ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘নব্বইয়ের পর একঝাঁক কথাসাহিত্যিক আর আসেনি’

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৬, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১১:০৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
‘নব্বইয়ের পর একঝাঁক কথাসাহিত্যিক আর আসেনি’

পাপড়ি রহমান খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, গবেষক, অনুবাদক এবং সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় বাংলাদেশের ছোটগল্প : নব্বইয়ের দশক এবং গবেষণাগ্রন্থ ভাষা শহীদ আবুল বরকত প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৪০। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে লিখেছেন ধ্রুপদী উপন্যাস ‘বয়ন’। লেখায় কুশলী এবং অকপট এই কথাশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি 

বাংলাদেশের নব্বই দশকের গল্প নিয়ে আপনার উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। আপনি কি মনে করেন এই সময়ের লেখকরা কথাসাহিত্যে নতুন ভাষা তৈরি করতে পারছেন? মোদ্দা কথা বর্তমান কথাসাহিত্যের ভাষা প্রবণতা নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই। 

ভাষা নদীর স্রোতের মতো। সদা পরিবর্তনশীল। কোনো দশকের ভাষা কেউ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। সেটা সম্ভবও নয়। তবে টেক্সট হিসেবে থেকে যায়। পূর্বের লেখকদের লেখাপত্র পড়ে নেয়া বা অনুজদের লেখাপত্র পড়া সাহিত্যের রুটিন ওয়ার্কের ভেতর পড়ে বলে মনে করি। তবে বিস্মিত হতে পারি, এরকম নতুন কোনো কাজ চোখে পড়ছে না। এমনও হতে পারে, কাজ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তম সাহিত্য কিন্তু তাই, দৃষ্টির আড়ালেই রচিত হয়। ভাষায় নানা রকম ভাঙচুর হয়। হবেই। বাংলাদেশের একটা নিজস্ব বাংলাভাষা আছে। আমরা কিন্তু আমাদের সেই নিজের ভাষাতেই লিখছি। তরুণরাও লিখছে। তবে নব্বইয়ের পর একঝাঁক কথাসাহিত্যিক কিন্তু আর আসেনি- বিষয়টি আমাকে ভাবায়।

ভাষা শহিদ আবুল বরকতকে নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন। এই কাজটি করার পরিকল্পনা কখন- কীভাবে করেছিলেন? 

তখন বাংলা একাডেমির ডিজি ছিলেন শামসুজ্জামান খান। বিষয়টি ঘটেছিল আমার ‘বয়ন’ উপন্যাস লিখবার পর। জামানভাই এই উপন্যাসের একটা রিভিউ লিখেছিলেন ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায়। অবশ্য তখন আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। পরে যোগাযোগ হয়। আমি কাজ খুঁজছিলাম। বাংলা একাডেমি তখন ভাষা শহিদদের নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জামানভাই তখন আমাকে ভাষা শহিদ আবুল বরকতের ওপর গবেষণার কাজটি দিলেন। এ জন্য আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। 

আমরা কি ভাষা শহিদদের জীবনদর্শন চর্চায় রাখতে পেরেছি বলে আপনি মনে করেন?

ভাষা শহিদদের জীবনদর্শন চর্চায় না রাখলে আজও বাংলাসাহিত্য বা বাংলাদেশের সাহিত্য রচিত হচ্ছে কী করে? ইংরেজির আগ্রাসন ঘটছে বলেই বাংলাভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এমন নয়। আমি মনে করি, যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, বাংলাভাষাও থাকবে।  অতুলপ্রসাদ সেন সেকথা বলেও গিয়েছেন- ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’

‘জলময়ূরীর সংসার’ গল্পের কথা ধরে যদি বলি- শরীরী ভাষার জোরালো উপস্থাপন আছে। এই যে যেখানে যে ভাষা প্রয়োগের যৌক্তিক দাবি তৈরি হয়, কী অবলীলায় প্রয়োগ করতে পারেন- এ নিয়ে কখনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল?

