ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

প্রিয় চট্টলা, গম আছন্নি: পর্ব ২ 

দিলরুবা আহমেদ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৭, ২ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১৫:০৯, ২ এপ্রিল ২০২৪
প্রিয় চট্টলা, গম আছন্নি: পর্ব ২ 

এবার এগুলাম কলেজের দিকে। চট্টগ্রাম কলেজ। আমার শ্বশুরও ছিলেন এই কলেজের ছাত্র। উনি যখন এই কলেজের ছাত্র ছিলেন তখন জানতেন না, পুত্রবধূও হবে একই কলেজের ছাত্রী। তার দুই পুত্রবধূই এই কলেজের ছাত্রী। কত রহস্যময় এই জগৎ। বাবা যে পথে কলেজে হাঁটতেন আমিও হয়তো তার পদচিহ্ন ছুঁয়ে হেঁটেছি বহুবার কিন্তু বুঝিনি কোনো একদিন তার আবাসে আমার বাসা হবে।

শনিবার কলেজ বন্ধ। কিন্তু গেইট খোলা। আমি অবাধ গতিতে হেঁটে ঢুকে গেলাম নীরব ক্যাম্পাসে। এক আউল বাউল পাগল টাইপের লোক আনমনে গেয়ে যাচ্ছে ‘পিরিত মানি ফুডুর ফাডুর’। এই গান জীবনেও আগে কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পরছে না। মনে এলো এ নির্ঘাত ছেকা খেয়েছে, কোনোদিন, এই কলেজের করিডোরে কোনো এক মেয়ের কাছে যাচ্ছেতাই ভাবে। শেফালী ঘোষ এবং শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবকে একসময় শুনেছিলাম আঞ্চলিক গান গাইতে, তাদের বলা হতো চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া গানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞি। তাদের নয় নিশ্চয়ই এই গান! তাদের ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম’, ‘ও রে সাম্পানওয়ালা’ এসব গান শুনতাম সেই কালে। আজও মনে আছে। তবে আমিও আনমনে ‘পিরিত মানি ফুডুর ফাডুর’ গাইতে গাইতে এগুলাম। হঠাৎ দেখলাম, আমার পাশ দিয়ে একটি ছোকরা একই গান গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছে, সাথে সাথে আমি মুখ সেলাই করে নিলাম। আমি অন্য সময়ের মানুষ। ভারিক্কি চালে বিরক্ত চোখে তাকালাম ছেলেটির দিকে, ভাবখানা আর গান পাওনা খুঁজে!

মনে এলো, এই হড়বড়িয়ে চলে যাওয়া ছেলেই হবে হয়তোবা কোনো একটি পরিপূর্ণ উপন্যাসের নায়ক। এখন একটি শুধু পার্শ্ব চরিত্র এই লেখায় কিন্তু তাকে নিয়ে এগুলে আমার এই লেখার গতি অন্যত্র চলে যাবে। জানা হলো না এই ছেলের কাছে কোনো ছেকামাইসিন কাহিনী আছে কিনা! আমাদের কালের অতি পরিচিত ‘ছেকামাইসিন’ শব্দটি মনে এলো, জানি না এই কালে প্রচলিত কিনা শব্দটি। নাকি ‘ছেকামাইসিন এখন ‘টেকামাইসিন’ হয়ে গেছে! যার টাকা আছে সেই প্রেমই কেবল টিকে, বিকে, শক্তিমত্তার সাথে গ্যাট হয়ে বসে আছে, বাদবাকি সব ধুকে ধুকে মরছে।

তবে নিঃসন্দেহে সন্দেশতুল্য এই দিনটা স্মরণীয় আমার কাছে, মনে মনে জপে নিলাম, ১২ই নভেম্বর ২০২২ এ আবার একবার পা রাখলাম কলেজ চত্বরে। যেদিন প্রথম পা রেখেছিলাম তখন ছিলাম ১৬। কি চমৎকার একটা বয়সে এই চত্বরে জীবনে প্রথম এসেছিলাম। ওই বয়সটা এখন আমার মেয়েও পেরিয়ে গেছে। আজ এতো বছর পর আবার আসা। এই কলেজ থেকে পাশ করে চলে যাবার পর আর কখনো আসিনি। কি আশ্চর্য! চট্টগ্রামের বসবাসরত আমার বহু বন্ধুবান্ধবী আছে যারা পাশ দিয়ে চলে যায় প্রতিদিনই কিন্তু ক্যাম্পাসে ঢোকা হয় না। ভাবে যাবো একদিন, সেই ‘একদিন’ আর আসে না!

