ঢাকা     সোমবার   ১৭ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ৩ ১৪৩১

পালকি ও পালকির ইতিহাস

রঞ্জনা বিশ্বাস  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪০, ২৫ মে ২০২৪   আপডেট: ১৮:৫৫, ২৫ মে ২০২৪
পালকি ও পালকির ইতিহাস

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন পালকি। প্রাচীনকালে ধনীক ও অভিজাত শ্রেণির মানুষ এই বাহন ব্যবহার করতেন। বর্তমানে বাহনটি বিলুপ্তির পথে। আমাদের গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এই বাহন নিয়ে আজও আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। 

দেশে দেশে পালকি

প্রাচীনকালে চীনদেশে তিন ধরনের পালকি দেখা যেত। এক ধরনের পালকি ছিল সাধারণ লোকের জন্য। এতে বহন করা হতো সাধারণ পথচারী, অসুস্থ বা রুগ্ন ব্যক্তিদের। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত ও আহত সৈন্যদের জন্যও ব্যবহৃত হতো এ ধরনের  পালকি। দুর্গম পাহাড়ি পথে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হতো বিশেষ ধরনের পালকি। এ ধরনের পালকিতে ব্যবহার করা হতো হালকা কাঠ ও বাঁশ। এছাড়া সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকেদের ব্যবহৃত পালকিতে ছিল আরাম করে বসা বা শোয়ার ব্যবস্থা। এটি থাকত জমকালো পর্দা দিয়ে ঘেরা। দুই বা ততোধিক বেহারা এই পালকি বহন করে নিয়ে যেত। এছাড়া রাজকর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বা অফিসিয়াল পালকি যা ঘেরা থাকত দামি সিল্কের কাপড়ে। আর বিবাহের কনের জন্য নির্ধারিত পালকিতে গুরুত্ব পেত লাল রঙের সিল্কপর্দা, দামি অলঙ্কার আর পাথরের সাজসজ্জার কারণে। 

সে সময় হংকং-এ ব্যক্তিগত পালকি ওই ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার ধারক হিসেবে কাজ করত। একজন সিভিল অফিসারের মর্যাদা নির্ধারিত হতো তার পালকি বাহকের সংখ্যা দিয়ে। ভারতেও এই নিয়ম ছিল। প্রায়ই রাজাদের পালকি বাহকের সংখ্যা তার আভিজাত্য শনাক্ত করত। বলা হয়ে থাকে রাজারা ষোল বেহারার পালকি ব্যবহার করতেন। অনেক সময় সেই পালকি টেনে নিতে ব্যবহার করা হতো চমরীগাই বা ইয়াক। এ ধরনের পালকিতে খোদাই করা হতো নানারকম শিল্পকর্ম, দামি পাথর দিয়ে বর্ধিত করা হতো এর সৌন্দর্য। ১৯৭৫ সাল থেকে হংকং-এ পালকির স্মৃতি ধরে রাখতে বার্ষিক পালকি রেস অনুষ্ঠিত হয়। 

ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী জাভা সমাজে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি বিশেষ পালকিকে বলা হয় Joli. এটি কাঁধে বহন করা হতো এবং তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য ও সস্তা ছিল। আর অন্যটির নাম ছিল Jempana. এটা ছিল সমাজের উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের বাহন। এ ছাড়া সেখানকার সৈন্যদের বড় অংশ ব্যবহার করত Pang kem নামক বিশেষ এক ধরনের পালকি যার Canopy-তে থাকত ঐতিহ্যবাহী হলুদ রং।

কোরিয়ার অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ যে কাঠের তৈরি পালকি ব্যবহার করত তাকে তারা বলে Gama. কোরিয়ায় যে ছয় ধরনের গামার প্রচলন ছিল তা নির্ধারিত হতো সরকারি কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী। এছাড়া বর-কনে বহন করার পালকি ছিল বিশেষ ঐতিহ্যের ধারক।

প্রাচীন রোমে পালকিকে বলা হতো Lectica বা Sella. সে সময় সম্ভ্রান্ত পরিবার, উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, ধর্মসংঘের ব্যক্তিবর্গ পালকি ব্যবহার করতেন। তবে ৬৭৫ খ্রিষ্টাব্দের পর সেখানে ধর্মশহিদের শোক যাত্রায় বা শব যাত্রায় পালকি ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তার পরিবর্তে শোক বা শব যাত্রায় অংশগ্রণকারীরা সাদা পোশাকে হেঁটে চার্চে বা গির্জায় প্রবেশ করতেন।

