ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

মির্জাপুরের ‘গোড়ান-সাটিয়াচড়া প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস’ আজ

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ৩ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১৫:২৮, ৩ এপ্রিল ২০২৪
মির্জাপুরের ‘গোড়ান-সাটিয়াচড়া প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস’ আজ

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ‘গোড়ান-সাটিয়াচড়া প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস’ আজ (৩ এপ্রিল)।

১৯৭১ সালের এইদিনে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে মির্জাপুরের অদূরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর নেতৃত্ব দেন ৭০ এর নির্বাচনে মির্জাপুর থেকে নির্বাচিত বয়োকণিষ্ঠ এমএলএ ফজলুর রহমান খান ফারুক (একুশে পদকপ্রাপ্ত, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান)। এটাই টাঙ্গাইল জেলায় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ।

সেদিন পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে আকাশ থেকে আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এতে ওই এলাকায় বিপুলসংখ্যক এলকাবাসী শহীদ হন। সেই সঙ্গে আশপাশের অনেকগুলো গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। সেদিনের বীর শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর মির্জাপুর গোড়ান-সাটিয়াচড়া প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস পালন করা হয়।

প্রতি বছরের মতো এ বছরও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালনে স্থানীয় প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ অন্যান্য সংগঠন নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পেয়ে যায় টাঙ্গাইল জেলাবাসী। এরপরই দেশের অন্যান্য স্থানের মতো টাঙ্গাইল জেলাবাসীও পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকায় ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং বয়োঃকনিষ্ঠ এমএলএ ফজলুর রহমান ফারুক মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে সংগ্রহ করে আনেন। এই ঘোষণা টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের জি.এস আনোয়ারুল আলম শহীদ ও টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের নেতা ফারুক আহমদ মাইকযোগে পুরো টাঙ্গাইল শহরে প্রচার করেন।

পরের দিন ২৬ মার্চ রাতে টাঙ্গাইল থেকে কয়েকটি জিপ ও কার যোগে টাঙ্গাইলের ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা মির্জাপুর সদরের ব্রিজে কয়েকটি ককটেল ফাটিয়ে ব্রিজ ধ্বংস করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্রিজের পাশের বাইমহাটি গ্রামবাসীরা তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ব্রিজ ধ্বংস থেকে তাদের বিরত করে। এভাবেই চলে যায় কয়েক দিন। এর মাঝে মধ্যেই হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল রওয়ানা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছিল। অবশেষে তারা ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলের দিকে রওয়ানা দেয়। বিশাল বহর নিয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা , কালিয়াকৈর হয়ে মির্জাপুরে ঢোকে। এই পথ পরিক্রমায় তারা তেমন কোন বাঁধার মুখে না পড়লেও গোড়ান ব্রিজের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফজলুর রহমান ফারুকের বন্দুক থেকে প্রথম গুলি ছোঁড়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমে ধল্যা বাস ষ্টেশনের কাছে বাঙ্কার খুঁড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হলেও জনবসতিপূর্ণ এলাকা বলে সেখান থেকে সরে গোড়ান ব্রিজের কাছে প্রতিরোধ বলয় তৈরি করা হয়।

হানাদার বাহিনী ধল্যা বাস ষ্টেশনে পৌঁছার পর সেখানে বাঙ্কারের অস্তিত্ব পেয়ে কিছু সময় যাত্রা থামিয়ে দিয়ে চারদিকে গুলি ছোঁড়া শুরু করে। এভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারা আবার যাত্রা শুরু করে। সেখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে গোড়ান পৌঁছানোর পরেই প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রতি রোধের মুখোমুখি হয় হানাদার বাহিনী। টাঙ্গাইলবাসী জানতে পারে, যেকোনো সময় পাকবাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশ করবে। এজন্য মির্জাপুর থানার গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় ছাত্র-জনতা ও ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।

সে সময় টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি অবস্থান করছিল। ২৭ মার্চ ভোরে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ছাত্র যুবসমাজ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বেরিয়ে আসে। কোম্পানি কমান্ডার মেজর কাজেম কামালসহ পাকিস্তানি ২ জন অফিসারকে আটক করা হয়। মার্চ মাসের শেষের দিকে মেজর শফি উল্লাহর নেতৃত্বে জয়দেবপুর থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা অস্ত্র গোলাবারুদ ও সামরিক যানসহ টাঙ্গাইলে আসেন। পরে তারা ময়মনসিংহ এর দিকে চলে যান।

