ঢাকা     রোববার   ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২৩ ১৪৩১

কাযা রোজা আদায় করার নিয়ম

প্রকাশিত: ১৩:২২, ১৭ মে ২০২১   আপডেট: ১৩:৩০, ১৭ মে ২০২১
কাযা রোজা আদায় করার নিয়ম

আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের উপর রোজা ফরজ করেছেন। রমজানে যারা বিভিন্ন সমস্যায় রোজা রাখতে পারেননি, তাদের রোজা পূরণ করার ক্ষেত্রে বিধি-বিধানও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। সেই ক্ষেত্রে একাধারে রমজানের রোজা রাখতে কোনো সমস্যা হলে, কী ধরনের সমস্যা হতে পারে সেটাও বলে দিয়েছেন। কুরআনের ভাষায় ‘অন্য সময়ে এসে রোজা পূরণ করে নেবে’ এ কথা থেকে স্পষ্টভাবে রোজা কাযা আদায় করার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা পবিত্র কুরআন কারীমে বলেছেন, ‘... গণনার কয়েকদিনের জন্য, অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে, অথবা সফরে থাকবে, সে অন্য সময়ে এসে রোজা পূরণ করে নেবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৪)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আর যে ব্যক্তি অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনের গণনা পূরণ করবে, আল্লাহ তোমাদের জন্যে সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না, যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার মহত্ব বর্ণনা করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

কোন ক্ষেত্রে রোজা কাযা করার অনুমোদন রয়েছে

কোনো রোজাদার সফর করা অবস্থায় থাকলে, রোগাক্রান্ত হলে, গর্ভকাল অতিক্রান্ত করলে, সন্তানকে দুগ্ধ দান করা অবস্থায় থাকলে, বার্ধক্যের কারণে, যে কোনো রকমের প্রাণ নাশের আশঙ্কা থাকলে, কেউ কাউকে জোর-জবরদস্তি করে রোজা ভঙ্গ করতে বাধ্য করলে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পাগল হয়ে গেলে, মহিলাদের পিরিয়ড শুরু হলে, মহিলাদের প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব দেখা দিলে, সাপে দংশন করলে, কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শরীয়ত স্বীকৃত জিহাদের সময়ে রোজা ভঙ্গ করলে, পরে রোজা পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ ইসলামী শরীয়ত এই ক্ষেত্রগুলোতে রোজা ছেড়ে দিয়ে পরে রোজা কাযা আদায় করে নেয়ার অনুমোদন দিয়েছে।

রোজা কাযা আদায় করার নিয়ম

সাধারণভাবে একজন মুসলিম যেভাবে রমজানের রোজা রাখে, অর্থাৎ সেহরী গ্রহণ করে, এরপর সময় মতো ইফতার করে, মাঝখানে অন্যান্য পাপ পঙ্কিলতা থেকে দূরে থাকে, কাযা রোজাও ঠিক একইভাবে আদায় করতে হয়। একাধিক রোজা কাযা হয়ে থাকলে, সেগুলো ধারাবাহিকভাবে আদায় করার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ধারাবাহিকভাবে কাযা আদায় করা উত্তম।

কাযা রোজা কখন আদায় করতে হয়

যত দ্রুত সম্ভব কাযা রোজা আদায় করে নেয়া কর্তব্য। তবে এই রমজানের কাযা রোজাগুলো আগামী রমজানের আগে আদায় করে নেয়া অতি উত্তম। কোনো কারণ না থাকলে কাযা রোজা আদায় করতে বিলম্ব করা মাকরুহ। বছরের যে কোনো দিন কাযা রোজা আদায় করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ দিনগুলো বাদ দিতে হবে। অর্থাৎ যেসব দিনে রোজা রাখা ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ সেসব দিন বাদ দিতে হবে। যেমন ঈদ উল ফিতরের দিন, ঈদ উল আযহার তিন দিন ইত্যাদি। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি যদি এমন একটি দিন বা একাধিক দিনে রোজা রাখবে বলে মানত করে, অর্থাৎ মানত করা রোজা রাখার দিনটি নির্দিষ্ট করে ফেলে, তাহলে সেই দিনও কাযা রোজা আদায় করা যাবে না যেদিন কাযা রোজা আদায় করা নিষিদ্ধ। কারণ তার ক্ষেত্রে ওই দিনটি মানতের রোজার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।