আমি এলাম আমার কলেজে, আহা, কত কত বছর পর! আমি আসলেই কয়েকটা মুহূর্ত একদম চোখ বন্ধ করে থাকলাম। তারপর সত্যিই চাতক পাখির মত চাইলাম অনেক কিছু দেখার আশায়। কোথাও কি আজও আছে সেই অতীত থেকে কিছু! আমার কলেজ কি এখনো থেকে গেছে আমাদের কলেজ হয়ে, অপরিবর্তিত! ওরে পাগল তা কি কখনো পুরাপুরি সম্ভব? বাম দিকে মেইন বিল্ডিংটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভালো লাগলো, ভেঙে এটাকে যে অন্যরকম করে তোলেনি তাই দেখে চোখের শান্তি হলো, মনে মনে খুশি হলাম। ঢাকা কলেজের পর প্রতিষ্ঠিত এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় কলেজ। আমার এই চত্বরে জীবনে প্রথমবার পা রাখবারও শত বছর (১৮৬৯ সালে) আগেই তৈরী হয়ে যেন বসে ছিল আমার জন্য, তাই যেন অতি সংগোপনে বড় সাধ জাগলো আমার, চেঁচিয়ে কেবলি বলতে আমার কলেজ, আমার কলেজ। 

প্রশাসনিক ভবন নাম দিয়ে বাড়িয়েছে আরেক দিক। ঠিকই আছে, বেশি ওলোট-পালোট মনে হচ্ছে না। বন্ধের দিন তাই বোধ হয় ভবনগুলোতে তালা। আমার খুবই মনে পড়তে লাগলো, এই এদিক থেকে তাকালে আগে কেমন লাগতো সেই আগেকার দিনে। এক ঝটকায় কিছু মিল কিছু অমিল চোখে পড়লো। এতো হবেই । সময়ের ফের কিছু হেরফের তো হবেই। অবাক হতাম যদি দেখতাম বিল্ডিংটাই নাই হয়ে গেছে। সে রকম কিছু হলো না। পুরাপুরি হিজাবী এক মেয়ে পাশ কেটে যেতে যেতে জানতে চাইলো- গম আছন্নি। পুরাপুরি কাপড়ে মোড়া মেয়েটিকে আমার দেখা হলো না, তবে মনে হলো আমি কেমন আছি যেন জানতে চাইলো এই শহর। হয়তোবা বহু বছর পর এই ভূমিতে এসে আমার আবেগ আর আমার বশে নেই। অনিয়ন্ত্রিত উথালপাথাল প্রেমাবেগে আমি ভাসছি।

বন্ধের দিনেও এদিক-ওদিক কিছু ছেলেমেয়ে ঘুরে বাড়াচ্ছে। ঢুকতেই ডানদিকে দেখলাম বেশ কিছু পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভালোই হয়েছে তাহলে ভয়ের কিছু নেই, পুলিশ আছে। নিরাপদ তাহলে। সোজা চলে গেলে মেয়েদের কমন রুম। আমি নেমে এলাম পাহাড়ি ঢালু পথ থেকে, এগুলাম মেয়েদের কমন রুমের দিকে। হাতের বাঁ দিকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি। এটি নতুন। ছবি তুললাম। আরো দেখলাম দেয়ালজুড়ে বাম দিকে বিখ্যাত মানুষদের স্মরণীয় উক্তি। সেকালের গাছগুলো আরো বিশাল হয়ে পথময় ছায়া দিচ্ছে আজও। সুন্দর সুন্দর কিছু বেঞ্চ ডানদিকে বানানো হয়েছে। একটি ছেলে একটি মেয়ে তাতে বসে গল্পও করছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, ওরা কি এতো কথা বলছে? ভালোবাসার কথাগুলো কি একালেও একই রকম রয়ে গেছে! আমাদের যুগে প্রেম অনেক সংরক্ষিত বিষয় ছিল। যারা ওই সময়ে প্রেমে হাবুডুবু খেত ওদের অনেক ইঁচড়ে পাকা ভাবা হতো। তবে সব যুগেই একগুচ্ছ প্রেমিক-প্রেমিকা থাকেই যারা ভেঙে ফেলে অনেক নিষেধ। আমাদের প্রথম ক্লাসে ইংরেজির শিক্ষক রণজিৎ স্যার এসে বলেছিলেন, ছেলেরা মেয়েদের বোন ভাববে, মেয়েরা ওদের ভাই। 