এটা আমার একটা উল্টোস্রোতের গল্প। আমি দেখিয়েছি একজন নারীর স্বভাব জলময়ূরীদের মতো। সন্তান জন্মানোর পর সন্তানের জনক ও সন্তানকে ফেলে অন্য পুরুষের কাছে চলে যায়। পূর্বের প্রেমিককে ওর আর ভালো লাগে না। যেখানে যে ভাষা প্রয়োগ করা দরকার সেখানে সেই ভাষা প্রয়োগ করি। কেন নয়? আমার লেখায় প্রচুর শরীরী বিষয়আশয় রয়েছে। আছে। থাকবে। অবশ্য সেসব চরিত্রের প্রয়োজনেই; একদম ন্যাচারালভাবে। মনে রাখতে হবে, যৌনতা কিন্তু জীবনের প্রধান অংশ। এই পৃথিবী যৌনতাহীন হলে মানব প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে। এ জন্য সমস্যায় পড়তে হয়নি। শরীরী বিষয়টা আমি শিল্পের প্রলেপে মুড়ে দেই। ফলত সেটা আর ইনডিসেন্ট মনে হয় না। জানি না, পাঠক ভালো বলতে পারবেন। 

জীবনে প্রথম পাওয়া প্রেমপত্র হারিয়ে ফেলার গল্প এবং তার পরের গল্প জানতে চাই।

আমাদের সমস্ত জীবনই হারিয়ে ফেলার গল্প বা ঘটনায় টইটুম্বুর। প্রথম প্রেমপত্র পাই সপ্তম শ্রেণীতে। সে পত্রের ভাষা ওই বয়সেই এত অবসিন লেগেছিল যে বলার নয়। এই ধরো-  চুম্বনটুম্বন দিয়ে শুরু হয়েছিল। মোদ্দাকথা, আমি উত্তর দেইনি। জানি না ছোটকাল থেকেই হয়তো আত্মসম্মানের বিষয়ে সচেতন ছিলাম। বাসায় কড়া শাসন ছিল। ওই পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলতে হলো। দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় সিরিয়াস প্রেমে পড়লাম। এবং এই পত্রলেখকের পত্রের উত্তর দিলাম। তখন ছিল চিঠিযুগ। বিস্তর পত্র তিনি লিখেছেন আমাকে। আমিও তাঁকে। সেসব আমার আম্মার বাসায় রেখেছিলাম একটা ট্রাঙ্কে। সেই ট্রাঙ্কের সবকিছুই একদিন দেখি উধাও! তালাভাঙা! ওই ট্রাঙ্কে আমার প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ছিল। যেমন আমার আব্বার লেখা চিঠি। এক ডাক্তার পত্রবন্ধুর অজস্র চিঠি। আম্মা বলল, আমার ভাই নাকি তালা ভেঙে দেখেছে ট্রাঙ্কে কী আছে? আমি আমার ভাইকে এসব নিয়ে কোনো দিন কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু আমি আমার গচ্ছিত চিঠিগুলো আর ফেরতও পাইনি। তারপর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বহু কবি, সাহিত্যিকের সঙ্গে চিঠি ওড়াউড়ি হয়েছে। দুই, একজনের সঙে প্রেমপত্রও। কিন্তু সেসব স্থায়ী হয়নি। এরপর একজন কবির সঙ্গে ছিল চিঠি লিখবার দিন-মাস-বছর। ওর চিঠি আমার খুব ভালো লাগতো। সেসব প্রেমপত্র ছিল না কিন্তু। একদিন ছিনতাই হয়ে গেল ওই চিঠিগুলোও। আর একদিন ওই পত্রলেখকও হারিয়ে গেল। আমি কিন্তু একটি চিঠির জন্য এখনো অপেক্ষা করি। একটা চিঠি আসুক আমার নামে। মুক্তার মতো ঝকঝকে অক্ষর আর প্রচণ্ড উইটিতে ভরা হোক সেসব চিঠি। খানিকটা লিটরেচার, খানিকটা ফিলোসফি। আর অনেকটা আন্তরিকতা। কিন্তু হায়! দিন যায়, আর কেউ লেখে না। বুঝতে পারি পাতাঝরার সময় সমাসন্ন। চিঠির পাওয়ার দিন ফুরিয়েছে আমার।

লেখক হিসেবে যে দহন, যেসব পরাজয়ের যন্ত্রণা তা লেখায় প্রকাশ করার জন্য কী করেন?

