এতটা আলো, এতটা স্টারডম, এত ক্যামেরার ঝলকানিকে। সে আর একটু সাধারণ জীবন চাচ্ছিল। বর-বউয়ের সকালে কাজে বের হয়ে পড়া, উইকেন্ডে বন্ধুদের বাসায় অরিন্দম না হয় গিটার হাতে একটু গান গাইবে আর চাকরিতে সেটলড হতেই এতগুলো দিন যখন লেগে গেল- এখন একটু একটু করে সন্তান নেবার পথে পা বাড়ানো। 

‘তুমি আমার গান চাও না? আর ইউ বিয়িং জেলাস অব মাই স্টারডম?’ চেঁচাতো অরিন্দম। 
‘কি বলছো তুমি? তোমার নাম-খ্যাতি...কিন্তু আমরা যে এতদিন পর্যন্ত খুব সাধারণ মানুষ ছিলাম।’ 
‘ওহ- তাই বলে কোনো দিন নাম-ধাম আমাদের হতে পারবে না, না?’
‘এভাবে বলছো কেন?’
‘এভাবে নয়তো কীভাবে বলব?’
‘তাই বলে আইটির এত ভালো চাকরি ছেড়ে ফুল টাইম সিঙ্গার হওয়া- অনেক ঝুঁকি নেওয়া না? মানে জনপ্রিয়তা তো সব সময় না-ও থাকতে পারে।’
‘ওহ- আমাকে খোঁটা দিচ্ছ? নো- আই মাস্ট ফলো মাই প্যাশন। আমার সাথে সব ছেড়ে কলকাতা যেতে পারলে চলো আর নয়তো!’
আর তেমন উত্তাল জনপ্রিয়তার পথে সওয়ার হবার সময়ই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল কাঁচা হরিদ্রাভ বর্ণের ব্রাহ্মণ তরুণী প্রিয়তী গোস্বামীর। নতুন ফ্যানডমের সিঁড়ি বেয়ে নতুন কিছু বন্ধুর মাধ্যমে। 
‘আপনি এখনো কলকাতায় ফুল টাইম হিসেবে চলে আসছেন না কেন? আপনার মতো সিঙ্গার কেন আর দশজন কেরানির মতো ৯-৫টা চাকরি করবে? সে যতই  য়েল পেয়িং জব হোক?’

একটা সময় অরিন্দমের মনে হতে থাকে প্রিয়তীর মতো শুভাকাঙ্ক্ষি তার একজনও নেই। এমন নারীই তো চাই যে একটি পুরুষকে তার স্বপ্নের পথে হাঁটতে সাহায্য করবে। কাজেই মনে কোনো দ্বিধা রাখেনি। মায়ের চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখেও না। 
‘ব্রাহ্মণরা কেমন ব্যবহার করবে বাবা কে জানে!’
‘কিন্তু প্রিয়তী আমার গান ভালোবাসে, মা। আর সময় আরো এগিয়েছে।’
‘তটিনী কি দোষ করলো?’
‘ও আমার পালস্ বোঝে না, মা!’
‘সময় এগিয়েছে বললি- সময় কি সত্যিই এগিয়েছে?’

মা’র মৃদু প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে, দ্রুতই তটিনীকে ডিভোর্স করে প্রিয়তীকে জীবনে স্থান দিয়েছিল অরিন্দম। আর তারপরই... প্রিয়তীদের বাসায় গিয়ে সে বোঝে সময় হয়তো আসলেই এগোইনি। বেতারে-টিভিতে-সিনেমায় লাখ লাখ মানুষের হার্টথ্রব অরিন্দমের ‘রায়’ আসলে কোন কাস্ট বা জাতের ‘রায়’ সে প্রশ্ন প্রিয়তীর বাবা-কাকা-জেঠা-মাসি-মেসো-পিসি-পিসে-কাকি-জেঠি-মা সবাই করেছিলেন। উত্তর শুনে একটু নিশ্চুপও হয়েছিলেন। একই খাবারের টেবিলে প্রিয়তীর কাকাতো বোনের বর আসিফ আলী খানও ছিল। তাকেও যতটুকু যত্ন করা হয়েছিল প্রিয়তীদের মার্ক্সিস্ট পরিবারে (আসিফ আলী খান একজন ভালো ব্যবসায়ী মাত্র), দেশের বিশিষ্ট সংগীত তারকা অরিন্দমের ততটা যত্ন যেন করা হয়নি। এমন আচরণ কয়েকবারই পাবার পর সে নিজেই শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। না, মা বীণাপাণি রায়ের মতো অত বাজে সব কথা তাকে শুনতে হয়নি- হয়তো পুরুষ বলেই বা শ্বশুরবাড়িতে থাকে না বলে- তবে কেমন একটা অস্বস্তি তাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যে আছে সেটা বুঝতে পেরেছে। যা আসিফ আলী খানকে নিয়ে নেই। আসিফ আলী খান যে তার চেয়ে দেখতে ভালো তা-ও নয়। বাড়ির আরো দু-তিন জন উচ্চবর্ণ জামাই কেউই যে তার চেয়ে সুন্দর বা গুণী বা খ্যাতিমান তা নয়। তবে তারা ‘চক্রবর্তী’ থেকে ‘রায় চৌধুরী’ বা ‘দাশগুপ্ত’ হয়ে নিদেনপক্ষে ‘আলী খান’- এসবের পাশে তার সব দৈহিক উচ্চতা-গৌর বর্ণ-টিকোলো নাক-প্রকৌশলে ডিগ্রি- মিলিয়ন মিলিয়ন শ্রোতা-দর্শকের ফ্যানডম সবই তুচ্ছ! প্রিয়তীও তার অদেখা বাবা নীলাঞ্জন চ্যাটার্জির মতো কোন প্রতিবাদ করল না এসব সুক্ষ্ম, অপমানকর আচরণের। 

