থামছে না ছোট্ট মীমের কান্না
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম
স্বজনের কোলে মীম
‘মা, আব্বা, তোমরা আমাকে কেন নিয়ে গেলে না, আমি এখন তোমাদের কোথায় পাবো? কে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে? আমি কার কাছে থাকব?’ এসব কথা বলছে আর অঝোরে কেঁদে চলেছে ছোট্ট মীম। কান্না থামছে না তার।
মা, বাবা ও ছোট দুই বোনকে হারিয়ে কান্নাই যেনো তার জীবনের একান্ত সঙ্গী হয়ে উঠেছে। তার কান্নায় আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। তার পাশে থাকা অন্যরাও নীরবে চোখের কোন মুখে নিচ্ছে বারবার।
ছোট্ট শিশুটিকে শান্তনা দেওয়ার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন স্বজনরা। মীমের কান্নায় চোখ ভিজে উঠছে তাদেরও। শোকাবহ এ চিত্র খুলনার তেরখাদা উপজেলার সদর ইউনিয়নের পারোখালী গ্রামের শিকদার বাড়ির। পারোখালীতে এখন চলছে শোকের মাতম।
শিশু মীম গতকাল সোমবার (৩ এপ্রিল) একই সঙ্গে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীতে বাবা মনির শিকদার, মা হেনা বেগম, বোন সুমী ও রুমীকে সারা জীবনের জন্য হারিয়েছে। একইদিন ভোরে দাদিকেও হারায় সে। একসঙ্গে এত স্বজন হারিয়ে এখন নির্বাক দৃষ্টিতে খুঁজে ফিরছে আপনজনদের।
এদিকে, মঙ্গলবার (৪ মে) দুপুরে খুলনার তেরখাদা সদর ইউনিয়নের পারোখালী ফাঁকা মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মনির শিকদার, তার স্ত্রী হেনা বেগম ও তাদের দুই কন্যা শিশু সুমী ও রুমীর। পরে মনির শিকদারের মা লাইলী বেগমের কবরের পাশেই তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।
এমন শোকাবহ পরিস্থিতিতে জানাজায় সর্বস্তরের শোকাহত মানুষের ঢল নামে। জানাজা শেষে পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে পাঁচ জনের লাশ দাফন করা হয়। মায়ের পাশেই দাফন করা হয় মনির শিকদারকে। তেরখাদার মানুষ এর আগে এমন শোকাবহ দৃশ্য আর দেখেনি।
জানাজায় উপস্থিত ছিলেন জেলা আ'লীগের যুগ্ম-সাধারণ সষ্পাদক মো. কামরুজ্জামাল জামাল, তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম, উপজেলা আ'লীগের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান এফএম অহিদুজ্জামান, মহানগর যুবলীগের সভাপতি মো. শফিকুল রহমান পলাশ, অধ্যক্ষ মাওলানা কবিরুল ইসলাম ও মাওলানা শারাফাত হোসেন দিপু প্রমুখ।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সেহেরি খেয়ে রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১১ মসজিদ মার্কেটে কাপড়ের দোকানদার মনির শিকদার তেরখাদা সদর ইউনিয়নের পারোখালী গ্রামের বাড়িতে মমতাময়ী মাকে শেষবারের মতো দেখতে তিন কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু মাকে শেষবারের মতো আর দেখা হলো না। নিজেই সপরিবারে পরপারে পাড়ি জমালেন।
পদ্মা নদীতে বালু ভর্তি বাল্কহেডের সঙ্গে যাত্রীবাহী স্পিডবোটের সংঘর্ষে স্ত্রী হেনা বেগম, কন্যা সুমি খাতুন (৭), রুমি খাতুন (৪) ও মনির শিকদার নিহত হন। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যায় শুধু তাদের ৯ বছর বয়সী মেয়ে মীম খাতুন।
মীম জানায়, সে কাপড়ের ব্যাগ ধরে ভেসেছিল। পরে ভেসে ভেসে নদীর কূলে গিয়ে ওঠে। মা-বাবাকে খুব বেশি মনে পড়ছে।
অঝর নয়নে কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, ‘মা, আব্বা তোমরা আমাকে কেনো নিয়ে গেলে না?’
নিহত মনির শিকদারের ভাই মো. কামরুজ্জামান এ প্রতিবেদককে জানান, রোববার (২ মে) রাতে তাদের মা লাইলী বেগম (৯০) বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে শুক্রবার (৩০ এপ্রিল) নারায়ণগঞ্জ থেকে নিজের (ওয়ালটন) শোরুম বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন তিনি।
সোমবার (৩ মে) সেহেরি সেরে ঢাকার মিরপুর থেকে তেরখাদায় বাড়ির উদ্দেশ্যে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ফিরছিলেন ভাই মনির শিকদার। পদ্মা নদীর শিবচর এলাকায় পৌঁছে মনির শিকদারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার ভাইপো মিরাজ শিকদারের। সেখানেই শেষ কথা হয়েছিল তাদের। মিরাজ তার নানীকে নিয়ে আগের স্পিডবোটে পদ্মা পেরিয়ে তেরখাদায় আসে।
পরে তারা জানতে পারেন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় পদ্মা নদীতে একটি বালু ভর্তি বাল্কহেডের সঙ্গে যাত্রীবাহী স্পিডবোটের সংঘর্ষে ২৭ জন নিহত হয়েছেন।
মীমের ছোট চাচা কামরুজ্জামান বলেন, ‘মা-বাবা ও দুই বোনকে হারিয়ে শিশু মীম এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। জানাজার পর তাকে তেরখাদার পানতিতায় তার নানা বাড়ি রেখে এসেছি। কিন্তু তার কান্না যেন আর থামছে না। অবুঝ মীমকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই আমাদের।’
তিনি বলেন, ‘নিহতদের মরদেহ পারিবারিক কবরস্থান আমার মায়ের পাশে সারিবদ্ধ করে দাফন করেছি। এসময় কথা শেষ না করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পক্ষ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে মীমের জন্য এক লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মীমের বিয়ের আগ পর্যন্ত তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/সনি
আরো পড়ুন