ঢাকা     বুধবার   ০১ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

বীকন পয়েন্ট: মাদকের বিরুদ্ধে ‘নীরব যুদ্ধ’

মাকসুদুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪০, ১৪ মার্চ ২০২২   আপডেট: ২১:৩৫, ১৪ মার্চ ২০২২
বীকন পয়েন্ট: মাদকের বিরুদ্ধে ‘নীরব যুদ্ধ’

মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ‘বীকন পয়েন্ট’।

মো. রিজয়ানুল হাসান (ছদ্মনাম)। এক যুগের বেশি সময় নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। মাদকের ঘোরে জীবন প্রায় বিপন্ন ছিল ত্রিশোর্ধ্ব এই যুবকের। কিন্তু এখন জীবন স্বাভাবিক। তার এ বদলে যাওয়ার নেপথ্যে কাজ করেছে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ‘বীকন পয়েন্ট’। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি মাদকের বিরুদ্ধে ‘নীরব যুদ্ধ’ করে যাচ্ছে। 

নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রিজয়ানুল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বন্ধুদের প্ররোচনায় ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ি। দীর্ঘদিন মাদক নেওয়ায় ভাল-মন্দ বুঝতে পারতাম না। থাকতে হতো ঘোরে। একদিন বাসায় এসে অসুস্থও হয়ে পড়ি। বাবা-মা আঁচ করতে পেরে নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করেন। প্রথমে ভয় লাগলেও বীকনের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের আন্তরিকতায় অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে জীবন কাকে বলে বুঝতে শুরু করি। সেখানে দু’মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর মনে হলো সারা শরীর থেকে মাদকের গ্রাস চলে গেছে।’

অন্যদের মাদক থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়ে এই যুবক বলেন, ‘মাদক সেবনে ভাল-মন্দ, জীবনের গুরুত্ব- কোনো কিছুই বোঝা যায় না। এ কারণে মাদক থেকে দূরে থাকার কোনো বিকল্প নেই। আর যারা সর্বনাশা এ নেশায় জড়িয়ে পড়েছেন, নিজেকে বাঁচাতে দ্রুত চিকিৎসা নিন।’

শুধু এই শিক্ষার্থী নয়, প্রতিষ্ঠানটি শুরুর পর থেকেই চিকিৎসা, কাউন্সিলিং; সর্বোপরি মনোরম পরিবেশে প্রায় ২ হাজার তরুণ-তরুণী’কে মাদকাসক্ত থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এসেছে। মাদকের বিরুদ্ধে তাদের ‘নীরব যুদ্ধ’ সমাজ বা রাষ্ট্র  উপকৃত হচ্ছে বলে অভিজ্ঞজনেরা মনে করছেন।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর মাদকাসক্তদের নিয়ে বাস্তবভিত্তিক কাজ করায় ‘বীকন পয়েন্ট’ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে। পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করে চলেছে। দক্ষ কাউন্সিলিং, নিবিড় তত্ত্বাবধায়ন, অত্যাধুনিক চিকিৎসা, শারীরিক অনুশীলন, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা, নিয়মতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা ও মমতার পরম ছোঁয়ায় মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগীকে সুস্থ জীবন উপহার দিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর গুলশান-১ এ মনোরম পরিবেশ ও প্রকৃতি ঘেরা এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫০ জন রোগীকে রেখে সার্বক্ষণিক নিরাময় করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে ভর্তি হওয়া রোগীকে প্রথমে তার মাদক সেবনের ধরন নির্ণয় করা হয়। মূলত প্রস্রাবের মাধ্যমে আসক্ত মানুষটি কোন ড্রাগ সেবন করে এবং তা বন্ধ করা হলে তার কী কী সমস্যা হতে পারে; সেভাবে চিকিৎসা শুরু হয়। তবে মনে রাখতে হবে মাদক সেবনের অপর নাম ‘মস্তিষ্ক’ রোগ। যা তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে পরিলক্ষিত হয়। অন্য সব মানুষের মতো স্বাভাবিক আচরণ করে না। এ কারণে কোনো পরিবারের সন্তান সর্বনাশা মাদকে যদি আসক্ত হয় তাহলে নির্ভয়ে এখানে চিকিৎসা নিতে পারেন।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। কিডনির সমস্যা, লিভারের সমস্যা, হেপাটাইটিস ও ফুসফুসের নানা রোগ হওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। এছাড়াও যৌন অক্ষমতা দেখা দিতে পারে।