একটি ছেলে একটি মেয়ের চমৎকার দুর্দান্ত বন্ধু কেন হতে পারবে না তাই ভেবে আমি আজও অবাক হয়ে যাই। চট্টগ্রাম কলেজ তখনো এখনো কো-এডুকেশন, সহ-শিক্ষা। ছেলেমেয়ে একসাথে লেখাপড়া কর। ছেলেমেয়ে একসাথে থাকলে প্রেম কেন অবধারিত ভাবতেন অনেকে জানি না আমি। অনেকে পারে চমৎকারভাবে কেবল বন্ধুত্বটুকু বজায় রাখতে। বন্ধুত্ব রাখাই ভালো, প্রেম যদি বিয়েতে না গড়ায় তবে প্রিয় বন্ধুটিও হারিয়ে যায় একদিন চিরতরে। 

আরেকটু সামনে গেলেই বাম দিকে ভূগোল বিভাগ। বন্ধ। আমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ঢুকলাম মেয়েদের কমন রুমে। দেখলাম অনেক সুন্দর বসার ব্যবস্থা এখন। এখানে একদিন আমরা বান্ধবীরা বসে প্ল্যানচেট করেছিলাম। প্ল্যানচেট হচ্ছে মৃত মানুষের আত্মা ডেকে এনে সাদা কাগজে এ বি সি ডি লিখে একটা পয়সাতে দুইজন আঙুল দিয়ে চেপে ধরে সব জেনে ফেলা। একদম বোগাস। আজ মানি ওগুলো বোগাস। সে দিন কিন্তু তা মনে হয়নি। ছিল ষোলো সতেরো বছরের মেয়েগুলোর চোখে অপরিসীম কৌতূহল আর অবাক হওয়া। আমিও জানি পয়সা আমি নাড়াচ্ছিলাম না কিন্তু পয়সা চলছে, নড়ছে। বিভিন্ন বর্ণমালা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাক্য তৈরী করছে, যা আমি জানি তাই শুধু ঠিকভাবে বলছে, তখনি বুঝতে পেরেছি আমার মাথার সাথে কোনো কারিগরি চলছে। পরে জেনেছি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্ল্যানচেটের পয়সার গতিটি ইডিওমটোর প্রভাবের কারণের হয়েছে। এটি ভিক্টরিয়ান যুগে জনপ্রিয় ছিল। আর আমারও মনে হচ্ছে কোনো এক ভিক্টরিয়ান যুগে আমার আসা হয়েছিল এই কলেজে প্ল্যানচেটের আসরে। 'এই তো সেদিন এসেছিলাম'- এই রকম কোনো কিছু মনে হচ্ছে না।

আমি খুব ভাবতাম যাকে বিয়ে করবো তাকে নিয়ে এসে একদিন এই কলেজে ঘুরবো। আমি ঘুরছি একা । ইমতিয়াজকে ফোন করে ভিডিও কলে সাথে রাখা যেত কিন্তু এখন তো অনেক রাত আমেরিকায়। মেয়েদের কমন রুম থেকে বের হয়ে ছাউনি দেওয়া পথে ভূগোল বিভাগের বাহিরের দিকটা ঘিরে পেঁচিয়ে সামনের উঁচু ঢাল বয়ে উঠে গেলাম। ঢোকার মুখেই যে লাল রঙের মেইন বিল্ডিংটা আছে তাতে ঢুকবার আরেকটি পথ এদিক দিয়েও আছে জানি। ঐদিকেই যাচ্ছি। যদি ঢোকা যায় তবে ক্লাস রুমগুলো বা গ্যালারিগুলো দেখা যাবে। গিয়ে না হয় একা একাই বিশাল গ্যালারিতে বসে থাকবো। হঠাৎ আমাকে কেউ দেখলে ভূত ভেবে দৌড়ে পালাবে। এই পথের ছাউনিটা নতুন, আমাদের সময় ছিল খোলা, তখন আমাদের সাথে ছিল আকাশের সরাসরি মিতালি, আকাশেই ঢাকা ছিল এই পথ। এই পথের বাঁদিকে উঁচু একটা জায়গায় বসে আমি আর আমার বাল্য বান্ধবী তানভীর বহুদূর পর্যন্ত এক নজরে দেখে ফেলতে পারতাম। আমরা দুইজন এবং সাথে আরো অনেকে মিলে প্রায় প্রায়ই এখানে বসে থাকতাম। অনেকে আসতো, বসতো, গল্প করতো। আমরা ছিলাম অনেক বান্ধবী, ভার্সিটি যেতে যেতে অনেকে ঝরে গেছে। অনেকেরই  বিয়ে হয়ে গেছে বা চলে গেছে কোথাও।

