ঢাকা     রোববার   ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২৩ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশ যেভাবে কাজ করেছে

সাতসতেরো ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১১:৫২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশ যেভাবে কাজ করেছে

অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠিত হয়

ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যে সংগঠনের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেটি হচ্ছে তমদ্দুন মজলিশ।  দেশ বিভাগের পরে ঢাকায় গড়ে উঠে এই সংগঠনটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নামকরণ হয় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ।

তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক আবুল কাশেমের অগ্রণী সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক এ.এস.এম নূরুল হক ভূঁইয়া, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর, বদরুদ্দীন উমর, হাসান ইকবাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র ছাত্র। প্রফেসর আবুল কাশেম ছিলেন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৯ সালে মজলিশের সভাপতি নির্বাচিত হন।

নবগঠিত পাকিস্তানে এ সংগঠন ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, পরবর্তীতে এর সদস্যরা লক্ষ্যনীয়ভাবেই প্রভাবিত হয়েছিলেন বিশ শতকের চল্লিশের দশকের ক্যালকাটা রেনেসাঁ সোসাইটির মতাদর্শে। দেশভাগের আগে বেঙ্গল মুসলিম লীগের বামপন্থী দর্শন বিশেষত আবুল হাশেমের বামপন্থী দর্শনে প্রভাবিত হন তারা। তাদের মধ্যে ইসলামী বিপ্লব বা ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এবং আরও কয়েকটি ব্যাপারে তাদের প্রত্যয় ও অবস্থান ছিল গণমুখী।

আরো পড়ুন:

এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর এর প্রথম পর্বে ব্যাপক তৎপরতা দেখায়। মজলিশের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় সারা বছর আলোচনা সভা, সেমিনার, বিতর্ক, নাট্যাভিনয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। এর নিয়মিত কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল বিভিন্ন বিষয়ে পুস্তক-পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ। তমদ্দুন মজলিশের বাংলা মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর (২৮ কার্তিক ১৩৫৫)। শুরুতে সৈনিক পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ছিলেন শাহেদ আলী এবং পরে সভাপতি হন আবদুল গফুর। ঢাকার আজিমপুর রোডের ১৯ নং বাড়ি থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি চালু ছিল।

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তমদ্দুন মজলিশ সমগ্র পূর্ব বাংলায় এর কর্মপরিধি বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়। জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে এবং কোথাও কোথাও থানা পর্যায়ে সংগঠনের শাখা স্থাপিত হয়। প্রথমদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ক্যাম্পাসের নিকটস্থ রশিদ বিল্ডিং -এ তমদ্দুন মজলিশের কেন্দ্রীয় দফতর স্থাপিত ছিল।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে তমদ্দুন মজলিশের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বস্ত্তত তমদ্দুন মজলিশই প্রথম প্রতিবাদ উত্থাপন করে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসহ ভাষা আন্দোলনের সূচনায় পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। 

তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে অধ্যাপক আবুল কাশেম সম্পাদিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এ ঐতিহাসিক পুস্তিকায় সন্নিবেশিত নিবন্ধগুলোতে কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলাকে পূর্ব বাংলায় শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম, অফিস ও আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও তুলে ধরেন। 

এই মূল পুস্তিকার মুখবন্ধে, পুস্তিকার সম্পাদক আবুল কাশেম কর্তৃক প্রণীত একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনাও ছিল বাংলা ভাষার অনুকূলে। বাংলাকে স্বীকৃতি দানের দাবির এই ঐতিহাসিক প্রস্তাবনার সারসংক্ষেপ ছিল নিম্নরূপঃ

১. বাংলা ভাষাই হবে (ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন (খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা এবং (গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসের ভাষা; ২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হবে দুটি- বাংলা ও উর্দু; ৩. (ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশ’  জনই এ ভাষা শিক্ষা করবেন। (খ) পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকরি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হবেন শুধু তারাই এ ভাষা শিক্ষা করবেন। এই ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ হতে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে। মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর শ্রেণিতে এই ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেয়া হবে। (গ) ইংরেজি হবে পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসেবে যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাকরি করবেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষায় নিয়োজিত হবেন তারাই শুধু ইংরেজি শিক্ষা করবেন। তাদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানে হাজার, করা একজনের চেয়ে কখনও বেশি হবে না। ঠিক এই নীতি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে (স্থানীয় ভাষার দাবি না উঠলে) উর্দু প্রথম ভাষা, বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজি তৃতীয় ভাষার স্থান অধিকার করবে। ৪. শাসন কাজ ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাতত কয়েক বছরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসন কাজ চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনানুযায়ী বাংলা ভাষায় সংস্কার করতে হবে।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাভাষা বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হন মজলিশ নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএসএম নূরুল হক ভূইয়া এবং কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন তমদ্দুন মজলিশের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাশেম। 

ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে আবুল কাশেম ছিলেন আন্দোলনের মধ্যমনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সপক্ষে যুবসমাজ এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রদের সমর্থন লাভে তার সাফল্য ছিল অভাবনীয়। এভাবেই প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে রূপলাভ করে একটি সাংগঠনিক কাঠামো, আর এরই মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকের মাসগুলোতে সংগঠিত হয় ভাষা আন্দোলন। 

করাচিতে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল এডুকেশন কনফারেন্সে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে প্রথম প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তমদ্দুন মজলিশ কর্মী এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের যৌথসভায় মজলিশ কর্মী শামসুল আলমকে আহবায়ক করে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’ নামে একটি নতুন কমিটি গঠিত হয়।

বাংলা ভাষার আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশের অবস্থান ছিল পূর্ববাংলায় জনসাধারণের আকাঙ্খারই প্রতিফলন। তমদ্দুন মজলিশের সাফল্য যে, এই সংগঠন অত্যন্ত সফলভাবে দীর্ঘ পাঁচ বছর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং সামাজিক প্রত্যয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে এর সাথে সম্পৃক্ত করে ভাষা আন্দোলনকে একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করেছে।

ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই তমদ্দুন মজলিশের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতা কর্মীরা সরকারের চরম নিগ্রহের শিকার হন। তাদের গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। পুলিশ হামলা চালিয়ে মজলিশের কেন্দ্রীয় দফতর এবং সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার অফিস তছনছ করে। সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক কাজী গোলাম মাহবুব গ্রেফতার হন। মজলিশের প্রথম কাতারের নেতা দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, প্রফেসর আবুল কাশেম, আবদুল গফুর প্রমুখ নিরাপত্তার জন্য মফঃস্বল এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন।

তমদ্দুন মজলিশ এখনো ঢাকায় এর সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে। 

তথ্যসূত্র: মুয়ায্যম হুসায়ন খান, বাংলাপিডিয়া
 

/লিপি

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়