ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

সজ্জিত অক্ষর শিল্প ক্যালিগ্রাফি

আদিবা রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ২১:১৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সজ্জিত অক্ষর শিল্প ক্যালিগ্রাফি

শিল্পকলার অতি প্রাচীন একটি শাখা হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। ক্যালিগ্রাফি শব্দটা গ্রিক শব্দ ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে এসেছে। গ্রিক শব্দ ক্যালোস অর্থ সুন্দর, আর গ্রাফেইন অর্থ লেখা। সুতরাং ক্যালিগ্রাফির পরিচয় এভাবে দেওয়া যেতে পারে, সাধারণ অক্ষর ব্যবহার করে অসাধারণভাবে লেখন শিল্পকে ফুটিয়ে তোলার নাম ক্যালিগ্রাফি।

ক্যালিগ্রাফির দু’টো রূপ প্রচলিত। একটা হলো ট্রেডিশনাল বা ঐতিহ্যবাহী ধারা এবং অপরটি পেইন্টিং বা চিত্রকলা। ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে সাধারণত হরফকে দৃষ্টিনন্দন করে লেখার বিষয়টি মূখ্য। এটা দু’ধরনের হতে পারে। স্ক্রীপ্ট ক্যালিগ্রাফি এবং ভিজ্যুয়াল ইমেজ বা দৃশ্যমান ছবির মত ক্যালিগ্রাফি।

স্ক্রিপ্ট ক্যালিগ্রাফিতে বই, নথিপত্র, নিমন্ত্রণ পত্র এসব লেখা হয়ে থাকে। ভিজ্যুয়াল বা দৃশ্যমান ক্যালিগ্রাফির ক্ষেত্রে হরফ, বাক্য বা বাণী দিয়ে বিশেষ কম্পোজিশন বা সাজানো অথবা বিন্যাসের মাধ্যমে একটি ছবির মত তৈরি করা হয়। এর জন্য শুধু কালি আর বিশেষ ধরনের বাঁশের কলম ব্যাবহার করা হয়। এই কলম বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। এর কৌণিক দিক কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালিগ্রাফির অক্ষর কোন দিক থেকে শুরু হবে, সেটার উপর নির্ভর করেই কলম বানানো হয়।

পেইন্টিং বা চিত্রকলার ক্ষেত্রে ক্যানভাস কিংবা বিভিন্ন কাগজে রঙ দিয়ে অক্ষরকে সাজিয়ে তোলা হয়। বর্তমানে পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফির জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো।

ক্যালিগ্রাফির শুরুটা একদম সাদামাটা অক্ষর বিন্যাস দিয়ে। এটা আর্ট ফর্ম হিসেবে পরিচিত হওয়ার আগে সাধারণ লেখার ধরণ ছিল। ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে হাতে লিখে বই, নথিপত্র সব সংরক্ষণ করা হতো। বড় বড় সাহিত্যগুলো এভাবে হাতে লেখাটা বেশ কঠিন কাজ ছিল বলেই একজন করতে পারতো না। একজন ক্যালিগ্রাফারের সহযোগী হিসেবে আরও কয়েকজন নিয়োজিত থাকতো।

সেকালের ক্যালিগ্রাফাররা বর্ণের এমন সজ্জিত করণের প্রতি আগ্রহী ছিল না। এভাবে বর্ণের সৌন্দর্য বৃদ্ধির বিষয়ে বেশ আগ্রহ দেখা দেয় প্রথমে চাইনিজদের মাঝে। তাদের থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে রোম, ইতালিসহ সব জায়গায় বিস্তার লাভ করে। এভাবেই ক্যালিগ্রাফি ছড়িয়ে পড়ে।
লেখন শৈলীকে সব দেশের সংস্কৃতিতে গ্রহণ করলেও এর প্রকৃত মর্যাদা পেয়েছে ইসলামিক শিল্পে। একে আলাদা একটা শিল্প হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় দিতে আরবদের অবদান বেশি। ইসলামিক শিল্পকলায় ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। এই কারণেই ক্যালিগ্রাফি ইসলামিক শিল্পে এক অন্যরকম মর্যাদা পায়। নবম শতাব্দীর প্রথমভাগে ইবনে মুকলাহ ক্যালিগ্রাফি নিয়ে সর্বপ্রথম গবেষণা করে এর সঠিক পরিমাপ করেন।

মধ্যযুগের মুসলমানরা নানা রকম ব্যবহার্য জিনিসপত্রে লিপিকলার নান্দনিক প্রয়োগ ঘটিয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত উসমানীয় আমলের তলোয়ার, পঞ্চদশ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত লোহার শিরস্ত্রাণ, দ্বাদশ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত ব্রোঞ্জের দর্পণ, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিসর অথবা সিরিয়ায় নির্মিত সোনা ও রুপার প্রলেপ দেওয়া পিতলের গামলা, চতুর্দশ শতাব্দীতে স্পেনের গ্রানাডায় তৈরি রেশম কাপড় এবং ষোড়শ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত বিভিন্ন অলংকারের সাক্ষ্য বহন করছে। এ সময়ে ধাতব মুদ্রাতেও ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ইসলামি লিপিকলার সবচেয়ে সুন্দর প্রয়োগ ঘটেছিল মুসলমানদের নির্মিত বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্যে।