পাহাড় বেয়ে যেতে যেতে নিচে দেখা দিলো লাইব্রেরিটা। এখান থেকে পাহাড়ের বুকে টুকটুকীয়ে নেমে গিয়েছে অনেক সিঁড়ি। আমার খুব মনে আছে তানভীর যখন প্রেগনেন্ট ছিল এই সিঁড়ি দিয়ে উঠেতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল, ওই লাইব্রেরিতেই আমাদের টেস্ট পরীক্ষার সিট পড়েছিল সেদিন। ওই সময়ের ১৭/১৮ বছরে একটি মেয়ে প্রেগনেন্ট, আজ কি আর তা ভাবা যায়! অত্যন্ত রূপবতী হবার খেসারত। ফার্স্ট  ইয়ারেই ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ওরই  প্রথম বিয়ে। তবে ওর বর সবসময়ই আমাদের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার আলম ভাই। বর্তমানে উনি টিএন্ডটি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর নিয়েছেন। ওর সেই সময়ে গর্ভে থাকা মেয়েটির আজ বিয়েও হয়ে গেছে এবং মেয়েটির ছেলেও হয়ে গেছে। জীবন আসলেই তিরতিরিয়ে চলে যায়। থামে না এতটুকুও। কোথাও। কারও জন্যই। আমিই শুধু এসে দাঁড়ালাম একা এই ক্ষণে ক্ষণিকের জন্যই।

ঢালু পাহাড়ের একদম উপরের সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার হঠাৎ একজনের কথা মনে এলো। নামটা ভুলে গেছি। একটা কিছু নাম বলেছিল বা বলেনি, আজ আর তা মনে নেই । একটা ছেলে, সেদিনই প্রথম কথা বলল, এসে বলল, দিলরুবা তুমি কলেজ টেস্ট এ ফার্স্ট হয়েছ। রেজাল্ট ঝুলিয়েছে। আমি হঠাৎই জানতে চাইলাম, তুমি কি হয়েছ? বলল, আমি একটা সাবজেক্ট ড্রপ করেছি, তাই তুমি ফার্স্ট হয়েছ। বিরক্ত হলাম, কত সাহস, এই ছেলেকে কোনোদিন ক্লাস করতে দেখেছি বলেও তো মনে পড়ে না। আমি বললাম, তুমি ওটা দিলেও আমিই ফার্স্ট হতাম। ছেলেটি বললো, ওহ, আমি তো ভেবেছিলাম আমি ড্রপ করেছি বলেই তুমি ফার্স্ট হতে পারলে! বলে হাসলো। মনে মনে বললাম, বিদায় হও আমার ত্রি-সীমানা থেকে। আমার জাদুমন্ত্রে কাজ হলো, পুরা জীবনের জন্য উধাও! আর কোনোদিন দেখা হলো না! আমাদের ছয় সেকশনে ৬/৭শ ছাত্রছাত্রী তো হবেই তখন। আমাদের যে ক্লাসগুলো গ্যালারিতে হতো, তাতেও প্রচুর ছেলেমেয়ে থাকতো। ১০০/১৫০ এর মতন । কথা হতো কয়েকজনের সাথেই। বাকিরা দূরবর্তী কোনো গ্রহের বাসিন্দা যেন। আজ এতো বছর পর যখন হঠাৎ কেউ এসে বলে অমুক শিক্ষা বর্ষে আমিও ছিলাম চট্টগ্রাম কলেজে, অমনি মনে হয়, আরে এ তো আমার প্রাণের দোস্ত। জিন্দেগীতে দেখি নাই কিন্তু হঠাৎই হয়ে যায় প্রাণপ্রিয়।একই কলেজের হওয়ার এ কি এক মাহাত্ম্য!