৩.
‘পেশওয়াদের রাজধানী পুনায় অস্পৃশ্যকে নিজ কোমরে একটি ঝাড়ু ঝুলিয়ে রাখতে হতো যা পুরো রাস্তা তার চলার সাথে সাথে ঝাড়ু দিতে দিতে যাবে, কারণ কোনো হিন্দু যদি অস্পৃশ্যের পায়ে মাড়ানো ধূলির ওপর নিজের পবিত্র চরণে হাঁটে, তবে তাতেও সে দূষিত হবে। পুনায় অস্পৃশ্যদের পথ চলার সময় গলায় একটি মাটির পাত্রও ঝুলিয়ে রাখতে হতো যার ভেতর তাকে থুতু ফেলতে হবে- যেন তার মুখের থুতু পথে পড়লে তার ওপর দিয়ে ভুলেও কেনো হিন্দুকে পায়ে হেঁটে দূষিত হতে না হয়।’ 

আম্বেদকারের বইটা পাশে মুড়িয়ে একটি সিগারেট ধরায় অরিন্দম। প্রিয়তী তাকে ছেড়ে চলে গেছে কিছু দিন। অনিঃশেষ ভট্টাচার্য নামে অরিন্দমের অভিনেতা বন্ধুর সাথে। প্রথম যেদিন অনিঃশেষ এই বাসায় আসে, দ্রুতই প্রিয়তীর সাথে অরিন্দমের সামনেই টিপিক্যাল ব্রাহ্মণ বাড়ির নানা আচার-বিচার, সংস্কার নিয়ে দারুণ আড্ডা জমে উঠেছিল। নিজেকে কেমন অপাংক্তেয় বোধ হচ্ছিল অরিন্দমের তখন! যদিও সে অরিন্দমের চেয়ে ইঞ্চি খানেক লম্বা, আরো দু’পোঁচ ফর্সা... জনপ্রিয়তা তার এক তিল কম নয়...তবে সে ‘রায়’। তারপর প্রায়ই অনিঃশেষ তাদের বাসায় আসে। এক কিংবদন্তি বাংলা নায়িকার দৌহিত্রী ও অভিনেত্রী মধুরিমা সেনের সাথে সম্পর্ক ভেঙে অনিঃশেষ তাদের বাসায় আসে। তারা কাশ্মীর, জেএনইউ-এর ছাত্রনেতা উমর খালিদ ও তার প্রেমিকা বনজ্যোৎস্না লাহিড়ীর প্রেম নিয়ে গল্প করতে করতে কিভাবে ওপার থেকে আসা ছোটজাতের রিফিউজিদের ভেতর বিজেপি জনপ্রিয় হচ্ছে সে বিষয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা ব্যক্ত করে। তারা প্যালেস্টাইন নিয়ে গল্প করতে করতে আসছে দুর্গাপূজায় কার ছোটবেলার পাড়ায় দুর্গাপূজা কমিটিতে সিপিএম করা কোন কোন জেঠু বা কাকু এখনো পূজা কমিটির দায় সামলাচ্ছেন সেসব গল্প করে। অরিন্দম তাদের জন্য বিফ কাবাব মাইক্রোওয়েভে নিজেই গরম করতো যদিও তাদের ছোট জাতের কলোনিতে শৈশবে বিফ নিষিদ্ধ ছিল। উচ্চবর্ণরা কিনা খুবই সেক্যুলার আর প্রচন্ড মার্ক্সবাদী তবে শুধু অরিন্দম তার পদবি আড়াল করে থাকতে পারলে যেন বাঁচে এ দেশে! 

‘আমি ভবঘুরে ঘুড়ি...
যে আমাকে বুঝবে ভালো
তার দিগন্তেই উড়ি।’ 

সমস্ত লজ্জার মাথা খেয়ে তটিনীকে দু-একবার ফোন করেছিল সে। কোনো উত্তর আসেনি। আর দেবস্মিতা নামের মেয়েটি তো তাকে ভালোবাসেই। ওরও প্রথম ঘরটা ভেঙেছে। দেবস্মিতা প্রিয়তীর মতো ব্রাহ্মণ নয়, আবার দলিতও নয়। প্রিয়তীর মতো গৌরী নয়, তবে ছিপছিপে দেখতে- গানে নাম করছে। শেষবারের মতো সংসারযাত্রায় সওয়ার হবে কি সে?

‘বাবাসাহেব আম্বেদকার- তোমার লড়াইয়ের বা আমার মায়ের লড়াইয়ের শতাংশ আমাকে করতে হয়নি। সুন্দর চেহারা, মেধা আর প্রতিভার জোরে ভেবেছিলাম আমি সব জয় করতে পারব। কিন্তু প্রিয়তী যখন আমাকে ছেড়ে গেল- ওই শৌনকদা থেকে সবার ভেতর আমাকে নিয়ে কোনো কষ্ট তো দেখিনি? তুমি ঠিক বলেছো বাবাসাহেব- খ্রিষ্টান বা মুসলিমরা যদি অন্যকে ধর্মান্তরিতও করে, ওরা আমাদের মতো বর্বর নয়, আমাদের মতো নীচ নয়। কেন আমরা বাংলাদেশ ছেড়ে এলাম, বাবাসাহেব? আমি কতদিন এভাবে পারব?’

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে ক্লাস টু’য়ে একদিন অঙ্ক না পেরে বেঞ্চিতে দাঁড়ানো সেই ছেলেটির মতো কাঁদতে থাকে দুই বাংলার হৃদয় কাঁপানো সেলিব্রিটি গায়ক, চল্লিশ বছরের অরিন্দম রায়। 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়