কলসানটেন্ট ও চিকিৎসক কামাল খান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এখানে প্রতিদিন গ্রুপ বা এককভাবেও রোগীকে কাউন্সিলিং করা হয়। তার সঙ্গে কথা বলা, কথা শোনা, মাদক ছাড়ার পর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না, তার সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনের মতো সম্পর্ক করা; আস্থা তৈরি করা ইত্যাদি সবই করা হয়। যা অন্য সব রিহ্যাব সেন্টার থেকে ব্যতিক্রমও। রোগী ভেদে বিভিন্ন মেয়াদে কাউন্সিল দেওয়া হয়। 

‘তবে এখানেই ঢেকুর গেলার সুযোগ নেই। কেননা কোনো মাদকাসক্ত স্বাভাবিক হওয়ার পরও আবার আসক্ত হতে পারে। এজন্য অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি, প্রয়োজনের অধিক অর্থের যোগান না দেয়া; পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক, আধুনিকতার নামে অশ্লীলতা থেকে কীভাবে বিরত রাখা যায়, তার চেষ্টা করতে হবে।’

সরেজমিনে জানা গেছে, এখানে মূলত ৩ ধরণের রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে গাঁজা, ইয়াবা, অ্যালকোহল সেবনকারী-ই বেশি। তবে ভর্তির পর রোগীর মস্তিষ্ক সচল রাখতে নিয়ন্ত্রিত জীবনব্যবস্থা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত জিম ও ইয়োগার মাধ্যমে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ করা হয়। জীবনব্যবস্থার মাধ্যমে মাদকাসক্ত রোগী নিশ্চিতভাবে ভালো হয়। একজন মাদকাসক্তের পূর্ণাঙ্গ আরোগ্যের জন্য একটি ভালো মানের রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি আবশ্যক। কারণ মানসম্পন্ন রিহ্যাবে ব্যক্তিকে এমন কিছু কৌশল শেখানো- যাতে তিনি এ ধরনের সমস্যা আর পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করে একটি নতুন জীবনশৈলীর সূচনা করতে পারেন। ধর্মীয় আলোচনা কার্যক্রম, আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রোগীদের সুস্থ ও সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটি খুবই মূল্যবান ও ফলপ্রসূ একটি প্রয়াস। এছাড়া গান, নৃত্য, র‌্যাফেল ড্র, বালিশ খেলা, কবিতা আবৃত্তিসহ নানা আয়োজনে মুখরিত থাকে এ রিহ্যাব সেন্টারটি।

প্রাণশক্তি ফিরিয়ে দিতে বীকন পয়েন্ট ভাল করছে উল্লেখ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মুহিত কামাল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মাদক ধ্বংস করে দিচ্ছে দেশ ও জাতির সুপ্ত প্রতিভা এবং বিকাশকে। বাবা-মাকেই তাদের কাজ-ব্যস্ততা সামলে আলাদা করে সন্তানের খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মন-মেজাজের হঠাৎ পরিবর্তন, ঘুম থেকে উঠে মেজাজ খারাপ করা এবং সারাদিন অকারণে সবার সাথে চিৎকার করা- এমন দেখলে বিশেষ সতর্ক হবেন।’

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব. মেন্টাল হেলথের সাবেক পরিচালক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আসলে এখানে চিকিৎসা নিলে মাদকাসক্তকে যেকোনো ভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায়। কেননা এর আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবি রাখে। শুধু তারা ওষুধে মাদক নিরাময় করে না, কীভাবে মাদকাসক্তকে স্বাভাবিক জীবনে গড়ে তোলা যায় তার সব চেষ্টা করা হয়।’

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়