আমার আজও মনে আছে আমি কোথাও ঝুলানো রেজাল্টা খুঁজে পেলাম না দেখবার জন্য। ফার্স্ট হয়েছি দেখতে তো মন চাইবেই। কিন্তু পরে তানভীরের বর আলম ভাই ফোনে বলেছিলেন উনি দেখে এসেছেন। একদম উপরে আমার নাম দেখে উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। তার বৌয়ের বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম সবার উপরে এটা তো তাকে আনন্দিত করবারই কথা। এটা অনেকটা আত্মপ্রশংসামূলক হলো কিন্তু তারপরও এটা আমার খুব সুন্দর একটা স্মৃতি। এই কলেজে একদিন আমি এইচএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলাম এই ভেবে আজ আমার এতদিন পরে তা মনে করে চারদিকে ঘুরতেও খুব ভালো লাগছে, পিটুনি খওয়ার কোনো স্মৃতি থাকলে নিশ্চয়ই ভালো লাগতো না। তাই না? বা ফেল করা লাড্ডু মার্ক কোনো স্টুডেন্ট হলে তো আর নিশ্চয়ই ভালো লাগতো না। নাকি লাগে? একজন লাড্ডু মার্ক স্টুডেন্টকে পেলে জিজ্ঞেস করা যেত। মনে করার চেষ্টা করলাম কে ছিল মিষ্টি (লাড্ডু) মার্কা। কারো কথা মনে করতে পারলাম না। তবে এতো দিনের জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি জেনে গেছি যে ফার্স্ট হলেও পৃথিবী বদলে যায় না, ফেল করলেও না, তবে থাকে কেবল একটা আনন্দের স্মৃতি, এটুকুই যা। সবারই কিছু স্মৃতি থাকে একান্ত নিজের আনন্দের জন্য। আপনারা ভাগ্যবান, ভাগ পেলেন আমার আনন্দের। আমার আজকের অনুভব হচ্ছে, জীবন এক বিশাল গোলক ধাঁধা । যা আছে সামনে তাই সফলভাবে অর্জন করো, এর ফল বা অফল তথা ফলাফল কোথায় কি হবে তা জানা যাবে বহুদূর যেতে যেতে। তাই বোধ হয় বলে আজই আসল। কাল অজানা।

হঠাৎ মনে এলো, গনি বেকারির সামনে পেট্রল পাম্পটি কি আছে এখনো, খেয়াল করলাম না তো! মিসকিনশাহ (রা:) এর মাজারের পাশ কেটে কাজেম আলী হাই স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের কলেজে চলে এসেছি। সোজা চলে এলাম, তাকাতে ভুলে গেলাম কেমন করে যেন! সামনে দিয়ে এসেছি অথচ তাকাইনি এবারও। হায় আজকাল হয়ে উঠেছি বড় ভোলা মনের আমি। কী ভাবছিলাম কে জানে! আমার শ্বশুর কাজেম আলী হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তখন কি তাই ভাবছিলাম, তাই সেই ‘কিউ সি’ পেট্রোল পাম্পটি দেখিনি, বাহ্ নামটাও হঠাৎ মনে পরে গেলো। এমনই হয় হয়তোবা, সবই স্মৃতিতে থাকে জমে, ধুলোর কারণে তাৎক্ষণিকভাবে হয়তোবা জ্বলে ওঠে না।

একা একা বলে আর বেশিক্ষণ ঘুরতে সাহস হলো না। একটা কুকুর অনেকক্ষণ ধরে দূরে বসে চুপচাপ দেখছিল। সেটাও আমার খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না। দুপুর বেলা। কেমন যেন নীরবতা। মেয়েদের কমন রুমের দিকে ফিরে গেলাম। বাম  দিকের রাস্তা দিয়ে চলে গেলে সায়েন্স ফেকাল্টি, আরেকটু সামনে গেলে কলেজের মাঠ। পাশেই ছেলেদের হোস্টেল। আহা, যে সব ছেলেদের শহরে পিতামাতা ছিল না তারা সেই এতো অল্প বয়সে এসে উঠতো হলে। এতো দিনে সেদিনের ছেলেগুলো কত বয়স্ক মানুষ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। ছেলেমেয়েদের কাছে নিশ্চয়ই গল্প করেছে মহাবিদ্যালয়ের আবাসিক নিবাসে প্রথম রাতের। তখন ছিল না মেয়েদের হোস্টেল আজ আছে কিনা জানা হলো না। কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করা যেত। তারপরই মনে এলো, আছে তো সবজান্তা গুগুল। ওতেই এদিক ওদিক করে সার্চ দিয়ে জানলাম বর্তমানের আঠারো হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য পাঁচটি হল আছে, মেয়েদের দুইটি, নাম হজরত খাদিজাতুল কোবরা (রাঃ) ছাত্রীনিবাস এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রী নিবাস। বাহ্ বেশ তো।

প্রথম পর্ব : প্রিয় চট্টলা, গম আছন্নি 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়