ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

‘খুব কষ্টে আছি’— মৃত্যুর আগে কিশোরী লাবণ্যের মায়ের কাছে আকুতি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৩, ১৫ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ০৫:৫৪, ১৫ অক্টোবর ২০২১
‘খুব কষ্টে আছি’— মৃত্যুর আগে কিশোরী লাবণ্যের মায়ের কাছে আকুতি

শ্বশুরবাড়ির লোকজন-স্বামীর অত্যাচার সইতে পারছিল না সন্তানসম্ভাবা কিশোরী সুরাইয়া নেওয়াজ লাবণ্য (১৭)। এক সময় গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যাওয়ায় শুরু হয় জীবন-মৃত্যুর সংগ্রাম। এ কারণে মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে মৃত সন্তান জন্ম দিলেও তার মুখ দেখা হয়নি।  চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) রাতে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতেল ৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর না ফেরার দেশে চলে যায় লাবণ্য। তার এ চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনেরা।

তারা বলছেন, ৯ অক্টোবর  স্বামী শেখ সাদী হোসেনের সঙ্গে কথা হয় লাবণ্যের। এরপরই সন্ধ্যার দিকে নেত্রকোনার বাসায় প্রথমে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে এবং পরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। মুহূর্তের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যাওয়ায় তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ভর্তি করা হয়। সেখানেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় লাবণ্য পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায়।  জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকলেও স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির কেউ কোনো খোঁজখবরও নিতে আসেনি।

বাবা আরিফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আগে লাবণ্য কেন এই পথ বেছে নিল সে কথা জানিয়েছে। তারা প্রশ্ন করেছেন।  অনেকটা বিরতি দিয়েও কথা বলতে পারছিল না, বাবা-মার প্রশ্নের জবাব দিতে কষ্ট হচ্ছিল। থেমে থেমে বাবা-মার প্রশ্নের জবাব দিতে লাবণ্য বলছিল, ‘নিজেই দিছি, তুমরার জামাইয়ের কথার কারণে। অনেক খারাপ খারাপ কথা কইছে। বাঁচতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। এতো খারাপ কথা বলে তো কি করমু?’

‘স্বামী সাদীর সাথে কথা বলমু না। আসলেও দেখা করমু না, আমি চাই না হে এওনো আইয়ুক। আমি অনেক ভালো আছি। তোমার জামাই কই? সে দাদুর কাছে কইছিল টাকার কথা। আমি কইছি না। বলে তোর তো সংসার করার ইচ্ছা নাই, সংসার করার ইচ্ছা থাকলে প্রতিষ্ঠা কইরা দিতি, যা হয় নাই।’

‘শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ জামাই এমন দিন গেছে প্রচণ্ড মারধোর করতো। ২/৩ দিন না খাইয়া আছি, ভালো হলেও আর কোনদিন সাদীর কাছে ফিরবো না।’

পাশাপাশি মৃত্যুর আগে স্বামী টাকা চেয়ে লাবণ্যর উপর অত্যাচার নির্যাতন করে।

লাবণ্যের মা বৃহস্পতিবার রাতে ঢামেক হাসপাতালে আলাপচারিতায় বলছিলেন, ‘লাবণ্যের গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে শ্বশুরবাড়িতে তার মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া ছিল নিষেধ। হাতের পাশে একটু ভর্তা আর ডাল দিতো খেতে। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়নি ওরা। লাবণ্যের স্বামী তার চিকিৎসকের কাছে যেতে হলে দাদার বাড়িতে ফিরতে হবে জানায়। তবে লাবণ্যকে আনতে গেল শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে না দিয়ে গর্ভবতী হওয়ার পর প্রচণ্ড মারধর শুরু করে। নির্যাতন সইতে না পেরে মেয়েটির বাসা থেকে বেরিয়েও আসে।’

মাহফুজা ফাতেমা আরও বললেন, ‘লাবণ্য যেদিন গায়ে আগুন দেয় তার কিছুক্ষণ আগে আমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল লাবণ্য খুব কষ্টে আছে। আমি মা, আমার একটা কিছু করা দরকার। ঢাকা থেকে আমি মেয়েকে ময়মনসিংহ শহরের ধোবাউড়ায় দাদীর বাড়িতে আনতে যাই। কিন্তু তখনও লাবণ্যকে তারা দেয়নি।’

এ বিষয়ে হাসপাতালের আবাসিক সার্জন আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘আমরা সব ধরনের চেষ্টা করেছিলাম লাবণ্যকে বাঁচিয়ে রাখার। কিন্তু তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তাকে আর বাঁচানো গেল না। তবে সে সন্তান সম্ভবা হওয়ায় মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে মৃত সন্তানের জন্ম দেয়। জানা গেছে, লাবণ্যের মৃত সন্তানের দাফন আজিমপুর কবরস্থানে সম্পন্ন করা হয়েছে।’

বৃহস্পতিবার রাতে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় নেত্রকোনার কমলকান্দা থানার অফিসার ইন চার্জ (ওসি) আব্দুল আহাদের। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে আমিও ঘটনাটি শুনেছি। অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে এখনো পর্যন্ত কেউ এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

মাকসুদ/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়