ইউরোপে বিশেষত ইংল্যান্ডে পালকি বাহকদের বলা হতো ‘চেয়ারম্যান’। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির পালকি বহন করতো চারজন শক্ত-সমর্থ চেয়ারম্যান। রানি চেরিওট্রির জন্য ১৭৭৫ বাকিংহাম প্যালেসে নির্মিত হয় বিশেষ পালকি, যার ডিজাইনার ছিলেন রবার্ট এডাম। রানি চেরিওট্রি রাজা তৃতীয় জর্জের পরিণীতা এবং ডাচ রাজকন্যা ছিলেন। উনিশ শতকের গ্রেট ব্রিটেনে পালকি সাধারণ মানুষের জন্য একেবারে উন্মুক্ত হয়ে যায়।

এদিকে পর্তুগিজ শব্দ palanquim এসেছে মালে বা জাভা Palangki থেকে যার মূল নিহিত রয়েছে ইন্দো-আর্য শব্দের মধ্যে। সংস্কৃত শব্দটির অর্থ হলো বিছানা বা খাটিয়া যা বাংলায় হয়েছে পালকি। ধারণা করা হয় যে, এর সাথে মানুষের প্রথম পরিচয় ঘটে পনেরো শতকের গোড়ার দিকে। ব্র্রিটিশ শাসনামলে ভারতে যুদ্ধক্ষেত্রে ‘ডোল’ নামে ব্যবহৃত হতো পালকি। ক্রমে এটি ভারতে অভিজাত শ্রেণির আভিজাত্যের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

ইতিহাসে পালকি

তবে আভিজাত্যের ছাপ অঙ্গে নিয়ে অভিজাত নারীকে বিশেষ মর্যাদায় বহন করত যে পালকি তার বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে ইতিহাসে। ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস আদিপর্বে জানান ‘কেশবসেনের ইদিলপুর-লিপিতে দেখিতেছি একটু প্রচ্ছন্নভাবে হস্তিদন্ত নির্মিত বাহদ-যুক্ত পালকির উল্লেখ। বল্লাল সেন নাকি তাঁহার শত্রুদের রাজলক্ষ্মীদিগকে বন্দী করিয়া লইয়া আসিয়াছিলেন। এই ধরনের পালকি চড়াইয়া।’১ 

সমসাময়িক স্মৃতি বা পুরাণে ডোলবাহী বা দুলিয়া নামের শ্রমিক সেবকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং ঐতেরেয় পুরাণে ডোলবাহী বা দুলিয়াদের অসৎশূদ্রের নিম্নস্তরের গণনা করা হয়েছে। এর অর্থই হলো সেই সময়কার গ্রামীণ সমাজে পালকি বাহক বা দুলিয়াদের প্রয়োজন ছিল পালকিবহন করার জন্য। তবে পালকি আর ডোলের মধ্যে পার্থক্য আছে। পালকি ডোলেরই আধুনিক সংস্করণ। তার আগে আহত সৈন্য কিংবা অসুস্থ ব্যক্তিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য পালকি সদৃশ খোলা ডোল ব্যবহার করা হতো।

আর্যপূর্ব যুগে অর্থাৎ মহাভারতের যুগেও পশুচালিত রথের দেখা মেলে সেও তো খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছর আগে। আর্যিকরণের পর আর্যকর্তৃক বিজিত ভূমিজরা (যাদের তারা দস্যু অসুর বল) নিয়োজিত হলো তাদের সেবা দাসে। এসব সেবাদাসদের মধ্যে ডোলবাহী বা দুলিয়ারা অন্যতম। ভারতের অস্ট্রিক ভাষী সাওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন ডোলের উপস্থিতি ছিল যাকে তারা ডুলি বলে। ডুলি হলো বাঁশে ঝোলানো আদিম খাটিয়া পালকি। 

খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকেই এখানে রাজতন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়। রাষ্ট্র বা নগরায়ণের মাধ্যমেই সূত্রপাত ঘটে নানা ধরনের স্থলযান- অশ্ব, হস্তি ও গো-যান এমনকি পালকি। পালকি ছাড়া রাজমহিষী ও রাজমাতার অভিজাত্য কল্পনা করা যায় না। বাৎসায়ন রচনায় অভিজাত পরিবারের নারীদের পর্দাপ্রথা মানার কথা জানা যায়, এতে অনুমান করা যায় যে, সে সময় নারীদের বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পালকি বা ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত সরকারি কর্মচারীদের যে তালিকা আছে তার ১১তম ধাপে আছে- চতুষ্পদ প্রাণীর পরিচারক, মানুষ বা পাখি প্রভৃতি দ্বিপদ প্রাণীর পরিচারক, প্রসাধন ব্যাপারে নিযুক্ত ভৃত্য, শরীর পরিচায়ক,  সেবারত পুরুষ, গবাদিপশুর পালক ও মজুর সংগ্রাহকদের তালিকা যারা বছরে ৬০ পণ করে বেতন পেত। আর কুমারমাতা এবং অন্যান্য রাজমহিষীগণ তৃতীয় ধাপে বেতন পেতেন। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, রাজপরিবারের নারীরাও সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং এদের সাথে ধর্মানুষ্ঠানেই হোক কিংবা অন্য যেকোনো উপলক্ষ্যেই হোক একটা যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব কারো না কারো উপর ছিল। আর সে দায়িত্ব পালন করত ১১তম ধাপের কর্মচারীরা।  

পালকি ও পালকি বাহকদের প্রাচীনত্ব প্রামণের জন্য ‘বিক্রমাদিত্যের কালিদাস আবিষ্কার’ গল্পটির অবতারণা অযৌক্তিক হবে না। গল্পটি এইরূপ- একটি গাছতলায় এক লোক বসে ছিল। কৌপিন বা নেংটি পড়া লোকটির ধুলিমাখা মলিন শরীর। ওই পথ ধরে যাচ্ছিল রাজা বিক্রমাদিত্য। তাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল ষোল বেহারার পালকি। রাজকীয় পালকিতে চড়ে যাচ্ছেন রাজা বিক্রমাদিত্য। হঠাৎ বেহারাদের একজন কৌপিন পড়া লোকটিকে দেখে বলল, ‘এই ব্যাটা কাঁধ লাগা’। কৌপিন পড়া লোকটি ভাবলো- রাজার পালকি কাঁধ না লাগিয়ে উপায় কী!

সে কাঁধ লাগালো। কিন্তু কাঁধ লাগাতে গিয়ে পালকিখানা একটু নড়ে উঠলো- এটাই স্বাভাবিক। তখন পালকির মধ্য থেকে রাজা বললেন ‘ক্ষণং বিশ্রাম্যতাং জাল্ম যদিতে বাধতি স্কন্ধে।’ 

একথা শুনে কৌপিন পড়া লোকটি বলল, ‘‘নঃ বাধতে স্কন্ধে তথা যথা ‘বাধতি’ বাধতে।’’ অর্থাৎ আমার কাঁধে তত লাগছে না যত লাগছে ‘বাধতি’ শব্দটি। একথা শুনে রাজা পালকি থেকে নেমে কালিদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রাজার কথার ভুল ধরার পরেও রাজার এই বিনয় এখন আর দেখা যায় না। এখানে ‘জাল্ম’ শব্দটি সংস্কৃত যার অর্থ পালকিবাহক বা শিবিকা বাহক। এই গল্পের চরিত্র দুটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তাই এদের আবির্ভাবকাল শনাক্ত করলে পালকির অস্তিত্বের সময় নির্ণয় সম্ভব হয়।

গল্পের দুটি বিখ্যাত চরিত্র রাজা বিক্রমাদিত্য ও কালিদাসের কাল নির্ণয় নিয়ে জটিলতা রয়েছে। ইতিহাসে বিক্রমাদিত্য গুপ্ত যুগের রাজা। গুপ্ত যুগের সময় কাল ৩০০ থেকে ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ। অন্যদিকে ভবিষ্যপুরাণের বিক্রমাদিত্য হলেন গান্ধর্বসেনার পুত্র। ইনি উজ্জয়িনীর রাজা ছিলেন। বলা হয় যে, তার জন্মের সময় দেবতারা পুষ্প বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন। এই রাজার রাজদরবার যে নয়জন পণ্ডিত অলংকৃত করেছিলেন তাদের মধ্যে- ধন্বন্তরি, অমরসিংহ, বেতালভট্ট, ভারুচি, বরাহমিহির প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের সাথে কালিদাসের নামও উচ্চারিত হয়। 

