ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

২০ টাকা সালামি

তাসফিয়া ইসলাম লাবণ্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ৮ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১৮:২৫, ৮ এপ্রিল ২০২৪
২০ টাকা সালামি

উৎসব মানেই উল্লাস, আবেগ ও স্মৃতিকথার এক সুনিপুণ সমন্বয়। যেখানে এতোগুলো অনুভূতির মহাসম্মেলন, সেখানে আরেকটুখানি রঙ চড়াতে আমাদের বাংলা ভাষার মহাগুরু স্বয়ং বাংলা একাডেমির ভূমিকা তো অনবদ্য হবেই। হাতেখড়ির বয়স থেকে ঈদ শব্দটির সাথে পরিচয় ঈ বর্ণটি দিয়ে। খুব সম্ভবত ২০১৭ সাল থেকে রীতিমতো আইন জারি করে খোলনলচে পাল্টে দিয়ে শব্দটিকে উৎসবের নতুন পোশাক পরিয়ে দেওয়া হলো- ' ইদ '।

শৈশবের ঈদ বেশ দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটিতে ভরপুর ছিল। চাঁদরাতে হাতভর্তি মেহেদি না দিলে যেন ঈদই মনে হতো না। আমাদের বাসার নন্দিত মেহেদি আর্টিস্ট ছিল আমার ছুটকি, বর্ণিল। ওর কারুশৈলীতে গাল ফোলাবে, এমন দুঃসাহস কেউ কোনোদিনও দেখায়নি। এতোটাই শিল্পীসত্তা ছিল ওর ভেতর। একবার হলো কি, ওর আত্মবিশ্বাস আর ইতিবাচকতার ছোঁয়ায় অন্তর্মুখী আমিও উদ্যোগী হয়ে মেহেদি লাগালাম নিজে নিজে।

আমার বড়দি, মানে মিষ্টি আপুর সেকি মুখ ঝামটা! –‘কি মেহেদি লাগাও, এতো নিখুঁতভাবে লাগানো সবাইকে দিয়ে হয় না...।’

আমার আবার রূপচর্চায় খুব একটা আগ্রহ ছিল না কোনোকালেই। তাই চুপ থেকে ‘ঝালে ঝালে কাটাকাটি’ করে মেহেদি রাঙা হাতে স্কুলে গিয়ে নিন্দুক মহলের ভূয়সী প্রশংসার জোয়ারে অল্পের জন্য ভেসে যেতে গিয়েও আর গেলাম না। তাদের প্রশস্তিগীতে পারলে ভুট্টার খই-ই ফুটে যেত!

রাতে মেহেদি দিয়ে একটা নাগাদ বিটিভিতে হারানো দিনের গান উপভোগ, আর তারপর সারা বাড়ি মাথায় তোলা আম্মুর বকুনি, তবেই ঘুমের সাথে মিতালি। সকাল সাড়ে ৭টায় উঠে আব্বুর পা ছুঁয়ে সালাম করে সালামি নেবার উপায় নেই, ততক্ষণে উনি ঈদের জামাতে শামিল হতে রওনা দিয়েছেন। অদূরে মাইকে গমগম করছে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর- ঈদ মুবারক, ঈদ মুবারক, ঈদ মুবারক!

আমি যে অকম্মার ঢেঁকি, সে-ও আম্মুর হাতের কাঠবাদাম-পেস্তাবাদাম-কিসমিসে সেজেগুজে থাকা পায়েসটুকু মুখে দিয়েই কাজে নেমে পড়ি। ঘর ঝাঁট দিয়ে খাটে নতুন চাদর বিছানো, সোফার কুশন কভার বদলে দেওয়া, ব্যস! আমার দৌড় অতদূরই।

রান্নাবান্নায় আপ্পি একাই হাজারী, বর্ণিলও মোটামুটি হাত লাগায়। এক কুরবানির ঈদের কথা মনে পড়লে এখনও চোখ ভিজে আসে। ছাগল কুরবানির সেবারই প্রথম, সেবারই শেষ। সকালে ছাগলটাকে একটু পরপর কাঁঠাল পাতা খাইয়ে আসি, শেষবার যখন গেলাম, সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। দেখলাম, ছাগলটার চোখের কোণায়ও জল, আরও একটা দিন বেঁচে থাকার কি তীব্র আকাঙ্ক্ষা ওর শরীরী ভাষায়! জবাই করে ফেলার পর সেই আমিই আবার খুব আনন্দ নিয়ে মাংস দিয়ে মেখে পোলাও খেলাম। এই না হলে ছোটবেলার ঈদ! কবিগুরুর ভাষায়- ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোটছোট দুঃখকথা, নিতান্তই সহজ সরল!’

সালামি দিতে পাশের বাসার আন্টির কপাল কুঁচকানোর কথা না বলে পারছি না। আন্টির দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেগুলো আবার আব্বুর ছাত্র। তো যথারীতি আমরা গেলাম, সালামও করলাম আঙ্কেল আন্টিকে। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে সালামি নিতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি। আঙ্কেলকে চিমটি কেটে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে আন্টি কানেকানে যা বললেন, তার মানসিক দক্ষতামূলক সারমর্ম করে আমি আর বর্ণিল বুঝে নিলাম, আঙ্কেল সম্ভবত ৫০-১০০ টাকা দিতে চেয়েছিলেন দুজনকে। কিন্তু আন্টির ‘সুপরামর্শে’ ২০ টাকার বেশি এক পয়সাও দিলেন না। যা হোক, সেই ২০ টাকার পরবর্তী ইতিহাস না হয় অজানাই থাকুক!

আম্মুর রান্নার হাত মাশাআল্লাহ বরাবরই চমৎকার, তার প্রমাণ ছিল আগ্রাবাদ মসজিদ কলোনির ছেলেমেয়েদের দল। প্রতি ঈদে আমাদের বাসায় পেটুকপনা দেখাতে তারা হাজিরা দেবেই। আমাদের সোফায় আমরা যে একটু টিভি দেখতে দেখতে শান্তি মতো খাবো, সেটার জো-ও রাখতো না ওরা। অতঃপর আমরা নিজের ঘরে নিজেই অতিথি! 

এখন ঈদের আনন্দ ফিকে হয়ে গেছে। আপুও সংসার পেতেছে, দুদিন বাদে আমারও বিয়ে-থা হবে। একসাথে তিনবোন বসে মুভি দেখার, আম্মুর সাথে বিকেলে দাবা খেলার ঈদগুলো ছুটি নিয়েছে। এখন আবার ঈদের পরই সেমিস্টার ফাইনাল। তাই কবিতার কথায় বলি-

‘আছে কিছু বেদনাবিধুর,
স্মৃতিগুলো পিছু ডেকে যায়,
আমরা চলি যে যার মতো,
শুধু সময়ই হাতটা বাড়ায়!’

-শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন-

জলরঙের ঢেউ

আব্বুকে হারানো ঈদ

ভাইবোনের কাণ্ড

পুরোনো সেই ঈদের স্মৃতি

মধ্যবিত্ত হাসি

দীর্ঘ অপেক্ষার ঈদ

আনন্দ-বিষাদের ঈদ

শৈশবের ঈদ

ঈদের সেরা মুহূর্তনামা

/মেহেদী/এসবি/লিপি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়