ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

মেয়াদ শেষেও তৈরি হয়নি ঘর, অর্ধেক করে ফেলে রেখেছে ঠিকাদার

সাইফুল ইসলাম আকাশ, শরীয়তপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:০৫, ৭ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ২১:০৬, ৭ এপ্রিল ২০২৪
মেয়াদ শেষেও তৈরি হয়নি ঘর, অর্ধেক করে ফেলে রেখেছে ঠিকাদার

শরীয়তপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি করা একটি ঘর

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ, অথচ এখনো শুরু হয়নি ভবন নির্মাণের কাজ। আবার কিছু ভবনের কাজ শুরু হলেও অর্ধেকটা করে ফেলা রাখা হয়েছে কয়েক মাস ধরে। কয়েকটা ভবনের কাজ শেষ হলেও আঙুলের ঘষায় খসে পড়ছে রং-পলেস্তারা। এমন চিত্র শরীয়তপুরে মুজিববর্ষ উপলক্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেওয়া ঘরগুলোর।  কাজে অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। 

শরীয়তপুরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের পাকা বসত ঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বীর নিবাস নামের ওই ঘর নির্মাণের ব্যয় নির্ধারন করা হয় ১৪ লাখ ১০ হাজার ৩৮২ টাকা। প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে শরীয়তপুরের ৬ টি উপজেলায় ৬৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ওই বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এরপর একই প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে নতুন করে আরো ২২১টি বীর নিবাস বরাদ্ধ করা হয়। নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় ২০২২ সালের মে-জুনে মাসে। ভবনগুলো ৩ মাসের মধ্যে শেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও ৩০টি বীর নিবাসের নির্মাণ কাজ এখনো শেষ করা হয়নি। এছাড়া, কয়েকটি ঘরের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।

নড়িয়া উপজেলার চান্দনি এলাকার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. জলিল ফকির। দ্বিতীয় প্রকল্পে তার জন্য একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঘর নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে ঠিকাদার সিরাজুল ইসলাম চুন্নু। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও আ. জলিল ফকিরের ঘরের স্থানে পৌঁছায়নি একটি ইটও। ভুক্তভোগী এই বীর মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তার কাছে বাড়তি টাকা চেয়ে না পেয়ে এখন পর্যন্ত ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেনি। 

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. জলিল ফকির অভিযোগ করে বলেন, কন্ট্রাক্টর আমার কাছে ৮০ হাজার টাকা চেয়েছে। এটা নাকি ইটের দাম বেড়ে যাওয়ার ভর্তুকি। আমি টাকা দেইনি বলে আমার ঘরের কাজ এখনো শুরু হয়নি। আমার এক কথা, এই ঘরের জন্য কাউকে কোনো টাকা দেব না। এতে ঘর হলে হোক, না হলে নাই।

অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদার সিরাজুল ইসলাম চুন্নু বলেন, আমি পাঁচটি বীর নিবাস তৈরির দায়িত্ব পেয়ে তিনটির কাজ শেষ করেছি। বাকি দুইটি ঘর আমি করতে চাইনি। প্রশাসন থেকে অনুরোধে করায় নিয়েছি। আমি কারো কাছে টাকা চাইনি। লোকসান হলেও ঈদের পর ঘর নির্মাণ করে দেব।

একই প্রকল্পের আওতায় ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছত্রমুরিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ সরদারের জন্য একটি বীর নিবাসের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঘরটির ছাদ ও দেয়াল নির্মাণ করার পর কাজ ফেলে রেখেছেন বোরহান উদ্দিন নামের এক ঠিকাদার। ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় পুরনো একটি ভাঙা টিনের ঘরে বসবাস করেছেন ওই মুক্তিযোদ্ধা। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ সরদার বলেন, ঠিকাদাররা পুরতন উঁই পোকায় খাওয়া চৌকাঠ নিয়ে এসেছেন ঘরে লাগানোর জন্য। আমি লাগাতে নিষেধ করার পর থেকে তারা কাজ বন্ধ রেখে চলে যায়। ছয় মাস ধরে তারা কাজেও আসেনি বা কোনো যোগাযোগ করেনি। আমি অসুস্থ মানুষ যে কোন সময় মারা যেতে পারি। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ঠিকাদার বোরহান উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এদিকে কয়েক মাস আগে প্রস্তুত করা হয়েছে নড়িয়া উপজেলার নর-কলিকাতা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মোল্লার বীর নিবাস। ঘরটিতে বসবাস করছেন সুলতান মোল্লা ও তার পরিবার। তবে ঘরটিতে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সদ্য তৈরি হওয়া ঘরের ভেতরের রং উঠে যাচ্ছে। এছাড়া হাতের ঘষায় পলেস্তারাও খসে পড়ছে। 

ঘরের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মোল্লা বলেন, আমারা মুক্তিযোদ্ধা, এই দেশকে স্বাধীন করেছি। আর আমাদের এটা কি ঘর দিয়েছে? প্লাস্টার পড়ে যায়, থাই খুলে যায়। বাথরুমে স্লাব নেই। এটা আমাদের সঙ্গে তামাশা করার মতো। নয়তো এমন ঘর হবে কেন?

সদর উপজেলার দাসার্তা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন মুন্সির ঘর নির্মাণ করছেন ঠিকাদার জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ উজ্জামান। মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন মুন্সি বলেন, আমার নতুন ঘরের সামনের অংশে ঠিকমতো পুডিং লাগানো হয়নি, টিন দিয়ে পানি পড়ে। ঠিকাদারের লোকজন ছয়শো ফুট টিউবওয়েল গেড়ে চলে যাচ্ছিল। এই টিউবওয়েলের পানি কি খাওয়া যাবে? পরে ছয় হাজার টাকা ঠিকাদারকে বেশি দিয়ে আরো একশো ফুট গাড়িয়েছি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদ উজ্জামান বলেন, আমাদের ঘর এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। হস্থান্তরের আগে কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা হবে। টিউবওয়েল এই ঘরের স্টিমেটে ছিলো না। এটা বাইরের কাজ। ওটা এক সাব কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে করানো হয়েছে। 

এদিকে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ। তিনি বলেন, ভূমি জটিলতার কারণে কিছু কিছু ঘর নির্মাণ কাজ এখনো শুরু করতে পারিনি। সমস্যা সমাধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করা হবে। 

তিনি আরও বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে আমরা সব সময় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। ঘরের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ হাতে পাইনি। কেউ যদি লিখিত অভিযোগ করেন, সংস্কার কাজে ত্রুটি থাকলে তা সমাধান করা হবে। পাশাপাশি যারা এই নির্মাণ কাজে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। 

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়