ভবিষ্যপুরাণকে আদর্শ ধরলে বিক্রমাদিত্যের সময় দাঁড়ায় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০-৩৫০ এর মধ্যে। এ সময়ই নানারকম পুরাণ এমনকি রামায়ণের সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বিক্রমাদিত্য বা কালিদাসের গল্পের পালকির উপস্থিতি আমরা পাই খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশে পালকি নামক বাহনটির ইতিহাস অনেক পুরোনো। পুরাণে ডোলবাহী বা দুলেদের উপস্থিতিও সেই সত্যের প্রমাণ দেয়।

বাংলার পালকি বাহক

প্রাচীন বাঙলার শাসন কাজের গুরুত্বের কারণেই স্থাপিত হয় নগর ও নগর প্রশাসন। রাজা, মহারাজা, সামন্তগণ ছিলেন নগরবাসী। এছাড়া ধর্ম ও শিক্ষাগুরু, আচার্য পুরোহিত, ছাত্র, শিষ্যও ছিলেন নগরবাসী। কিন্তু নগরের বাইরে যেসব ম্লেচ্ছ ও অন্ত্যজ পর্যায়ের সমাজসেবক যেমন: ডোম, চন্ডাল, ডোলবাহী চর্মকার, মাংসছেদকসহ অনেকে নাগরিক হিসেবে গণ্য হতো না। এরা মূলত রাজা, ব্রাহ্মণ ও বিত্তবানদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু সেই সেবা দাস হওয়ার ভাগ্যও সবার হতো না। অস্পৃশ্য পালকিবাহকদের পালকিতে উঠলে জাত্যাভিমানী-অভিজাতদের স্নান সেরে ঘরে যেতে হতো। এই সমস্যা লাঘবের জন্য জমিদারগণ তাদের পালকি বইবার জন্য ‘জলচল’ বলে খ্যাত নিম্নবর্ণের দ্বারস্থ হন আর এজন্য তারা ওড়িশা থেকে বেহারাদের নিয়ে আসেন। বাগদীরাও এই পর্যায়ভুক্ত। এইসব বেহারার সংস্পর্শে জাত যাবার কোনো ভয় ছিল না। ফলে একসময় পালকি বাহক হিসেবে উড়িয়া-বাগদীরা একেবারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আমরা যাদের ‘কাহার’ বলি তারা এই বাগদী-ই।

তারাশঙ্কর ‘আমার কালের কথায়’ পরিষ্কার করে বলেন: ‘বাগদীদের মধ্যে যারা পাল্কী বহন করতো তারা বাগদী কাহার। যারা বহন করতো না তারা শুধুই বাগদী’। এই বক্তব্যে কিন্তু কাহার বলতে পালকিবাহক গোষ্ঠী বোঝায়, বোঝায় না আলাদা একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কথা। আবার অন্যত্র তিনি কাহার সম্পর্কে বলেন, ‘কাহার বলে কোন নির্দিষ্ট জাতি বাংলাদেশে নাই। আমরা যাদের হরিজন বলি এদের মধ্যেই যারা পালকি বয়ে থাকে তারাই বাংলাদেশে কাহার।’ এ কথা পরিষ্কার করে বলতে পারি যে, বাংলাদেশে বাগদীরাই স্বীকৃত পালকি বাহক হিসেবে পরিচিত। অন্তত ক্ষেত্রসমীক্ষায় তা-ই প্রমাণ হয়। এই সব জনগোষ্ঠী নীল চাষের সময় এদেশে এসেছিল। নীল কুঠি উঠে গেলে এরা পালকি বাহকের কাজ করতে শুরু করে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, নীল চাষের যুগ শেষ হলে এরা পালকি বাহকের কাজ করতে শুরু করে। এর আগেও তারা বেহারার কাজ করত বলে ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।

পালকির ধরন ও প্রকারভেদ

নগর সভ্যতার উন্মেষের সময় থেকেই বাংলায় পালকির অল্পবিস্তর চল শুরু হয়েছিল। প্রাচীন পুরাণকে প্রমাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনায় আনলে এর কাল নির্দেশিত হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ১০০০ অব্দ। এরপর ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের আভিজাত্যের অংশ হিসেবে পালকি তার অবস্থান সুদৃঢ় করে নিজে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে সংস্কৃত শব্দ ‘পল্যঙ্কিকা’ থেকে পালকি শব্দটি এসেছে বলে গবেষকগণ মনে করেন। 

