ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বেসামাল ইয়াহিয়া খান

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেসামাল ইয়াহিয়া খান

শাহ মতিন টিপু : ডিসেম্বর মানেই পাকিস্তানের জন্য এক বিভীষিকা। ডিসেম্বর মানেই বাংলাদেশের মুক্তিকামী যোদ্ধাদের আক্রমনে বিধ্বস্ত পাকিস্তানি হানাদার। ১, ২ করে ডিসেম্বরের তারিখ যত এগুচ্ছে, ততই খোলসে গুটিয়ে যেতে হচ্ছে পাকিস্তানি হানাদারদের। এমন একটি অবস্থার মধ্যে একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর খুব কঠিন একটা সময় পাকি খান সেনাদের জন্য। চারদিকে শুধুই পরাজয়ের দুঃসংবাদ। পিছু হটতে হটতে সব এসে জড়ো হয়েছে ঢাকায়।

 

এমতাবস্থায় বেসামাল পাকি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান। আর ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী ও রাও ফরমান আলী দিশেহারা। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য। এখন তাদের আত্মরক্ষার পালা। পাকিস্তানের পরাজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আকাশে উড়ছে রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলার পতাকা। আনুষ্ঠানিক বিজয়ের আগেই একাত্তরের এ দিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার।

 

পাক হানাদারদের মনোবল ভেঙ্গে চুরমার। দেশের বিভিন্নস্থান থেকে শুধুই বিজয়ের খবর। অধিকাংশ জেলাই হানাদারমুক্ত। কিন্তু তখনও পাকিস্তানের নিশ্চিত পরাজয় ঠেকাতে মরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

 

একাত্তরের এ দিন যশোরের মুক্ত এলাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো (১) বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে।

 

এ ট্রাইব্যুনাল নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করবে। (২) ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি দোকানের মালিক ছিলেন তাদের সব ফিরিয়ে দেয়া হবে। (৩) সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। (৪) জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী নিষিদ্ধ করা হবে।

 

একাত্তরের রক্তক্ষরা এ দিনে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘পরদিন (১২ ডিসেম্বর) মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

 

যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুঁশিয়ারি সামান্যতম মনোবল ভাঙ্গতে পারেনি মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অকুতোভয় বীর সেনানীদের। চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের ওপর আক্রমণ আরও শানিত হয়। যুদ্ধ চলছে চারদিকে। আর এক এক করে মুক্ত হচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। একাত্তরের ডিসেম্বরের এ দিন ঢাকার আশপাশের মানুষ পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ। মুক্তিবাহিনীর মূল লক্ষ্যই ছিল দেশের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিজয়।

 

ঢাকা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে চারিদিক থেকে ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বাংলার বীর মুক্তি সেনারা এগিয়ে আসছিল। পথে পথে যেসব জনপদ, গ্রাম, শহর-বন্দর পড়ছিল সর্বত্রই মুক্তিসেনারা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। একাত্তর সালের এ দিন শত্রুমুক্ত হয় জামালপুর, মুন্সীগঞ্জ, আশুগঞ্জ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুরের হিলিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা।
মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী নিয়ন্ত্রিত টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে একাত্তরের এই দিনে মিত্রবাহিনীর ৭০০ সৈন্য অবতরণ করে। এ সময় পাকিস্তানী ব্রিগেডের সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ হয়।

 

এই দিনে পাকিস্তানের আরেক শক্ত ঘাঁটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও উপকূলীয় অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ ব্যাপক তৎপরতা চালায়। একের পর এক বোমা ও রকেট হামলা চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয় পাক হানাদারদের সবকিছু। আকাশ ও স্থলে মুক্তি ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা পাক সৈন্যরা নদী পথে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সর্বত্র সতর্ক প্রহরা যে আগেই বসানো হয়েছিল, তা জানা ছিল না হানাদারদের। তাই পাকি সামরিক পোশাক ছেড়ে সাধারণ বেশে নদী পথে অনেক পাক সৈন্য পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।

 

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এম এ মালিকের যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব এইদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নাকচ করে দেন। সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লেখা রিপোর্টে উল্লেখ করেন, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান।

 

শর্তগুলো হচ্ছে: এক. পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। দুই. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোন লিখিত চুক্তি করবে না। তিন. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে দিতে হবে। চার. এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে আসতে দিতে হবে। পাঁচ. সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এ প্রস্তাব নাকচ করেন। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানকে যুদ্ধ সহায়তা দেবার দাবি জানান। আত্মসমর্পণের এমন শর্তের খবরে চারিদিকে মুক্তিবাহিনীর উল্লাস আর জয়-জয়কার।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ ডিসেম্বর ২০১৫/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়