এ বিষয়ে সেদিনের প্রতিরোধ যোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম আব্দুল মতিন ফাক্কন রাইজিংবিডিকে বলেন, ৩ এপ্রিল পাকবাহিনী মির্জাপুর সদর অতিক্রম করে ধল্লা পৌঁছানোর আগে সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন ফজলুর রহমান খান ফারুকের নেতৃত্বে একটি দল। সেখানেই ফজলুর রহমান খান ফারুক তার সঙ্গে থাকা দোনলা বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে পাকহানাদার বাহিনীকে প্রথম চ্যালেঞ্জ জানান।

তিনি বলেন, সংখ্যায় কম থাকায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পাক হানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী বানিয়াড়া গ্রামের দিকে ঢুকতে গিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে আবার টাঙ্গাইলের দিকে রওয়ানা হয়। অল্প কিছু দূর যাওয়ার পর তারা গোড়ান গ্রামে অবস্থান নেওয়া ছাত্র-যুবক ও ইপিআর এর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সে প্রতিরোধ ভেঙে পাকহানাদার বাহিনী সাটিয়াচড়া নামক স্থানে এসে পৌঁছলে সেখানেও তুমুল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ছাত্র যুবক ও ইপিআরের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। ৬ জন ইপিআর ও ছাত্রলীগ নেতা জুমারতসহ ৩৩৭ জনকে সেখানে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকবাহিনী। একই সঙ্গে গ্রামদুটো পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

আব্দুল মতিন ফাক্কন বলেন, আমার সঙ্গে ছিলেন ইপিআর সদস্য আব্দুল আজিজ নামের একজন সিপাহী। তার সঙ্গে থাকা এলএমজি থেকে অনবরত গুলি করে পাকহানাদার বাহিনীকে ঠেকানোর চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় হঠাৎ করে এলএমজির গুলির চেইন আটকে যায়। হানাদার বাহিনীর গুলির মুখে টিকতে না পেরে আমরা গ্রামের ভেতর ঢুকে যাই। সেখানে অনেক চেষ্টা করে তার চেইন ঠিক করা হয়। ততক্ষণে হানাদার বাহিনী আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে।

সেদিনের কথা বর্ণনাকালে আব্দুল মতিন ফাক্কনের গলা ধরে আসে। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। নিজেকে সংবরণ করে আবার বলেন, আজিজ ভাই আমাকে বললেন তুমি চলে যাও। আমি এখানে আছি। কিন্তু তাকে আমি ছেড়ে যেতে চাইছিলাম না। তিনি আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করলেন। একটি গাব গাছ দেখিয়ে বললেন, গাছটিতে অনেক পাতা। এই গাছে উঠে আমি ওদের দিকে নজর রাখবো। বলেই তিনি গাছে উঠে যান। আমি দূর থেকে দেখছিলাম হানাদার বাহিনী গুলি করতে করতে গাব গাছটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই আজিজ ভাইয়ের এলএমজির গুলি বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, পুরো গ্রামে আগুন আর গ্রামবাসীদের যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করেছে ওরা। পরে জানতে পারি গাব গাছ থেকে যে ব্যক্তি গুলি করছিলেন তার পুরো শরীর গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গাছের নিচে পড়েছিল। পরে তাকে অন্যান্য গ্রামবাসীর সঙ্গে গোড়ান গণকবরে সমাহিত করা হয়। আমি শুধু তার নামটাই জানতে পেরেছিলাম। তার বাড়ি কোথায় ছিল কিছুই জানার সময় পাইনি। গোড়ান গণকবরে আজিজ ভাইসহ অনেক বীরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়াও হাবিলদার আব্দুল খালেক, হাবিলদার খলিলুর, আব্দুল গফুর, মকবুল হোসেন, করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জুমারত আলীসহ অনেকেই সেদিন শহীদ হন। পাকবাহিনী সেদিনই পথে পথে নারকীয় হত্যা চালিয়ে বিকেলের দিকে টাঙ্গাইলে প্রবেশ করে।

গোড়ান প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৪৯ বছর পর সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর স্মৃতি সৌধটি নির্মাণ করেছে।

/হাসনাত/এসবি/

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়