পল্যঙ্কিকা>পাল্যাষ্ককা>পল্যঙ>পালকি। এ প্রসঙ্গে ড. প্রবালকান্তি হাজরা বলেন, ‘‘শব্দবিজ্ঞানীদের মতে- সংস্কৃত ‘পল্যঙ্কিকা’ থেকে পাল্কি কথাটি এসেছে। কারও মতে পাল্যাঙ্ককা বা পাল্যঙ্ক থেকে এই শব্দটি পেয়েছি। পাল্কির সমগোত্রীয় মানুষ্য বহনের যান হলো আঞ্জাম, কান্তি।’’ সাওতালী ভাষার সাথে বাংলা ভাষার ঘনিষ্ঠতা  যাচাই করতে গিয়ে পালকি শব্দটিকে সরাসরি সাওতালী শব্দ বলে উল্লেখ করেছেন   ক্ষুদিরাম দাশ তার সাওতালী বাংলা সমশব্দ অভিধানে। নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা যায়, বাঁশে ঝোলানো কাপড় দিয়ে ঘেরা বাহনকে সাওতালী ভাষায় ‘ডুলি’ বলে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, বাহনটি আর্য পূর্ব যুগ থেকেই এদেশে ছিল।

অবস্থা এবং আভিজাত্যের নিদর্শন হিসেবে আবার নানা নামে পরিচিত ছিল- রাজপঙ্খী, ময়ূরপঙ্খী, আয়নাপালকি ইত্যাদি। বাংলাপিডিয়ায় তিন প্রকার পালকির উল্লেখ আছে- সাধারণ পালকি, আয়না পালকি ও ময়ূরপঙ্খী পালকি। সাধারণ পালকি আয়তকার চারদিক কাঠ দিয়ে আবৃত এবং ছন্দ ঢালু। এর দুদিকে দুটি দরজা থাকে। কোনো কোনোটিতে জানালাও থাকে। পালকির বাইরের দিকে আল্পনা আঁকা থাকে। সাধারণ পালকি মূলত সাধারণ মানুষের জন্য নির্ধারিত। আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকে। ভিতরে চেয়ারের মতো দুটি আসন ও একটি টেবিল থাকে। আয়না পালকির আয়নাই প্রধান অনুষঙ্গ। ময়ূরপঙ্খী পালকির আয়তন সবচেয়ে বড়। এই পালকি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। ভিতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল ও তাক থাকে। এ পালকির বাটটি বাঁকানো এবং এর বাইরের দিকে কাঠের তৈরি পাখি, পুতুল, তালপাতার নকশা থাকে। সাধারণত জমিদারগণ এই ধরনের পালকি ব্যবহার করতেন। ময়ূরপঙ্খীর মতো রাজপঙ্খীর আকৃতি বড়। ভিতরে দুটি সুদৃশ্য চেয়ার, একটি কারুকার্যময় টেবিল ও তাক থাকে। এর বাট বা ডাফে ধাতু, পাথর ও মণিমুক্তার কারুকাজ, সিলিং-এ নকশা, দেয়ালেও খোদাই করা বিচিত্র নকশার সমাহার। মূলত রাজপরিবারেই এই পালকি ব্যবহৃত হতো। এছাড়া ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে স্টেজ পালকি নামে এক ধরনের পালকির প্রচলন ছিল। ব্র্রিটিশ সরকারের ডাক বিভাগ ডাক ও যাত্রী বহনের জন্য স্টেজ পালকি চালু করে। দূরের যাত্রীরা ডাকঘর থেকে স্টেজ পালকির টিকিট সংগ্রহ করত।