লেখক হিসেবে খুব বেশি দহন বা পরাজিত হয়েছি এ রকম মনে করি না। কোনো কোনো  দলকানাদের জন্য পুরস্কার-টুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছি- এ কথা হয়তো সত্য কিন্তু পরাজিত কভু নয়। কারণ পুরস্কার না দিয়ে ওইসব গোষ্ঠী আমার লেখা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেনি। বরং নিজেদেও ক্ষুদ্রতাকেই তারা প্রকাশ করেছে। লেখক হিসেবে আমাকে আন্ডার রেইটেড রাখতে চেয়েছে। হয়তো মুছে দিতে চেয়েছে নাম। এসব বিষয় এত সিলি লাগে যে, সেসব প্রকাশ করতে হবে এ রকমও ভাবি না। তাদের নিয়ে লিখতে হবে কেন? আমার লেখার যেমন মূল্য রয়েছে, তেমনি আমার সময়েরও অনেক মূল্য রয়েছে। তবে এটা মানি, নারী হিসেবে অন্যদের চাইতে আমাকে ঢের বেশি স্ট্রাগল করতে হয়, হয়েছে। আর পরিশ্রমী লেখক হলে কেউ না কেউ পাশে দাঁড়িয়ে যায়। আমার লেখার মূল্যায়ন যারা করে তারা অত্যন্ত উচ্চশ্রেণির লেখক ও পাঠক। 

জীবন আপনার কাছে কী, প্রেম কী, ভাষা কী?

জীবন আমার কাছে হাওয়াই মিঠাই। খুব মেদুর রঙে মন কাড়ানিয়া কিন্তু এত ক্ষণস্থায়ী! বুঝতে না-বুঝতেই ফুরিয়ে যায়! কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি মনে করে কাদবার মতো একজন মানুষও না। কিংবা জীবন হলো জগদ্দলপাথর। চেপে বসা ও একইরকম স্থির থাকা। এই জীবনপাথর বুকের ওপর সারাক্ষণই চেপে থাকে। ফলত দম ফেলতেও কষ্ট হয়। পাথরে ফুল ফোটে না। জীবনও তেমন ফুলহীন বিবর্ণ বিষাদেও স্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই। আমি অন্তত দেখিনি বা পাইনি কোনো সত্যিকার প্রেম। দেখেছি রূঢ়তা ও হুঙ্কার। আর দেখেছি প্রতারণা, স্বার্থপরতা। তবে আমার প্রিয় কিছু প্রেমিক জুটি আছেন। জ্যাঁ পল সার্ত্র আর সিমন দ্য বেভোয়ার। এদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং, নিবেদন, সাধনসঙ্গী হয়ে পথ চলা, এ রকম চেয়েছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। আরেক জুটি পাঞ্জাবী লেখক অমৃতা প্রীতম ও ইমরোজ। এদের প্রেমের উপাখ্যান পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছি। ওই ইমরোজের মতো স্যাক্রিফাইসিং কাউকে পেলে হয়তো প্রেম কি তা জানা যেত। বোঝা যেত। জীবনব্যাপী এরকম একজন ইমরোজের জন্য অপেক্ষা করলাম, কিন্তু পাইনি তেমন কাউকে। আমার কাছে প্রেম হলো নিবেদন। প্রেমিক মানে হিতৈষী ও স্যাক্রিফাইস। 

আর ভাষা? ভাষা আমার প্রাণ। ভাষা আমার গান। আমার দেশ ও জন্মভূমি। ভাষা আমার অহঙ্কার। ভাষার জন্যই আমি বাঙালি। এককথায় ভাষা আমার অস্তিত্ব। এবং ভাষা প্রকাশের জন্যই আমি কিন্তু লেখক। ভাষা না থাকলে কীভাবে লিখতাম বই? প্রকাশ করতাম নিজেকে? আর বাংলাভাষী হওয়ার জন্য আমি গর্বিত। আনন্দিত। পুনর্জন্ম হলে এই বাংলাদেশেই জন্মাতে চাই। হতে চাই বাংলাভাষী। ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা...। 

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়