ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

চৌদ্দ শতক জমিই কাল হয়েছে বিধবা আয়শার  

শাহীন আনোয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ৪ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৬:৩৪, ৪ মার্চ ২০২১

সকাল সাড়ে ৮টা। ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে নির্বাক বসে ছিলেন বৃদ্ধা আয়শা খাতুন (৬৫)।

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে নিভৃত গ্রাম জনার্দ্দনপুরে তার বাড়ি। বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না।

আয়শা খাতুনকে সবাই চেনেন। তার স্বামী নাই, নেই সন্তানও। বসতঘর বলতে মাটির ডোয়া। জরাজীর্ণ পাঠকাঠির বেড়া। ঘর জুড়ে ইঁদুরের বসতি। জীর্ণ বেড়া খসে খসে পড়ছে। ভেঙে যাচ্ছে মাটির ডোয়া। গত বছর ঝড়ে টিনের চালটি উড়ে যায়। কোনমতো চালটা আবার বসিয়ে রেখেছেন। বাতাস আসলে যেকোনো সময় আবার পড়ে যেতে পারে। ঘরের মেঝেতে চট বিছিয়ে ঘুমান তিনি।

কথা হয় আয়শা খাতুনের সঙ্গে। বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার। বাকরুদ্ধ তিনি। কিছুক্ষণ পর আবারও বলতে শুরু করলেন তার জীবন-সংগ্রাম আর অসহায়ত্বের গল্প।

স্বাধীনতার পর ১২ বছর বয়সে আয়শার বিয়ে হয়। তার বাবার বাড়ি মহম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া ইউনিয়নের ছোট কলমধারী গ্রামে। অভাব আর দারিদ্রতার মাঝেই  তার জন্ম। বিয়ে হয় স্বামী ওয়াজেদ শেখের সঙ্গে। ওয়াজেদ ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক। সম্বল বলতে ছিলো স্বামীর চৌদ্দ শতক জমি। এর ওপর বসত ভিটায় তার সংসার ছিলো।স্বামী মারা যাবার পর এখানে একা বাস করেন তিনি।

এই এক খণ্ড জমিই এখন আয়শার বিপদের কারণ। নিঃসন্তান এই বৃদ্ধার জমিটুকুর ওপর প্রতিবেশিসহ অনেকের লোলুপ দৃষ্টি।  দশ বছর আগে স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর আরও অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। বাবা-শ্বশুর বাড়ির কূলে তাকে দেখার আর নেই।

আয়শা খাতুন জানান, প্রতিবেশী কয়েকজন তাকে একঘরে করেছেন। তার সঙ্গে কেউ কথা পর্যন্ত বলেন না। কয়েক দিন আগে গভীর রাতে তার ঘরের বেড়ায় কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। টের পেয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলায় সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। ঘরের বেড়ায় আগুনের পোড়া চিহ্ন এখনো স্পষ্ট। গভীর রাতে ঘরে ঢুকে তাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য ভয় দেখান বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আয়শা খাতুন বলেন, ‘আমার কেউ না থাকায় সবাই আমার জমিটুকু দখল করতে চান। কিন্তু আমি অন‌্য কোথাও যেতে চাই না। এমনকি জমি বিক্রি করতে চাই না। স্বামীর ভিটায় মরতে চাই। ’

জমি দিতে না চাওয়ায় প্রতিবেশী কয়েকজন তাকে উচ্ছেদ করার জন্য নানা হয়রানি ও অত্যাচার করছেন। কয়েক বছর আগে থানায় অভিযোগ করেও তিনি প্রতিকার পাননি। অসহায়-দরিদ্র হওয়ায় সমাজপতিরা তার সঙ্গে কেউ নেই বলে তিনি জানান। অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।

আয়শা খাতুন বলেন, ‘শুনছি সরকার ঘর বানায় দিচ্ছে। আমার বাড়ির আশপাশে বড়লোকেরা ঘর পাইছে কিন্তু আমারে কেউ দেয় না। চেয়ারম্যান-মেম্বরগের পাছে বছরের পর বছর দোড়োইছি। কোনো লাভ হয় নেই। বয়স্ক-বিধবা বা দশ টাহার চালির কার্ড কোনোডাই আমার কপালে জুটি নেই।’

বৃদ্ধ আয়শা আরও বলেন,  ‘গত বছর ঝড়ে ভাঙ্গে পড়া ঘর আর সারতি পারি নেই। ঘর সারবো যে, আমার কোনো টাহা-পয়শা নাই। ঘরডা পড়ে গিলি ভিটেততে আমারে উচ্ছেদ করে দিবেনে। আপনারা সরকাররে এটটু কবেন আমার এটটা সরকারি ঘর খুবই দরকার। আমারে যেন এটটা ঘর বানায় দেয়।’

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রউফ মিয়া জানান, নিঃসন্তান বিধবা আয়শা নিদারুণ কষ্টে আছেন। তার স্বামীর বসত ভিটার ওপর অনেকের লোভ। অসহায় এ নারীকে দেখার কেউ নেই। নিদারুণ কষ্টে আছেন তিনি। তার একটা সরকারি ঘর খুবই দরকার।

জর্নাদ্দনপুর এলাকার দীঘা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও বর্তমানে প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা খোকন মিয়া জানান, আয়শা খাতুনের বিষয়টি তিনি জানেন। অল্পদিন হলো চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। অসহায় ও নারীর নিরাপত্তা ও সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার জন্য তিনি তৎপর হবেন বলে জানান।

মহম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তারক বিশ্বাস বলেন, ‘বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’  তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয়ও পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানান তিনি।                                                    

মাগুরা/বুলাকী

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়