পালকি তৈরিতে ব্যবহার করা হতো শক্ত কিন্তু হালকা কাঠ। জমিদারদের পালকি তৈরি হতো সেগুন কিংবা লোহা কাঠ দিয়ে। কাঠের তক্তা দিয়ে ঘেরা বাক্সের মতো দেখতে পালকির দুই পাশে লাগানো থাকত বহদণ্ড বা হাতল। একে ডাফ বলা হয়। সাধারণ একটি পালকি লম্বায় তিন ফুট, চওড়ায় দুই ফুট এবং এর উচ্চতাও দুই  থেকে আড়াই ফুট হতো। আর হাতলের দৈর্ঘ্য হতো প্রায় পাঁচ ফুটের মতো। পালকির দুই পাশে প্রবেশ দ্বার থাকত। দ্বারে পাল্লা লাগানো হতো। পালকি বসানোর জন্য (এতে পায়া থাকত। পালকিতে বসার অংশটুকু বেত, তাল বা নারকেলের রশি দিয়ে বোনা হতো। এতে পালকি বইবার সময় দোলা অনুভূত হতো। একটি পালকির ওজন এক থেকে দেড় মণের মধ্যে হলেই ভালো হয়। পালকি তৈরির পর এতে দৃষ্টিনন্দন করতে রং দিয়ে নকশা এঁকে দেয়া হতো। রাজ-রাজাদের পালকির বহদণ্ডগুলো সাজানো হতো হাতির দাঁত দিয়ে। চকমকি-পাথর বা আয়না বসিয়ে বাড়ানো হতো পালকির সৌন্দর্য।

পালকি বাহক হতো চারজন। আট ও ষোল বেহারার পালকিও ছিল। রানি রাসমণির পালকি ছিল আট বেহারার। আবার রানি রাসমণির খাজনা আদায়কারী চৌধুরীদের পালকি ছিল চার বেহারার। প্রথম পালকি বাহক যে কাঁধে ডাফ নেন নিয়মানুযায়ী অপর পালকি বাহক তার বিপরীত কাঁধে ডাফ নেবেন। এভাবে তৃতীয় ও চতুর্থজন ডাফ বহন করেন। পা ফেলার সময় তারা প্রথম ডান পা ফেলেন এবং নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যেই তাদের পা ফেলতে হয়। এর অন্যথা হলে পালকি বইতে কষ্ট হয়। বংশ পরম্পরায় যারা পালকি বয় তাদের ক্ষেত্রে তালিম প্রয়োজন হয় না। 

পালকি বাহকরা দুইভাবে পালকি বাহকের কাজ করতেন জমিদারদের পালকি বইতেন খাওয়া এবং বেতনের বিনিময়ে। আর অন্যের পালকি ভাড়া নিয়ে পালকি বইতেন। এতে মালিককে পালকির জন্য (ভাড়া) টাকা দিতে হতো। পালকির ভাড়া হতো ক্রোশ হিসেবে। প্রতি পাঁচ ক্রোশ এক টাকা থেকে দেড় টাকা। কখনো চুক্তিতেও মিটানো হতো ভাড়া। প্রতি পাঁচ ক্রোশ পথ যাবার পর পালকি নামিয়ে বেহারারা বিশ্রাম নিতো।

গায়ের উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথ চলার ক্লান্তি যাতে কম অনুভূত হয় তার জন্য তারা গান গাইতো। এগুলোকে পালকির গান বলা হয়। এ গানের নিগুঢ় কোনো অর্থ নেই...তবে বিয়ে উপলক্ষ্যে পালকি বাহকেরা বেশ অর্থপূর্ণ গান গাইতো। পথ চলার ক্লান্তি দূর করার গানের ক্ষেত্রে প্রথমজন গানের সুর ও কথা বলে অন্যেরা কেবল ধুয়ো তুলে সুরকে ধরে রাখে। গান শুরু হয় ধীর লয় ক্রমে তা চড়া বা উঁচু হয়। যতই সুর চড়ে যায় ততই তাদের চলার গতি বৃদ্ধি পায়। আবার সুর নিচে নেমে এলে চলার গতিও কমে আসে। এসব গান তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি হয়। যেমন: ধুনটের বাগদী বেহারারা গায়-

        দাদা গো...../হেই-আ
        পাট ঠাকুরকে/ হেই-আ
        স্মরণ করে/ হেই আ
        মা কালীকে/ হেই আ
        দাদা গো/ হেই আ
        মনে রেখো/ হেই আ
        পালকি চলছে/ হেই আ
        ধুনট থেকে/ হেই আ
        ঢাকা যাবে/ হেই আ


তথ্যসূচি

১।বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায় পৃ: ৪৫৬
২। প্রাচীন বাংলার রাষ্ট্র ও প্রশাসন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন পৃ: ৬৯
৩। গ্রামীণ সংস্কৃতির ঝাপি, ড. প্রবাল কান্তি হাজরা পৃ: ১৭
 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়