খুব সহজ একটি কথা হচ্ছে রমজানের কাযা রোজা রমজানে রাখা যাবে না। কারণ রমজান মাস তার উপর রোজা রাখা ফরজ। এই ফরজ বাদ রেখে কাযা রোজা আদায় করার কোনো সুযোগ তার জন্য নেই। রমজানের কাযা রোজা আদায় করার পূর্বে নফল রোজা রাখা উচিত নয়। যদি কেউ রমজানের কাযা রোজা তার জিম্মায় থাকা সত্ত্বেও আশুরার রোজা রাখা অথবা শাওয়ালের ছয় রোজা রাখা ইত্যাদি এমন কিছু করা উচিত নয়। তবে রমজানের কাযা রোজার আগে নফল রোজা রাখলে, তার নফল রোজা আদায় হয়ে যাবে, সে ক্ষেত্রে তার জিম্মায় থাকা ফরজের কাযা করার দায়িত্বটি যেমন ছিল তেমনই থাকবে।

অনেকে রমজানের কাযা রোজা মাথায় থাকা সত্ত্বেও শাওয়ালের ছয় রোজা রাখে। বিষয়টি একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস অনুযায়ী, রমজানের রোজার পর শাওয়ালের যে ছয়টি রোজা পূরণ করার নির্দেশ এসেছে সেটি একটি ধারাবাহিক বিষয়। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা আদায় করলো এবং (এর ধারাবাহিকতায়) শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা অনুসরণ করলো তাহলে সে যেন সারা বছর রোজা রাখল।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬৪)

এই অবস্থায় কেউ যদি রমজানের রোজা পূরণ না করে, তাহলে সে শাওয়ালের ছয় রোজা অনুসরণ করবে কি? হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী সে তো প্রথম শর্তই পূরণ করেনি। সেক্ষেত্রে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে, অথবা যে সমস্যার কারণে রোজা কাযা করা হয়েছিল, তা তার উপর থেকে সরে গেলে, প্রথমে তাকে রমজানের কাযা রোজা আদায় করতে হবে, এরপর সময় থাকলে শাওয়ালের ছয় রোজা অথবা অন্যান্য নফল রোজা আদায় করা যাবে। কারণ রমজানের রোজা ফরয, শাওয়ালের রোজা ফরজ নয়। তবে কেউ যদি এক রমজানের কাযা রোজা আরেক রমজানের আগে আদায় করতে সক্ষম না হয়, তাহলে সে পরবর্তীতে যে কোনো সময়ে রোজা আদায় করতে পারবে। যখনই সে তার রোজা আদায় করবে তখনই তার মাথার উপর থেকে ওই দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝাটি সরে যাবে।

এই তো গেল ফরয রোজা কাযা আদায় করার কিছু নিয়ম। তবে শরীয়ত অনুমোদিত বিষয়ের বাইরে কেউ রোজা ভঙ্গ করলে তাকে কাযা-কাফফারা দু’টোই আদায় করতে হবে। কাফফারা খুব কঠিন বিষয়। শরীয়ত অনুমোদিত রোজা কাযা করার বিষয়গুলোর বাইরে কেউ যদি রোজা ভেঙে ফেলে, অথবা রোজা ছেড়ে দেয়, তাহলে তাকে কাফফারা আদায় করতে হয়। কারো একটি রোজা নষ্ট হলে বা ছুটে গেলে তার ওপর প্রথমত কাযা আদায় করার দায়িত্ব বর্তাবে। দ্বিতীয়ত কাফফারা আদায় করতে হবে। 

কাফফারার ধারাবাহিক কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। কাফফারা হিসেবে একটি রোজার জন্য একটি দাস বা দাসী মুক্ত করতে হবে। বর্তমান যুগে দাস-দাসীর বিষয়টি খুবই কঠিন এবং না পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তাই এর পরবর্তী যে সুযোগ সেটি হচ্ছে ৬০ দিন একাধারে রোজা রাখা। কাফফারার রোজা ৬০ দিন রাখতে গিয়ে কারো যদি ঈদের দিন চলে আসে, বা নিষিদ্ধ কোনোদিন চলে আসে, তাহলে তাকে আবার ৬০ দিনের রোজা ধারাবাহিকভাবে রাখতে হবে। তাই কেউ যদি কাফফারার রোজা আদায় করতে চায়, তাহলে তাকে এমনিভাবে হিসাব করতে হবে যে, তার মধ্যে কোনো ধরনের নিষিদ্ধ দিন না পড়ে। সে যেন কোনো বাধা ছাড়াই ৬০ দিন একাধারে রোজা আদায় করতে পারে। আর খুবই গুরুত্বের সঙ্গে তাকে এই রোজা রাখার কাজটি করতে হবে, যাতে ৬০ দিনের মধ্যে কোনো রোজা নষ্ট হয়ে না যায়।