উমাইয়া আমলের বিখ্যাত শিল্পীদের জীবনের ব্রত ছিল ক্যালিগ্রাফিকে শিল্প নৈপুণ্যের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া। তারা ব্যবসায়িক লক্ষ্যে কখনও শিল্পকর্ম তৈরি করতেন না। হিজরী তৃতীয় শতকের শেষ দিকে বিপুল সংখ্যায় পবিত্র কুরআনের অনুলিপি হয় এবং সেটাতে বিভিন্ন মাত্রায় শৈল্পিক নিপুণতা প্রয়োগ করা হয়। সেই সুত্র ধরেই লিখিত উপকরণাদির বেচাকেনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় সেই সময় থেকেই।

বাণিজ্যিকভাবে শিল্পকর্মের উপকরণাদি উৎপাদিত হতে থাকে। ক্যালিগ্রাফি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা প্রচলিত হয় এবং এ শিল্পকলাকে সুন্দর প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান বলে গণ্য করা হতে থাকে। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একটি ক্ষেত্র অর্থাৎ শিল্পকর্ম ও শিল্পে ব্যবহার্য উপকরণাদির বিক্রির জন্য বাজারের সৃষ্টি হয়। শিল্পকর্মের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্যালিগ্রাফি তৈরি শুরু হয়। ধীরে ধীরে এটি একটি অনন্য পেশায় পরিণত হয়।

পাশ্চাত্য পেইন্টিংয়ের সাথে সমানতালে ক্যালিগ্রাফি তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এতে শুধু আরবরাই নয় বরং সমগ্র মুসলিম শিল্পীরা অবদান রেখেছেন। বর্তমানে প্রযুক্তির সর্বাধুনিক মাধ্যমকেও ক্যালিগ্রাফিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রাফিক্স আর ডিজিটাল সাপোর্ট সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফিতে এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

ইসলামী ক্যালিগ্রাফিকে একটি শক্তিশালী শিল্প মাধ্যম বা শিল্পের ভাষা হিসেবে আধুনিক শিল্পীরা ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। বাংলাদেশের শতাধিক নবীন প্রবীণ শিল্পী ক্যালিগ্রাফি চর্চায় নিমগ্ন হয়েছেন। এক্ষেত্রে ঢাকা সাহিত্য সাংস্কৃতি কেন্দ্র ও ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশের আয়োজিত প্রদর্শনীসমূহ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। নিয়মিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীসমূহে ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিচ্ছেন।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ক্যালিগ্রাফিতে একটি প্রবল প্রবাহ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ, ক্রাফট ফেয়ার ,সেমিনার, প্রতিযোগিতা প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পীদের ক্যালিগ্রাফি বহির্বিশ্বের সংস্কৃতি প্রেমিদের কাছে বেশ পছন্দনীয়। এই কারণেই এটি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে পাচ্ছে জনপ্রিয়তা।

ইউনেস্কো ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আররি ক্যালিগ্রাফিসহ কয়েকটি শিল্পকে 'মানবতার অধরা বা স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে’র তালিকাভুক্ত করে। আমাদের দেশেও রয়েছে আরবি ক্যালিগ্রাফির চর্চা। কিন্তু এর প্রচার এবং প্রসার কম। প্রচার এবং প্রসার বাড়িয়ে আমরা এই শিল্পের চর্চার মাত্রা বাড়াতে পারি। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

আমাদের বাংলা ভাষার ক্যালিগ্রাফির রয়েছে বিশেষ পরিচিতি। বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে দেয়াল লেখন পর্যন্ত শিল্পীরা ব্যাবহার করছেন ক্যালিগ্রাফি। বিভিন্ন সৌখিন উপহার সামগ্রীর মধ্যে ক্যালিগ্রাফির একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। তাছাড়াও এখন বহির্বিশ্বে অনেক দেশেই বাংলা ভাষাকে অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এসব জায়গায় অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ক্যালিগ্রাফিও শোভা পাচ্ছে। এভাবেই ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে কাজে লাগিয়ে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারি।

আমার কাছে বর্তমানে এটি একটি প্রবল সম্ভাবনাময় শিল্প মনে হয়েছে। এর সৃজনশীলতা আমাকে মুগ্ধ করে। এজন্য আমিও এ শিল্পটাকে বেছে নিয়েছি। এটা নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী। তবে এই আশা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমার মতো সম্ভাবনাময় শিল্পীদের নিয়ে আমি এই শিল্পে এগিয়ে যেতে চাই। যারা আগ্রহ থাকার পরেও সুযোগ পাচ্ছে না তাদের নিয়ে আমার পরিকল্পনা আছে। ইউনিভারসিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে গ্রাজুয়েশন করে চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার চেয়ে আমার কাছে উদ্যোক্তা হওয়াটাই শ্রেয় মনে হয়েছে। সেই থেকেই শিল্পের প্রতি ভালোবাসা আমাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

এই শিল্পের তেমন চর্চা না থাকায় এটাকে পেশা হিসেবে নিতে তরুণরা ভরসা পাচ্ছেন না। তবে বিদেশে এর কদর আর চাহিদা সম্পর্কে যদি সবাইকে জানানো যায় তাহলে ক্যালিগ্রাফি হয়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় এক শিল্প। এর জন্য এই শিল্প নিয়ে কাজ করা প্রতিটা শিল্পিকে এগিয়ে আসতে হবে। জেলায় জেলায় ওয়ার্কশপ করতে হবে। তরুন প্রজন্মের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে।

প্রতিটা কাজ শুরুতে কঠিন। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা এবং নিয়মিত অনুশীলন সব কাজ সহজ করে দেয়। ক্যালিগ্রাফি শিখতে অবশ্যই প্রচুর অনুশীলনের প্রয়োজন আছে। আমি জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এই শিল্প আয়ত্ব করতে পেরেছি। এর থেকে বড় উদাহরণ আর হয় না।

(লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট ওল্টারনেটিভ।)

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়