উল্লেখ্য যে কোনো একটি রোজা ভেঙে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে, তারপর দিন থেকে আবার ৬০টি রোজা পূরণ করতে হবে; এটি তার দ্বিতীয় পর্যায়। যদি কারো পক্ষে দাসমুক্ত করা সম্ভব না হয়, অথবা নিয়মানুযায়ী রোজা রাখাও সম্ভব না হয়, তাহলে তার কাফফারা আদায়ের আরেকটি সুযোগ রয়েছে। দু‘টি পর্যায়ে অপারগতার পর ৬০ জন মিসকীনকে খাবার দান করবে। ৬০ দিন ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়ানো যায়, আবার একজন মিসকীনকে ৬০ দিনের খাবার দিয়ে দেয়া যায়। অথবা একদিন ৬০ জনকে ভালোভাবে খাবার খাইয়ে দেয়া যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, শরীয়ত অনুমোদিত বিষয়ের বাইরে কেউ যেন রোজা না ভঙ্গ করে। সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা সেই জন্যই কাফফারার বিষয়টিকে এতটা শক্ত করেছেন। কাফফারা হয় এমন রোজা যেমন, রোজা অবস্থায় ইচ্ছে করে স্ত্রী সম্ভোগ করলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় তাকে কাযা ও কাফফারা আদায় করতে হবে।

ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী আরেকটি সুযোগ রয়েছে। যদি কেউ কাযা আদায় করতে সামর্থবান না হয়, তাহলে তাকে ফিদইয়া দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সাথে সৎকর্ম করে তাদের জন্যে কল্যাণকর হয়, আর যদি রোজা রাখো তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পারো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৪)

ফিদইয়া অর্থ ক্ষতিপূরণ বা বিনিময় প্রদান। কেউ সামর্থবান না হলে, রোজা না রাখতে পারলে, কাযা আদায় করারও কোনো সুযোগ নেই মনে করলে, রোজার পরিবর্তে ফিদইয়া আদায় করবে। সেটা হচ্ছে সাদাকাতুল ফিতর এর সমান, একটি রোজার জন্য একজন মিসকীনকে খাদ্য দেয়া। কোনো ব্যক্তি তার জিম্মায় থাকা রোজা কাযা আদায় করার পূর্বেই তার মৃত্যু হলে, তার উত্তরাধিকারী বা তার অভিভাবকদের কেউ অথবা অন্য কেউ, তার অনুমতিতে সাধারণ দিনে রোজা আদায় করে দিবে, অথবা ফিদইয়া আদায় করে দিবে।

তবে এ ক্ষেত্রে একটি কথা স্মরণযোগ্য, আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে, যে কেউ বৃদ্ধ হয়ে গেলে অথবা রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে, তার পরিবর্তে আরেকজনকে রোজা রাখার জন্য নিযুক্ত করে। বিষয়টি খুবই গর্হিত কাজ। কারণ যেই ব্যক্তিকে রোজা রাখার জন্য নিযুক্ত করা হলো, তার ওপরও কিন্তু রোজা ফরজ।  কাজেই সে রমজান মাসে তার নিজের ফরজ কাজ ছেড়ে দিয়ে, আরেকজনের জন্য রোজা রাখতে পারে না। মনে রাখতে হবে ইসলামী শরীয়তে বদলি রোজার নিয়ম নেই। রোজাদার নিজে রোজা আদায় করবে, অথবা সে তার কাযা আদায় করবে, যদি তাতে সামর্থবান না হয়, তাহলে ফিদইয়া দিবে, যা পবিত্র কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। 

কেউ যদি কাযা রোজা আদায় করতে গিয়ে রোজা রাখে, তখন আবার এই রোজাও নষ্ট করে ফেলে, তাহলে তাকে কী করতে হবে? ফরজ রোজার কাযা আদায় করা ফরজ। এমতাবস্থায় সে যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে শরীয়ত অনুমোদিত কোনো কারণে এই রোজাটিও আবার নষ্ট করে ফেলে, অর্থাৎ কাযা রোজা ভেঙে যায় তাহলে পরবর্তীতে শুধু কাযা রোজা আদায় করলেই চলবে। এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা তার দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদেরকে জেনে-বুঝে কাযা রোজা আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমিন!

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও মাসিক পত্রিকা সম্পাদক 
 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়